চিৎকার
▪ পার্থসারথি
*
রাশেদ আহম্মেদের মন-সমুদ্রের প্রতিটি কোণে কোণে, ভাঁজে ভাঁজে এখন আনন্দের বন্যা। আনন্দের গন্ধে গন্ধে ঘর মৌ মৌ করছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছড়িয়ে পড়ছে রাশি রাশি আনন্দ। নিজেকে সামলে নিতে ক্ষণে ক্ষণে আদরে আর সোহাগে ঝাপটে ধরছেন সোহাগী স্ত্রী মৌমিতাকে। অথবা স্ত্রীর তলপেটে কান পেতে শোনেন অনাগত সন্তানের অনুভূতি। এই আনন্দের ফুলঝুরি যেন আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুরের মাতাল হাওয়া। এত আনন্দ হবেই না কেন! বিয়ের দশ বৎসর পেরিয়ে এখন সন্তানের আগমনী বার্তা শুনছেন। স্বামীর এই আনন্দে মৌমিতাও চুপটি চুপটি লাজুক হেসে বলেন- তোমার আনন্দের বন্যায় আমিও যে পাগল প্রায়!
স্ত্রীকে সোহাগের চাদরে জড়িয়ে ধরে রাশেদ সাহেব জানতে চান- বউ এবার ঈদে তোমাকে কী দেব বলো?
মৌমিতা স্বামীর আদর নিতে নিতে বলেন- আমার স্পেশাল কিছুই চাই না। তুমি ভালোবেসে যা দিবে তাতেই আমি খুশী।
রাশেদ সাহেবের মনটা আরও উতলা হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে উজাড় করে দিতে। আবারও ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে বলেন- প্লিজ, তুমি কিছু বলো। তুমি যা চাইবে তাই দেবো।
মৌমিতা লাজুক হাসির বন্যায় রাশেদ সাহেবকে ভাসিয়ে উচ্চারণ করেন- আমার কিছুই চাই না। তোমার এই আনন্দে ভাসা মুহূর্তগুলোয় সারাজীবন বেঁচে থাকতে চাই।
রাশেদ সাহেব মৌমিতাকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে সুখের একটা গভীর নিঃশ্বাস ছাড়েন। আর মনে মনে ভাবেন ফেলে আসা কষ্টের মুহূ্র্তগুলোর কথা। কত দিন আর রজনী এক করেছেন শুধু সন্তানের পদধ্বনি শোনার আশায়। সেই কাঙ্খিত ধন আসছে চারদিক আলোকিত করে।
ওদের সুখের দিনগুলোর প্রত্যাশায় মা-বাবাও গ্রামের বাড়ীতে বসে আছেন অধীর আগ্রহে। প্রতিদিনই সুখের মুহূ্র্তগুলো বিনিময় হয় ম্যাসেঞ্জারের আলোকে।
কলমের চিবুক দিয়ে আনন্দের অক্ষরগুলো কাগজের বুকে ঠুকছিলেন রাশেদ সাহেব। ফর্দ একটু একটু করে দীর্ঘ হচ্ছে।
এবারের ঈদে আনন্দের জোয়ারে সবাইকে খুশীতে ভাসাতে চান । বাবা, মা, একমাত্র ভাই নিশালসহ কাছে-দূরের অনেক আত্মীয়ও ঠাঁই পেয়েছে ফর্দের বিস্তৃত বুকে। বাদ যায় নি অনাগত কন্যা।
দীর্ঘ তালিকা দেখে মৌমিতা হাঁফিয়ে ওঠেন এবং বলেন- শোন রাশেদ, তোমার আনন্দে আমিও ভাসি সবসময়। কিন্তু এখন যে দুঃসময় পৃথিবীময় চলছে তাতে আমার মনে হয় আমরা একটু বাড়বাড়িই করছি।পুরো বিশ্বকে ওলটপালট করে দিচ্ছে এই করোনা। আর তুমি কী করে এত দুঃসাহস করছো, করবে ঈদের কেনা-কাটা।
রাশেদ সাহেবের সোজাসাপটা উত্তর- অতসব বুঝি না আমি। আমার এই আনন্দ আমি সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই।তুমি এসব বুঝবে না। আনন্দ বিলিয়ে দিতে কী যে সুখ, কী যে শান্তি! আর হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় সরকার বুঝে-শুনেই গার্মেন্টস খুলে দিয়েছে। আর ঈদ শপিং-এর জন্য সীমিত আকারে দোকানপাট খোলার আদেশ দিয়েছে। দেখবে কিছুই হবে না। আরে এত চিন্তা করছো কেন! আমি নিয়ম মেনেই শপিং-এ যাব।
মৌমিতার অভিমানী সুর- আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার কথা বুঝলাম। কিন্তু এত বাড়াবাড়িটুকু আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না। যদি কিছু হয়ে যায়! তখন তো সব উবে যাবে। আমাদের সন্তান আসছে। ওর জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় তৈরী করে রাখা আমাদের কর্তব্য। আমাদের অনাগত সন্তান হলো ভবিষ্যৎ। খুব সাবধানে থাকতে হবে আমাদের সকলের। কোথা থেকে কখন কী হয়ে যায়!
মৌমিতাকে রাশেদ সাহেব বুঝাতে চেষ্টা করেন- তুমি এত উতলা হয়ো না। কিচ্ছু হবে না।
শোন রাশেদ, তুমি-আমি মরে গেলে কারও কিছুই আসবে যাবে না। শুধু সংখ্যা যোগ হবে।
দেখো না, আমরা প্রতিদিন হাজারে হাজার করোনার মৃত্যু সংখ্যা হিসাব করি। কিন্তু এই সংখ্যার ভেতর প্রতিটি পরিবারের দুঃখ-কষ্টের বেদনা নিঃসৃত নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনি ক'জন শুনতেপাই অথবা বুঝতে চেষ্টা করি। একেকটা মৃত্যু একেকটা পরিবারের প্রতিটি মানুষের সারাজীবনের কান্না আর দুঃখ-কষ্টের কথামালা গেঁথে আছে।লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া সংসারের করুণ সুর মিশে আছে প্রতিটি মৃত্যুর মিছিলে। মৃত্যুর মিছিলের সাথে কষ্টের মিছিলও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তুমি তো প্রতিদিনই দেখছো।
রাশেদ সাহেবের সরল উত্তর- ওসব নিয়ে তুমি একদম দুঃশ্চিন্তা করো না। আমি খুব সাবধানে থাকবো। শপিং-এ আমি দূরত্ব বজায় রেখেই চলবো। কোন সমস্যা হবে না দেখো। আরে এই দশ-বিশ জনের চেয়ে বেশি তো আমাদের দেশে হরহামেশাই মরছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনাতেই এর চেয়ে বেশি মারা যেত। বরং এখন মোট মৃত্যু হিসাব করলে অনেক কম।
তুমি সরকারি চাকুরে এমন কথা বলবেই। সেসব বাদ দাও। তোমার এই পাগলামী কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। আমাদের সন্তান আসছে। এখন আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। আর তুমি কিনা ঈদের শপিং করতে যাবে!
কেন এখন প্রায় প্রতিদিন বাজারে যাচ্ছি না? কই কিছু তো হচ্ছে না!
হতে কতক্ষণ। প্লিজ, এবার অন্ততঃ আমাদের সন্তানের মুখ চেয়ে ঈদ শপিংটা বাদ দাও। একবার না হয় পুরনো কাপড়ে ঈদ করলাম। আল্লাহ যদি দয়া করেন তো আবার সামনের ঈদ নতুন কাপড়ে ধুমধাম করে করবো। আর বাড়ীতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাও বাদ দাও। বেঁচে থাকলে আমরা আরও আনন্দ করতে পারবো।
একি বলছো তুমি ! আব্বা-আম্মার দোয়া নিয়ে আসবো না! তা হয় নাকি?
মৌমিতা রাগও করতে পারছেন না আবার খুশীও হতে পারছেন না। দুঃশ্চিন্তার বেড়াজাল বারবার আঁকড়ে ধরছে। প্রতিদিনকার সংবাদ শুনলে চিন্তার জগৎ সব এলোমেলো হয়ে আসে। স্বামী নাছোড়বান্দা। ঈদের শপিং করে দু'দিনেরজন্য বাড়ীতে যাবেই।কপালের দুঃশ্চিন্তার বলিরেখা আরও প্রবল হওয়া সত্ত্বেও মৌমিতা রাশেদ সাহেবকে ঈদের আনন্দে ছেড়ে দেন।
*
রাশেদ আনন্দের সহিত ঈদের কেনাকাটায় আদরের হাত বুলায়। সকল বাঁধা পেরিয়ে শেষে খুশীর জোয়ার ব্যাগে ব্যাগে বন্দি করলেন রাশেদ সাহেব। অনাগত কন্যা সন্তানের জন্য সাত সাতটি পোশাকের সেট। রাশেদ সাহেবের পছন্দের সংখ্যা সাত। স্ত্রী মৌমিতার জন্য গোলাপী জমিনের উপর হালকা আকাশী রঙের কাজ করা দামী জামদানী শাড়ী। আর নিজের জন্য পছন্দসই একটা পাঞ্জাবী। আব্বার জন্য শাদা পাজামা-পাঞ্জাবী, আম্মুর জন্য হালকা গোলাপী রঙের ঢাকাই জামদানী, ছোট ভাই নিশালের পছন্দ করে রাখা ডিজাইন করা কলারওয়ালা পাঞ্জাবীটা কিনতেও ভুল করেননি
রাশেদ সাহেব। কাছে-দূরের আত্মীয় স্বজনের জন্যও অনেক কেনা-কাটা হয়েছে। পছন্দের রাশি রাশি জিনিসের উপর হাত বুলাচ্ছেন আর তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে স্ত্রীকে বললেন- এবারের ঈদটা হবে আমার সবচেয়ে আনন্দের।
মৌমিতা ইচ্ছের বিরুদ্ধে হাসির প্রলেপ মেখে বলেন- আমার কিন্তু দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। আনন্দ ঠিকই আছে তবে কেন যেন তোমার মতো এতটা প্রকাশ করতে পারছি না।
মৌমিতার তলপেটটা একটু ফুলে ওঠতেই রাশেদ সাহেবের আদরের হাত চলে যায় ওখানে। উঁচু হয়ে উঠা অংশটুকুতে হাত রেখে পরম আবেগের উচ্চারণ- আমার রাজকন্যা আর অন্ধকারে থাকতে চাচ্ছে না। আব্বুকে দেখার জন্য ছটফট করছে।
লাজুক হাসিতে দ্যুতি ছড়িয়ে মৌমিতা বলেন- বাড়ীতে খুব সাবধানে যাবে। ওখানে গিয়ে বাইরে বের হবে না কিন্তু। বাড়ীতেই আব্বা-আম্মার কাছেই থেকো।
এত চিন্তাকরছো কেন? আমিতো নিজের গাড়ী নিয়েই যাচ্ছি। ঠিক আছে আমার রাজরাণী! আমি বাড়ীর বাইরে কোথাও যাবো না।ঢাকা থেকে সোজা বাড়ীতে যাবো আবার সোজা বাসায় ফিরে আসবো। এখন হয়েছে? আবারও একটু আদরের পরশ জড়িয়ে দিলেন স্ত্রীকে।
স্বামীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মৌমিতা যেন ক্লান্ত, শান্ত, স্নিগ্ধ, মনমাতানো পড়ন্ত বিকেল। স্বামীর বুকেই মাথা বিছিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলেন- তুমিই তো আমার সব। তোমাকে নিয়ে আমি চিন্তা করবো না তো আরেক জন এসে করবে? কন্ঠে যেন রাজ্যের অভিমান ঝরে পড়ল।
রাশেদ সাহেবের মমতা মাখানো দুটো হাত পৌঁছে যায় মৌমিতার টোল-পড়া দু'গালে। যেন বসন্তের বাগানে গোলাপের ছোঁয়ায় উন্মাতাল অথচ শান্ত মৌমাছির স্পর্শ। তারপর ভালবাসার উচ্চারণ- আর তুমি আমার মহরাণী মমতাজমহল। এই বুকের মধ্যে শুধু তুমি আর তুমি।
ভালোবাসার রঙধেনুতে দু'জনার বিচরণে নিঃস্তব্ধ হাওয়ায় যেন শান্তির প্রলেপ এঁকে দিল নতুন এক উপাখ্যান। যেখানে আদিগন্ত জুড়ে রঙবেরঙের প্রজাপতি মহাউল্লাসে উড়াউড়ি করছে। আর প্রজাপতির দুটো পাখায় রাশেদ-মৌমিতার শিহরণের অনুরণনে হলো কিছুক্ষণ বিচরণ।
সুখ-আনন্দ ভাগাভাগি শেষে বীর বেশে ফিরে এলেন রাশেদ সাহেব। বিদায় বেলায় আম্মু আর আব্বু দু'জনই আনন্দের ভেলায় ভেসে চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। মমতার হাত জোড়া রাশেদকে জড়িয়ে ধরে। আসি আব্বু- এই বলে রাশেদ সাহেব আব্বুকে সালাম করেন। তারপর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের কান্নায় নিজেকে ভাসিয়ে রাশেদ সাহেব আম্মুকেও সালাম করেন। পরম আদরের হাত দুটো সন্তানকে আঁকড়ে ধরেন আর স্নেহের দ্যুতি ছড়িয়ে বলেন- বাপজান সাবধানে থাকিস!
ছোট ভাই নিশাল আহম্মেদও নিজেকে সামলাতে পারেনি। পরম মমতায় রাশেদ সাহেব ছোটভাই নিশালকে জড়িয়ে ধরে বলেন- সবধানে থাকিস। আর আব্বু-আম্মুর দিকেও খেয়াল রাখিস।
সবার দৃষ্টি ভালোবাসা আর মমতা ছড়িয়ে তাকিয়ে আছে গাড়ির দিকে। যেখানে বসে আছে, চলে যাচ্ছে বিদায় নিয়ে ফিরে যাচ্ছে প্রিয় মানুষটি। গাড়িটি মোড়ে বাঁক নিতেই সবার দৃষ্টি সীমায় শূন্যের লাফালাফি। কাছের মানুষকে বিদায় জানিয়ে আবার ফিরে আসে নিজেদের ব্যস্ততায়।
*
ফিরে আসার দু'তিন দিন পেরিয়ে গেলে পর মৌমিতা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। যাক স্বামী আমার দিব্যি সুস্থ আছেন। ভালো আছেন। দুঃশ্চিন্তা দূর হয় মনের আকাশ থেকে। এখন আবারও নির্মল আকাশের বাতাসে চলছে রাশেদ মৌমিতার প্রজাপতি-বিচরণ।
রুটিন মাফিক মৌমিতার চেকআপ হচ্ছে। সব ঠিকঠাক। ডাক্তার আরও আশ্বস্ত করেছেন যে, নরমাল ডেলিভারী হবে। পরিচিত ডাক্তার বিধায় এই করোনার দুর্দিনেও কোন সমস্যা হচ্ছে না। সময় সময় সবকিছু ঠিকমতোই হচ্ছে। তাই অনাগত সন্তানের আগমনের জন্য তেমন চিন্তিত নন রাশেদ সাহেব। ডাক্তারের ভাষ্যে সবকিছুই চমৎকার। চিন্তার কোন কারণই নেই। ডাক্তার ভরসা দিয়ে বললেন- যাই হোক। আমি আছি। কোনরকম চিন্তা করবেন না।
করোনার ছোবলে বিশ্ব যখন টালমাটাল, এই বাংলাদেশ যখন এলোমেলো রাশেদ সাহেব কিন্তু ধীর এবং সুস্থির। পাশে ডাক্তার আছেন তাই চিন্তার কোন কারণ দেখেন না। চিকিৎসা হচ্ছে। ক্লিনিক নির্ধারণ করা আছে। টাকার অংকটাও মোটামুটি হিসাব করে রেখেছেন। অবশ্য টাকাটা সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক বেশিই লাগবে। যাই হোক চিকিৎসা তো মিলবে। রাশেদ সাহেব অবশ্য সব খবরই রাখেন। কোথায় কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে আর কীভাবে হচ্ছে। তবুও কোন চিন্তার রেশ পড়ে নি। কারণ এখনও তিনি সবকিছুতেই নিশ্চিন্তের এগিয়ে দেয়া হাতগুলোর নাগাল পাচ্ছেন।
*
পড়ন্ত শুনসান নীরব বিকেল। গাড়ির হুঁসহাস শব্দ নেই, রিক্সার অহরহ টুংটাং একেবারে কম, চারদিকের কোলাহলও বেশ নেমে এসেছে। আকাশে বেড়েছে পাখিদের আনাগোনা। এইতো বারান্দা বাগানের বৃক্ষগুলো কেমন সতেজ আর তরতরিয়ে বাড়ছে। হাতছানি দিয়ে সবসময় যেন কাছে ডাকে। বারান্দায় এসে বসলে মনটা কেমন যেন ফুরফুরে লাগে। রাশেদ-মৌমিতা পাশাপাশি বসা। ছোট্ট চায়ের টেবিলে চা আর হালকা নাস্তা। একটু আগেই কাজের মেয়েটা দিয়ে গেল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রাশেদ সাহেব মৌমিতার দিকে তাকান। মৌমিতা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দেন। চারদিক মুহূর্তেই যেন মৌ মৌ করতে থাকে। মৌমিতার স্নিগ্ধ উচ্চারণ- অমন করে কী দেখছো?
রাশেদ সাহেবের দুষ্টুমিমাখা কথা- তোমাকে আর এই মনোরম পড়ন্ত বিকেলকে। কী অসাধারণ! দেখো দেখো কত পাখি উড়ে যাচ্ছে ওদের নীড়ে। সূর্যটাও কেমন যেন ব্যস্ত গোধূলি পেরিয়ে ডুবে যেতে।
মৌমিতার হাসিমাখা মুখ থেকে কথামালা বেরিয়ে আসে- তোমার দৃষ্টি সুন্দর, মন সুন্দর তাই তোমার চোখে সব সুন্দর লাগছে।
মন্দ বলোনি!
দেখো দেখো ক্ষণিকেই আকাশের কোণে মেঘের জমজমাট আগমন!- হাত আকাশের দিকে মেলে দেন রাশেদ সাহেব।
স্বামীর হাতের ইশারায় চোখ মেলে তাকান ঈশান কোণে।সত্যিই তো অনেক মেঘ জমাট বেঁধে গেছে। মৌমিতার মনটা আনন্দে নেচে ওঠে এবং বলেন- দারুণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে মুষলধারে বৃষ্টি হবে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা। কারণ খুব একটা বাতাস বইছে না। দেখতে দেখতে নিমিষেই চারদিক অন্ধকার হয়ে এল।
মৌমিতা বলেন- ঘরে চলো। মনে হচ্ছে এখনই বৃষ্টি নামবে।
রাশেদ সাহেব খুশীর হাসি ছড়িয়ে বলেন- আহা! একটু বসো তো। তোমাকে পাশে নিয়ে অঝোরধারা বৃষ্টিস্নাত বিকেলটা একটু দেখি।
মুচকি হেসে মৌমিতা চায়ের কাপে চুমুক বসান আর বলেন- মন্দ বলো নি! বৃষ্টি দেখতে আমারও ভালো লাগে।
মুহূর্তেই ঝমঝমিয়ে মেঘ নেমে এল বৃষ্টি হয়ে। কাক-পক্ষীরা ছুটোছুটি করে আশ্রয় নিয়ে শান্ত হয়ে গেল। বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া। বেশ শীতল একটা ভাব।
বেশ কয়েকবার বৃষ্টির ঝাপটা চোখে-মুখে লাগতেই ওরা দু'জন বারান্দা ছেড়ে চলে এল। কয়েকবার কাশতে কাশতেই মৌমিতা চায়ের কাপ শেষ করল।
*
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় রাশেদ সাহেবের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠল। ড্রাইভার ফোন করেছে। এত রাতে ফোন! ভাবছিলেন রিসিভ করবেন না। কিন্তু বিরক্তিভাব নিয়েই কলটা রিসিভ করেন। কিছুক্ষণ কথা বলে বিরক্ত হয়েই ফোনটা রেখে দেন।
আগ্রহী হয়ে মৌমিতা কথা বলেন- ড্রাইভার কেন ফোন করেছিল?
রাশেদ সাহেব বেশ খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বলেন- আগামীকাল তোমাকে চেকআপ করাতে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। বুড়ো ফাজিল বলে কিনা , শরীর ভালো না। আবার অগ্রিম বেতনও চাচ্ছে।
একটু শান্ত হও। আমাদের ড্রাইভার তো সাধারণত মিথ্যা বলে না। অসুখ তো হতেও পারে। আমরা অন্য একটা ব্যবস্থা করে নেবো। তুমি এত উত্তেজিত হইয়ো না।
আরে এখন কি আর অন্য ড্রাইভার পাওয়া যাবে! প্রায় সবাই তো এখন ছুটিতে।
ঠিক আছে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। না-হয় রিক্সা করে যবো। এত চিন্তা করছো কেন? একটু শান্ত হও।
কী আর করার আছে। আবার বিকাশে টাকাও পাঠাতে বলছে।
তুমি এত চিন্তা করো না। সব ব্যবস্থা হবে।
ছোটভাই নিশালের ফোনে ঘুম ভাঙল রাশেদ সাহেবের। একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটা রেখে দিলেন। মৌমিতা ফোনটা হাতে তুলে নেন। কথা শেষ করে মৌমিতা একেবারে চুপচাপ। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করবেন কিছুই বুঝে ওঠতে পারছেন না। রাশেদ সহেবকে ডাকবেন কি ডাকবেন না দ্বিধায় আছেন। আচ্ছা একটু ঘুমুক। একটু পরই বলা যাবে। এত ভোর রাতে তো কিছুই করার নেই। চোখে আর ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ছটফট করছেন । মৌমিতার অস্থিরতা টের পেয়ে রাশেদ সাহেব চোখ মেলে তাকান। তারপর ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলেন- কি ব্যাপার মৌমিতা ঘুম আসছে না তোমার?
মৌমিতার প্রশ্ন- তোমার ঘুম হয়েছে?
ঘুম জড়ানো হাতেই রাশেদ সাহেব মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে বলেন- আরও একটু ঘুমুবো!
নিশাল একটু আগে ফোন করেছিল।
রাশেদ সাহেবের মনে পড়ল। ফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ...হ্যাঁ...আমি ইচ্ছে করেই রিসিভ করিনি।
আমি কথা বলেছি।
কেন ফোন করেছিল?
আম্মু-আব্বুর দু'জনেরই নাকি গতরাত থেকে একটানা জ্বর। সাথে আবার গলা ব্যথা আর কাশি।
শোয়া থেকে আচমকা সোজা হয়ে বসলেন রাশেদ সাহেব। কী বললে?- এই বলে মোবাইল ফোনটা নিতে যান।
মৌমিতা থামিয়ে দিয়ে বলেন- এত অস্থির হচ্ছো কেন। কথা হয়েছে আমার সাথে। দু'জনই এখন ঘুমুচ্ছে। রাতেই নাকি ডাক্তার ডেকে এনেছিল। আমরা বরং একটু পরে ফোন করি।
নাস্তা শেষে ছোট ভাই নিশালের সাথে কথা বললেন রাশেদ সাহেব। সব বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কী করতে হবে। বিকাশে কিছু টাকাও পাঠালেন। সকালে আবার ড্রাইভারের ছেলে ফোন করল। তার অবস্থাও দ্রুতগতিতে খারাপ হয়ে গেল। জ্বর একেবারেই কমছে না। সাথে কাশি আর গলাব্যথা ক্রমশঃ বাড়ছে।
বয়স্ক লোক তাই তিনদিন ধরেই জ্বরটা গোপন রেখেছেন চাকুরি হারানোর ভয়ে। এদিকে আবার স্ত্রী রীতিমত বেতন পাচ্ছে না। গার্মেন্টসের চাকুরি। গার্মেন্টসটা মাঝারি আকারের, কোনমতে টিকে আছে, যেকোন মুহূর্তে চাকুরি নাও থাকতে পারে। তাই ড্রাইভারের ছেলের আরজির জন্য পুরো মাসের বেতনের সাথে আরও কিছু টাকা বিকাশে পাঠালেন।স্বচ্ছ আকাশের মতই রাশেদের পৃথিবীটা যেন আচমকাই অন্ধকার হয়ে আসছে।
দুপুরের খাওয়া শেষে রাশেদ-মৌমিতা একটু ভাত-ঘুমের চেষ্টা করছিলেন। তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটিয়ে তাকিয়ে দেখেন রাশেদ পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে ড্রইং রুমে চলে এলেন। সোফায় অর্ধশোয়া আর দু'হাত কপালের উপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা। মৌমিতা এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত রাখতেই রাশেদ চিৎকার করে ওঠলেন- একি! তোমার হাত এত গরম।
মৌমিতা শান্ত কন্ঠেই বললেন- কই, না তো!
রাশেদ সাহেব মৌমিতার কপালে হাত রাখেন- এইতো তোমার শরীর গরম গরম লাগছে। দৌঁড়ে গিয়ে থার্মোমিটার নিয়ে আসেন। তাপমাত্রা মাপেন ১০০ ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই। রাশেদ সাহেবের মাথা খারাপ অবস্থা। মোবাইল ফোনটা আবার বেজে ওঠল। ছোট ভাই নিশালের ফোন। ফোন রিসিভ করেই রাশেদ সাহেব হাঁউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
মৌমিতা হতবাক। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলেন- রাশেদ কী হয়েছে?
আমার সব শেষ মৌমিতা ! আমার সব শেষ।– এই বলে রাশেদ সাহেব শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। দু'চোখ বেয়ে অশ্রুধারা অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে।
মৌমিতা নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে বলেন- আম্মু-আব্বুর কিছু...!
নেই...নেই...আমার সব শেষ!
মৌমিতা নির্বাক, নিঃস্তব্ধ! কোন কথাই আর উচ্চারণ করতে পারছেন না। একেবারে হতবিহ্বল। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নিশালকে ফোন করলেন।
নিশাল ফোন রিসিভ করে শুধু কেঁদেই চলেছে। ভাবী...! আম্মু-আব্বুর কোন চিকিৎসাই করতে পারিননি। কোন ডাক্তারই আনতে পারিনি। এর আগেই সব শেষ!
মৌমিতা বাকরুদ্ধ।
নিশাল অপর প্রান্ত থেকে বলেই চলে- ভাবী ভাইকে বলো কিছু একটা করতে। লাশ নিয়ে বসে আছি কেউ এগিয়ে আসছে না। কীভাবে জানাযা পড়াবো, দাফন করবো? আমিতো একা। ধরতেও ভীষণ ভয় পাচ্ছি। যদি আবার আমারও...!- এই বলে নিশাল থেমে যায়। আর কোন কথা বলতে পারেনি।
সময়ের বাস্তবতায় হামাগুড়ি দিয়ে রাশেদ সাহেব শান্ত হন। নিজেকে সামলে নিয়ে একবার মৌমিতার দিকে তাকান আবার উপরে অদৃশ্য কারও দিকে। আবার চোখ জোড়া নীচে নামিয়ে আনেন। শান্ত চোখ জোড়া মেলে ধরেন মৌমিতার কোলে। মৌমিতা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন- আগে আম্মু-আব্বুর লাশ দাফনের ব্যবস্থা কর।
রাশেদ সাহেব একের পর এক ফোন করছেন এলাকার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত, বন্ধুদের। কেউ ফোন রিসিভ করে নি। আহত হৃদয়ের বুকের ভেতর ভাঁজে ভাঁজে কঠিন পাথর যেন থরে থরে স্তূপীকৃত হচ্ছে। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস যেন আরও কঠিন হয়ে আসছে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান। রাশেদ সাহেব মানসিকভাবে দুমড়ে-মুচড়ে একেবারে একাকার। ফোনটা মৌমিতা হাতে নিয়ে ফোন করেন। নিশালের জবাব- ভাবী আমি নিরুপায়। কেউ এগিয়ে আসছে না। আবার আমাকেও কোথাও বের হতে দিচ্ছে না। পুরো আইসোলেশনে আছি।
মৌমিতার কন্ঠ থেকে কষ্টের উচ্চারণ- কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর আর বর্বর মানুষ আমরা!- তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে রাশেদ সাহেবকে বলেন- তুমি এক কাজ কর।
রাশেদ সাহেব অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকান।
তোমার এস. পি. বন্ধু নিজামের সাথে কথা বল।
হঠাৎ যেন একটু কূল ফিরে পেলেন। ছোঁ মেরে মোবাইল ফোনটা নিয়ে বন্ধুকে ফোন করেন। বন্ধু নিজাম আশ্বস্ত করেন যে, কোন চিন্তা করতে হবে না। বাড়ির দিকটা সামলে দিবেন। জানাযা আর দাফনের সব ব্যবস্থা করবেন। অবশ্য কথামতো সবই হয়েছে। থানা থেকে পুলিশ পাঠিয়েছেন। পুলিশের সদস্যরাই জানাযা সম্পন্ন করে দাফন করেছেন। গ্রামের একটি মানুষকেও পাশে পাওয়া যায়নি। এমন কি ছেলে নিশালও মা-বাবার লাশ ছুঁয়ে দেখেনি। পুলিশ সদস্যরাই শেষ গোসল দিয়েছেন।
এইতো দু'দিন আগের ঘটনা। বিজন সরকারের লাশ ঘরের ভেতরই পড়েছিল। ঘরভর্তি মানুষ ছিল অথচ লাশটি নিঃসঙ্গ। কেউ ছুঁয়েও দেখে নি। শুধু লাশের পাশে স্ত্রী লতা সরকার। চোখের জলে সভ্যতা ভাসিয়েছেন। ছেলের পায়ে ধরেছেন। সংসারের মায়ায় আবদ্ধ ছেলে স্ত্রী-সন্তানের চিন্তা মাথায় রেখেই এগিয়ে আসেনি। সবাই নিজেকে নিয়ে নিজের মধ্যে অতীব গহীনে ডুবে আছে। কেউ এগিয়ে আসেনি। এর আগে কখনও কেউ টের পায় নি মৃত্যু নামের যমকে। মৃত্যু যে এত ভয়ঙ্কর তা কেউ টের পায়নি অথবা বুঝতেও চেষ্টা করেনি। এখন পুত্র-কন্যারা সব গায়েব।
রাত গড়িয়ে সকাল। সকাল পেরিয়ে দুপুর।দুপুর শেষে বিকেল কেউ এগিয়ে আসেনি লাশ দাহ করতে। অথচ সচরাচর মরার পর পড়শীদের ঘুম হারাম। লাশ বাসি হতে দিতে নেই। তাড়াতাড়ি দাহ কর। আহা! একি করছো, লাশ এখনও ঘরের বাঁধের ভেতর? জলদি বের কর। আরও কত হাজার প্রলাপ। কই এখন কেউ তো এল না। লতার চোখের জলে নদী হয়। যে নদীর গর্ভ বেয়েই সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল।আজ সেই চোখের জলের নদীর ভেতর সকল সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অবশেষে বাতাসে বাতাসে ভেসে খবরটা থানার দারোগা সাহেবের কাছে পৌঁছায়। তারপর তিনিই নিজ উদ্যোগে শশ্বানে লাশ নিয়ে যান। মুখাগ্নি করেন । শব দাহ করেন।
*
রাশেদ আহম্মেদের বিষাদগ্রস্ত অবয়ব যেন বর্তমান পৃথিবীর মানচিত্র। তবুও মনের ভেতর জোর চেষ্ঠা টিকে থাকার। চিন্তিত মনে ভাবছেন স্ত্রী মৌমিতা আর অনাগত সন্তানের কথা। ফাঁকে ফাঁকে মুহূর্তে মনের ভেতর হামলে পড়ছে মা-বাবা হারানোর ব্যথাতুর সময়গুলো। ফোনটা বেজে ওঠতেই আঁতকে ওঠলেন রাশেদ সাহেব। ইউনুস ড্রাইভারের ফোন। রাশেদ সাহেব ফোনটা ধরেই একটু রাগান্বিত হয়েই বলেন- আবার কেন?
আমি এস আই রফিক বলছি। কদমতলী বস্তি থেকে।
জ্বি, কী বললেন ? কিন্তু এটা তো আমার ড্রাইভারের নম্বর।
অপরপ্রান্ত থেকে আবার বলেন- সম্ভবতঃ আপনার ড্রাইভারই হবে। লাশের পাশেই মোবাইলটা পড়েছিল।
কী বললেন!- রাশেদ সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
আপনাকে একটু কষ্ট করে আসতে হবে। কারণ লাশের পাশে কেউ নেই।
কেন ওর স্ত্রী-সন্তান আছে তো।
না স্যার, পাশে কেউ নেই। সেই দুপুর থেকে নাকি লাশ পড়ে আছে।
রশীদ সাহেব নিরুপায় হয়ে সব বুঝিয়ে বললেন এস আই রফিককে। কাছে হলেও কথা ছিল। এই সন্ধ্যায় উত্তরা থেকে কদমতলী যাওয়া কোনমতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া স্ত্রীও অসুস্থ। এই মুহূ্র্তে কোনমতেই সম্ভব নয়। এস আই রফিক ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন- তবে স্যার, আমরা লাশের জানাজা, দাফন করে ফেলি।
রাশেদ সাহেবের নিরুত্তাপ উত্তর- জ্বী করেন। অনেক ধন্যবাদ।
রাশেদ সাহেব এখন আছেন ঝড়ের মাঝে মাঝ সমুদ্রে সহায়হীন যাত্রী।বসে আছেন একাকী এক খেয়ায়। সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। কোন কূল কিনার নেই। অবলম্বন নেই। দিশাহীন অসহায় এক যাত্রী। শুধু সূতোর টানে বেঁধে আছে স্ত্রী মৌমিতা আর অনাগত সন্তানের পদধ্বনি। অল্প কয়েকটা দিন বাকি সন্তান পৃথিবীর বুকে চিৎকার করে আগামীর বার্তা জানাবে। অথচ সাজানো-গুছনো সব আয়োজন মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড। মৌমিতার জ্বর-কাশির কোনটাই কমছে না। কাশিটা কম হলেও গলায় তীব্র ব্যথা। কিন্তু স্বামীর কাছে পুরোটা প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন না। রাশেদ সাহেব পরীক্ষা করাতেও সাহস পাচ্ছেন না , করোনা পজিটিভ এসে যায় কি-না সেই ভয়ে। গভীর খাদের কিনারে দণ্ডায়মান সমস্যায় ঝুলে আছেন রাশেদ সাহেব। নড়াচড়ার কোন উপায় নেই ; সামনে-পেছনে-বামে-ডানে শুধু গহীন খাদ। সাহসের ওপর ভর করে নিজেই সিদ্বান্ত নিলেন পরীক্ষাও করাবেন না ডাক্তারের কাছেও যাওয়ার চেষ্ঠা করবেন না। ডাক্তারের কাছে ফোনে ফোনে জেনে উপসর্গভিত্তিক ঔষধ খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু কোনরকম পরিবর্তন বা উন্নতি হচ্ছে না। উপায়ান্তর না দেখে অনেক চেষ্টা তদবির করে স্ত্রীকে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করালেন।
হাসপাতালের দোতলায় কেবিনে ভর্তি। বারান্দায় পায়চারি করছেন রাশেদ সাহেব। মাঝে মাঝে নীচের জটলায় তাকাচ্ছেন। মানুষজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। হাসপাতালে সব রোগী ভর্তি করাচ্ছেন না বা সবার চিকিৎসা করছেন না। অনেকেই এসে এসে ফিরে যাচ্ছে। আবার অনেকের সাথে বচসা হচ্ছে। কেউ হয়ত অন্য হাসপাতালের দরজায় কড়া নাড়ছে। অথবা আবার এগিয়ে চলা অন্য হাসপাতালের প্রত্যাশায়। হয়ত অবশেষে ভর্তির ব্যবস্থা অথবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। কানে কানে সব কথা সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ছে। রাশেদ সাহেব নিজেকে এক্ষেত্রে ভাগ্যবানই মনে করছেন। স্ত্রী গর্ভবতী। তাই সরাসরি প্রসূতি বিভাগে। অবশ্য অনেক উপর থেকে তদবির করাতে হয়েছে।
একজন ব্রাদার এসে ডাকলেন- স্যার আপনাকে একটু আসতে হবে।
কোন কথা না বলে রাশেদ সাহেব ব্রাদারের পিছু পিছু গেলেন। ডাক্তারের চেম্বারের পাশে যেতেই বসতে বললেন।
তারপর ডাক্তার বললেন- আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো আনানোর ব্যবস্থা করুন। আর আমরা সাসপেক্ট করছি আপনার রোগী সম্ভবত করোনায় আক্রান্ত। টেষ্টের জন্য স্যাম্পল পাঠিয়েছি। রিপোর্ট পেতে একটু সময় লাগবে।। তবে ভালো সংবাদ আপনাদের বেবি বেশ ভালো আছে। সম্ভবতঃ নরমাল ডেলিভারি হবে।
রাশেদ সাহেব নিরুত্তর। শুধু চোখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আর বললেন- তাহলে আমি ঔষধগুলো নিয়ে আসি।
ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন- জ্বী, একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন।
নীচ তলার ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে পৌঁছে দিয়ে আবার বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলেন। সেকেন্ড যায়...মিনিট যায়...ঘন্টা যায়...রাশেদ সাহেবের কাল পরিক্রমা- কাল থেকে মহাকালে যেন যাত্রা শুরু। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে চুপচাপ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেয়ালে হালকা হেলান দেন। চোখ জোড়া গাছপালা পেরিয়ে সুদূর আকাশে।সপ্তর্ষি মণ্ডলে স্থির তাকিয়ে রইলেন। অবসাদ যেন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে সময়ের চলমান স্রোতকে। আর ভাবনার জালে সীমাবদ্ধ চলাচলে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
*
মৌমিতা আহম্মেদ সুখের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখন হাসপাতলের বেডে সন্তান প্রসবের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। এই সীমাহীন অসহ্য ব্যথা প্রতিটা নারীই নাকি হাসি মুখে সহ্য করেন। মাতৃত্বের স্বাদে এই ব্যথা হালকা কর্পূরের মতো মন থেকে উবে যায় যখন চোখের সামনে সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকে তার নরম বুকে আলতো করে শুয়ে দেয়া হয়। তখন পৃথিবীর সকল সুখ ছড়িয়ে পড়ে মায়ের স্ব্গীয় হাসিতে।
প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছেন, অনাগত সন্তানের কথা ভাবছেন, স্বামীর কথা ভাবছেন আবার অজান্তে নিজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন মৌমিতা আহম্মেদ। আর ডাক্তার-নার্স প্রাণান্তকর চেষ্ঠা করছেন বাচ্চাটা যেন সুস্থ মতে পৃথিবীর আলো দেখে।
ডাক্তারের হাতে করোনার রিপোর্ট এসে গেছে। পরীক্ষার জন্য দু'বার নমুনা দেয়া হয়েছিল। দুটো রিপোর্টই করোনা পজিটিভ। রিপোর্ট জানার পর সবার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সবার মাঝে আতংক ! করোনা রোগীকে নিয়ে এতক্ষণ এত ঘাটাঘাটি! এক পা দু'পা করে সবাই পিছিয়ে আসছে ক্রমশঃ। আর প্রসব ব্যথার যন্ত্রণায় মৌমিতার অন্তরাত্মা সাহায্যের হাতের স্পর্শ পেতে ছটফট করছে। উদভ্রান্ত ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখছেন ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাওয়া ডাক্তারদের।কেউ কাছে নেই। সেকন্ড...মিনিট...এক...দুই..চলল সময়ের চাকা। আর পাশাপাশি মৌমিতার যন্ত্রণার পায়রা উড়ছে মহাকালের গহ্বরে শান্তির আশায়।
শিশুর আর্তচিৎকারে প্রসূতিঘর কম্পিত হতেই সবার সম্বিৎ ফিরে এল। আচমকা কয়েকজোড়া চোখ একবার সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখছে আবার প্রসূতি মায়ের রণক্লান্ত শান্ত মুখটির দিকে তাকাচ্ছে। সবাই হতভম্ভ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বুদ্ধি-জ্ঞান-চলন সবই যেন মহাকর্ষের টানে স্থির হয়ে আছে। শিশুটি অনবরত হাত-পা নাড়ছে আর সজোরে চিৎকার করছে। মায়ের নাড়ী থেকে এখনও মুক্তি পায় নি শিশুটি। রক্তাক্ত দুই ঊরুর মাঝখানে হাত-পা নাড়ছে আর চিৎকার করে আগমনী বার্তা পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে দিচ্ছে। আকাশে বাতাসে পৌঁছে গেছে নবাগত শিশুর চিৎকার। কিন্তু আগমন এখনও হয় নি। মায়ের রক্তে স্নাত শরীর এখনও লুটোপুটি খাচ্ছে আর সন্তানের নাড়ি মায়ের গর্ভের সাথে এখনও এঁটে আছে।
কাছে যাবে কি যাবে না এই দ্বিধাদ্বন্ধে ঝুলে আছে সবাই। অবশেষে একজন পিপিই ঠিকঠাক মতো পরিধান করে সাহসে ভর করে এগিয়ে গেলেন। নাড়ি কেটে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর গায়ে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করলেন। শিশুটি একনাগারে কেঁদেই যাচ্ছে। যে কান্না শোনার জন্য মানবজাতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অপেক্ষায় থাকে সুখের আলোয়ান মনের ভেতর জড়িয়ে। অথচ আজকের এই কান্না সবার চোখে অশ্রুধারা বইয়ে দিল। যখনই চোখ গেল মায়ের দিকে সবাই নিঃস্তব্ধ ও নির্বাক। মা মৌমিতা আর অপেক্ষায় নেই সন্তানের কান্না শোনার জন্য, অপেক্ষায় নেই সন্তানের চিৎকারে নিজের কষ্টের আনন্দগুলো লুটিয়ে দিতে। চোখ জোড়া শান্ত, স্থির, নিঃশ্বাস পড়ছে না। শুধু ঠোঁটের কোণে লেপটে আছে কষ্টের ইতিহাস। সন্তানকে মায়ের কোলে দিতে গিয়েও ডাক্তার আচমকা পিছিয়ে এলেন। করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলে বিপদের সম্ভাবনা। মৌমিতা এখন আর মা নন। করোনায় মৃত লাশ। বাচ্চাকে এভাবে সংস্পর্শে নেয়া ঠিক হবে না।
শিশুটির চিৎকারে চিৎকরে চারপাশ প্রকম্পিত হচ্ছে। আর কম্পিত হচ্ছে সব ডাক্তার আর নার্সদের হৃদয়ের প্রকোষ্ঠ। সবার কন্ঠ যেন বাষ্পরুদ্ধ। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কোন উচ্চারণ কারও মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে না। কষ্টের ভাষাগুলো চোখের জলে ভেসে ভেসে মেঝেতে গড়াচ্ছে। আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হচ্ছে বাতাসের প্রাণ। ভূমিষ্ঠ হওয়া এই শিশুটি তো আর কোনদিন মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখবে না, দেখবে না মায়ের পদচারণা এই পৃথিবীর বুকে।
ব্রাদার ফিরে এসে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন- স্যার, বাচ্চাটি বড়ই হতভাগ্য! জন্মের সাথে সাথে মা-বাবার নিঃশ্বাসে ওম নিতে পারেনি।
সবাই অবাক হয়ে তাকান এবং সবার দৃষ্টি জুড়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
ভদ্রলোকও বোধহয় নেই। বারান্দার মেঝেতে পড়ে আছে। আমি দেখেছি কোন শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। শরীরটা নিথর পড়ে আছে।
শিশু, মা, বাবা তিনজনকেই পিপিই দ্বারা সুরক্ষিত করা হলো চিরবিদায়ের জন্য মহামিলনের প্রত্যাশায়। শিশুটিকে ধরে মায়ের গালে গাল ছুঁয়ে দিল। আশ্চর্য, কান্নার চিৎকার থামিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। এই সবচেয়ে ছোট সাক্ষাৎ আর দীর্ঘতম শাস্তির মুহূর্তে। মা মৌমিতা কষ্টের সিঁড়ি বেয়ে যেন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর শিশুটি চিৎকারে নাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা দুষ্ট প্রেতাত্মার আবাসভূমিকে। চিৎকার ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় কোণায়। এই প্রতিধ্বনি বিশ্বের বুকে ধ্রুপদি নৃত্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জানান দিচ্ছে মানবিকতার ঠুনকো অহংকারের দেবদূতকে।
শেষ