একাকি এবং অতঃপর
▪পার্থসারথি
*
ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই হাজী আহম্মদ মিয়া রোজকার মতো বিছানা ছাড়েন। তিনি পারতঃপক্ষে নামাজ কখনও বাদ দেন না। ঘুম থেকে উঠেই বদনার পানি নিয়ে বারান্দায় অজু করতে বসলেন। এক বদনা পানি সবসময় রাখা থাকে অজু করার জন্য। বান্ধা গোমস্তা আক্কেল আলী বদনা ভ'রে পানি রাখতে কখনও ভুল করে না। ভুল হলে হাজী সাহেবের কটু কথা আর চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয়। হাজী সাহেব অজু করার সময় অন্যসব কাজ মন থেকে পুরোপুরি বন্ধ রাখেন। এমনকি আশেপাশে পর্যন্ত তাকান না। অজুটা সবসময় বেশ ভালোভাবেই করেন। ফজরের নামাজটা পড়লে মন এবং প্রাণ সত্যিই মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মনের ভেতর-জগৎ শান্তিতে থাকে ভরপুর। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। সত্যি বলতে কী ভোরের আলো, বাতাস, পাখির সুর আরও নানান জানা-অজানা সুরের মোহনায় মনটা থাকে বেশ ফুরফুরে। এবং পৃথিবীটাকে মনে হয় ক্ষণিকের বেহেস্ত। অজু শেষ করে হাজী আহম্মদ মিয়া পা বাড়ালেন মসজিদের উদ্দ্যেশে। না, কয়েক কদম এগোতেই মনটা খচখচ করতে লাগলো। ভোরের সব সুরইতো কানে বাজলো কিন্তু একটা আওয়াজ মনে হয় আজ কানে এসে পৌঁছায়নি। তিনি আবার ফিরে এলেন। উঠান পেরিয়ে ঘরের পশ্চিম কোণের বারান্দার দিকে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন। একটু দূর থেকে তিনি বুঝতে পারলেন জায়গাটা ফাঁকা। কোন শব্দ নেই... বুকটা দুরু দুরু করতে লাগলো। এই শীতের প্রকোপেও বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে এখন। পা ফেলে এগোতেও যেন বেশ কষ্ট হচ্ছে। খোলা-খুপড়ি ঘরের কাছে এসেই তিনি জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলেন। কোনমতে শুধু একটু উচ্চারণ করলেন- আক্কেল! আক্কেল আলী, এদিকে আয় তাড়াতাড়ি। আর কোন কথা বলতে পারছেন না। বাঁশের বেড়াটা ধরে কোনমতে নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আক্কেল আলী গভীর ঘুমের ঘোরে সম্ভবতঃ ডাকটি শুনতে পায়নি। হাজী আহম্মদ মিয়া নির্বাক, নিশ্চল আর দৃষ্টি শূন্য ও একাকি।
একমাত্র পুত্র সন্তান আদর আলী অসুস্থ প্রায় বছর পাঁচেক, অসুস্থতা দিনকে দিন গাঢ় হচ্ছে। অনেক কবিরাজ, ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু কোনরকম উন্নতি বা সুস্থ হয়নি। এখন সে বদ্ধ পাগল। মা-বাবা কাউকে চিনে না। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কথা বলে, ক্ষণে হাসে আবার একা একাই কান্নায় মেতে ওঠে। বেশির ভাগ সময় বেশ চুপচাপই থাকে। তবে মাঝে-মধ্যে একেবারে চরম উগ্র হয়ে ওঠে। আবার তেড়ে আসে মারধোর করতে। গরমকালে কিছুটা কম থাকলেও শীতকালে একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে ওঠে। ওর মনের বিরুদ্ধে কিছুই করানো যায় না। ইচ্ছে হলে গোসল করবে, কাপড় বদলাবে, খাবে। আবার এমনও সময় যায় সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সে গোসল পর্যন্ত করে না। আর খাবারের ব্যাপারেও তেমন কোন আগ্রহ নেই। তবে একবার খাওয়া শুরু করলে গোটা পাঁচেক লোকের খাবার সে একা খায়। অনেক সময় নিজের বিষ্ঠাতেই আবার নিজেকে মাখিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে। এ ছেলের অসুস্থতার জন্য হাজী আহম্মদ সাহেবের সকল সুখই এখন বৃথা মনে হয়। সবকিছু থেকেও এখন যেন কিছুই নেই; চারদিকে শুধু শূন্যতা দেখেন। শূন্যতায় ঘিরে আছে চতুর্দিকে। প্রথম প্রথম ছেলেটার জন্য সব জায়গায় গিয়েছেন- কবিরাজ দেখিয়েছেন, ডাক্তার দেখিয়েছেন; যে যখন যা বলেছে সবই করেছেন। কিন্তু সবকিছু বৃথা করে দিয়ে আদরের সন্তান এখন বদ্দ উন্মাদ। এখন ঘরের ভেতরও রাখার কোন উপায় নেই। ঘরের বারান্দার কোণে শক্ত বাঁশের খুটি গেঁড়ে গেঁড়ে খোঁয়ারের মতো একখান ঘর বানিয়েছেন। চারদিকে বাঁশের বেড়া। পায়ে লোহার শেকল পরানো এবং শেকল পরানো অবস্থায় একটা শক্ত খুঁটিতে বাঁধা থাকে সবসময়। বলাতো যায় না, কখন বেরিয়ে আবার লাপাত্তা হয়ে যায়। উন্মাদ হোক আর যা'ই হোক না কেন, সন্তান তো! মা সোহাগী বেগম সোহাগের চাদরে সবসময় ঢেকে রাখেন আদরের একমাত্র সন্তান আদর আলীকে। শুধু কাছে ডেকে এনে একটু আদর করতে পারেন না। কিন্তু আদরে, সোহাগে আর ভালোবাসায় আবদ্ধ রাখেন- সারাদিনের নিত্য-কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছেলের খোঁজ ঠিক ঠিকই রাখেন। ছেলেকে একপলক না দেখলে চোখের ঘুম আলগা হয়ে আসে। চুপি চুপি এগিয়ে যান ছেলেকে একটু দেখতে। তিনি অপলক তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু ছেলে আদর আলী নিজের ভুবনে সর্বক্ষণ ব্যস্ত। হঠাৎ মায়ের দিকে তাকালেও দৃষ্টিটা থাকে অর্থশূন্য। নিজের দিকে এক পলক তাকালেই মা সোহাগী বেগম বেশ আপ্লুত হয়ে ওঠেন। কষ্টকর সুখগুলো মনের ভেতর ঢেউ খেলেই মুহূর্তে উবে যায়। কখনও হয়তোবা ভাতের থালা হাতে সন্তানের কাছে এগিয়ে যান- কোনদিন গোগ্রাসে গিলে খায় আবার কোনদিন মায়ের মাথায় ঢেলে হাসতে হাসতে নিজে নিজেই কুটিকুটি হয়ে যায়। মায়ের মন বড়ই অদ্ভুত- সব বাঁধা ডিঙিয়ে ছেলেকে আদর করতে যান। আদর আলী কোন কোন দিন মায়ের আদরে নির্বাক থাকে, কোনদিন অট্টহাসিতে চারদিক কাঁপিয়ে তোলে আবার কোনদিন হাতটা টেনে ধরে কামড়ে দেয়। মা সোহাগী বেগমের হাতে উন্মাদ সন্তান আদর আলীর কামড়ের শতশত দাগ দগদগে হয়ে আছে। তবে আদর আলী কখনও মাকে তেড়ে মারতে আসে না। বাবা হাজী আহম্মদ মিয়া কিংবা গোমস্তা আক্কেল আলী বেশ কয়েকবার আক্রমনের শিকার হয়েছে। তারপর থেকেই শেকলবন্দী আদর আলী।
কতক্ষণ পরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আর ভাবেন ফেলে আসা সুখের দিনগুলোর কথা। হাজী সাহেবের কোন কিছুরই কমতি নেই- ঘর-সংসার, অর্থ-কড়ি, মান-সম্মান, সহায়-সম্পদ সবই কানায় কানায় পরিপূর্ণ। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেহেস্ততুল্য সংসার বানিয়েছেন তিনি। শুধু ছেলেটা লেখাপড়ায় একটু নড়বড়ে। প্রতিবছরই কোনমতে উৎরে যায়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র আদর আলীর কদর। হাজী সাহেবের ছেলে বলে কথা। কিন্তু শুধুমাত্র স্কুলের গণ্ডীতেই ওর তেমন পাত্তা নেই। সবাই ওকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। সে বুঝতে পারে লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয় বলেই এমনটা। ওর সবই ভালো লাগে শুধু লেখাপড়াটাই বোঝা বোঝা মনে হয়। এ ব্যাপারে হাজী সাহেবের তেমন মাথা ব্যথা নেই। তার এক কথা- বাছাধন, কোনমতে পাশ দিয়ে যাও।আমারতো কোনকিছুর অভাব নেই। তোমার জন্য সবকিছু রেখে যাচ্ছি- বলতে পারো বিশাল রাজত্ব! তুমি রাজার হালে চলবে। শুধু সবার সাথে তাল মিলিয়ে লেখাপড়াটা একটু চালিয়ে যাও। কিন্তু ছেলে আদর আলী বেঁকে বসলো- তাকে ক্লাসে প্রথম হতেই হবে। আব্বাজানের উত্তর- তাহলে তো চমৎকার! লেখাপড়াটা ভালো করে চালিয়ে যাও।
না, আব্বাজান! আমার লেখাপড়া একদম ভালো লাগে না।
তাহলে?- প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে হাজী সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
আমার জন্যে তুমি আলাদা একটা স্কুল বানিয়ে দাও। তাহলেই চলবে।
ছেলের বুদ্ধিতে হাজী সাহেবতো একেবারে থ মেরে গেলেন। কিন্তু তাই বলে আলাদা একটা স্কুল!
হ্যাঁ আব্বাজান! আলাদা একটা স্কুল। আর আমার ক্লাসে আমি একা এবং প্রথম থাকবো সবসময়।
দুঃশ্চিন্তার বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে হাজী সাহেবের কপাল জুড়ে- আলাদা স্কুল! একি সহজ ব্যাপার! তাছাড়া এতএত টাকাকড়ির দরকার।
ছেলে নাছোড়বান্দা। তার এক কথা আলাদা একটা স্কুল চাই।– এই বলেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে বসে আছে আদর আলী। দিন যায় ছেলের রাগ আর অভিমান ধীরে ধীরে পোক্ত হতে থাকে। বাড়তে বাড়তে রাগ আর অভিমান একসময় পাহাড়সম হয়। দিনকে দিন আদর আলীর জেদ তীব্রতর হতে থাকে। অতঃপর হাজী সাহেব নিরুপায় হরিণীর মতো ছেলের কথা ভেবেই নিজের জমির উপর গড়ে তুললেন একটা স্কুল। নামটাও রাখলেন বেশ সুন্দর- সোহাগী বেগম উচ্চ বিদ্যালয়।
মুকুটহীন রাজার মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হলো। ছেলের জন্য একেবারে আলাদা একটা পূর্ণাঙ্গ স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। যদিও ছেলের জীবন থেকে একটি বৎসর হারিয়ে গেছে চিরতরে। এ নিয়ে হাজী সাহেব কিংবা তার ছেলের কোনরকম আপসোস বোধ নেই। এখন উঠতে-বসতে তৃপ্তির ঢেকুড় তুলেন। স্কুল আছে, শিক্ষক আছে শুধু ছাত্র-ছাত্রীই নেই। পুরো স্কুল জুড়ে হাজী সাহেবের একমাত্র পুত্র আদর আলী। ছেলেতো বেজায় খুশী ক্লাসে সে একা এবং রোল ১ অর্থাৎ ক্লাসে প্রথম। সে এখন এক নম্বর ছাত্র। শিক্ষকরাও ওকে নিয়ে মাতোয়ারা। হাজী সাহেব কপাল কুচকান- এখনও কোন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হলো না!
প্রধান শিক্ষকের জবাব- ওসব নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। মাত্রতো স্কুলটা খুললেন।
কিন্তু!- হাজী সাহেব বেশ চিন্তিত হয়েই তাকান প্রধান শিক্ষকের দিকে।
আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সব সামলে নেবো। খাতা-কলমে ছাত্র-ছাত্রী লিখে নেবো। আর সময় হলেই দেখবেন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী এসে যাবে।
ঠিক আছে।– হাজী সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আর মনে মনে শান্তির নিঃশ্বাসে ডুবে থাকেন। কারণ ছেলে তার বেজায় খুশী।
এক স্কুল, এক ছাত্র, এক বলয় আর এক পৃথিবী!- আদর আলীর ভালোলাগা দিনকে দিন আলগা হ'তে লাগলো। একাকি আর ভালো লাগে না। একা একা আর কতক্ষণ! ফেলে আসা স্মৃতিরা মনের ভেতর তাড়া করে বেড়ায়। একা একা একক সময় বড্ড বিরক্তি ধরে আসছে।আদর আলীর ভেতরকার মানুষটা একা একা গুমড়ে কাঁদে। একা একা কি মানুষে মানায়? কখনও না। ভালো থাকতে ভালো রাখতে হয় সকলকে, আর সকলকে নিয়েই মানুষের মানব জীবন। ঠিক আছে তোমাকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাবো।– এইতো প্রতিযোগিতার জীবন, মানবের জীবন। কিন্তু সবকিছু ঠেলে ফেলে আড়াল করে একাকি জীবন কখনও মানব জীবন হতে পারে না। তুমি আমার উঠানে খেলবে, হাসবে, হাঁটবে অথবা নাচবে আর আমিও তোমার উঠান চষে বেড়াবো একইভাবে। তবেইতো উভয় ভুবন আলোকিত হবে। আমার সুখ-দুঃখ তোমার সাথে ভাগাভাগি করে জীবন কাটাবো ঠিক তুমিও তাই। নতুবা দুঃখের সাগরে উভয়েই তীরহারা একাকি পথিক। মনের সুখ-দুঃখের কোন ভাগীদার নেই তো জীবনটা কখনও মানবের হতে পারে না। চাঁদ, তারা, সূর্য অথবা পৃথিবী আলাদা আলাদা হয়েও কোনটা একাকি নয়। আকাশে একলা চাঁদ, তবে আলো বিলায় সকলের তরে। তাইতো তারারা মিটিমিটি হাসে। সূর্যের আলোও এত মূল্যবান যে, সে একাকি হয়েও নিজে জ্বলে পৃথিবী আলোকিত করে। আর প্রাণ সঞ্চার করে প্রতিটি মুহূর্তকে। কেউতো শুধু নিজের জন্য একাকি থাকে না। চক্ষু মেলে দেখলেই বুঝা যায় পশুজীবনও একাকি জীবন নয়। হাজী আহম্মদ মিয়া এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন; একা একা ভালো থাকতে গিয়ে সবকিছুই এখন অর্থহীন। ছেলেটা কেমন যেন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। এখন কারো সঙ্গই সে পছন্দ করে না। তার এখন কোন কিছুই পছন্দ নয়। একাকি একলা সময় একলা জীবন এলোমেলো কাটে সর্বক্ষণ।ভীষণ নীরব এই একাকি ভুবন। সংসারের কোন মায়াই এখন ওর মনে আঁচড় কাটে না- না ভালো না মন্দ। সারাক্ষণ একা একাই নিজের সাথে প্রলাপ চলে। পাখির গান, গোধূলীর সোনালী আকাশ, জোছনায় চাঁদের আলোর রূপালী ঝিকিমিকি কোন কিছুই এখন আর আদর আলীকে স্পর্শ করে না। একাকি থাকতে থাকতে একাকীত্বই এখন ওর নিত্যসঙ্গী। নিত্যসঙ্গী জীবনহীন জীবন। সোহাগী বেগমও টের পাচ্ছেন উনাদের ছেলে আর নিজের মধ্যে নেই। দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে এক অজানা জগতের অন্ধকারের মহাসাগরে। সর্বক্ষণ একা একা নিজের সাথেই নিজে কথা বলে। স্বাভাবিক জীবন ভেঙে এক অস্বাভাবিক ছন্দহারা জীবনে আটকে গিয়েছে। আদর আলীর বাবা-মা এখন দিশেহারা; ছেলেটা দেখতে দেখতে চোখের সামনেই এক অন্যজগতের বাসিন্দা হয়ে গেল। যেখানে মানুষের জীবনের কোন স্বাভাবিকতা নেই এবং জীবনবোধের কোন মানেও নেই। দেখতে দেখতে ছেলেটা আটকে গেল এক শেকলবন্দী অর্থহীন জীবনে। তবুও এতদিন চোখের সীমানায় ছিল। এখন কোথায় গেল কে জানে! নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে হাজী সাহেব আবার ডাকলেন- আক্কেল আলী, তাড়াতাড়ি আয়! আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!- এবার বেশ চিৎকার করেই বেশ জোরে ডাক দিলেন।
আক্কেল আলী চোখ কচলাতে কচলাতে এসে হাজির হয়। সোহাগী বেগমও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন। খোয়ারের ভেতর চোখ পড়তেই সোহাগী বেগম নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, শুধু অনুচ্চ উচ্চারণ- আমার ছেলে কোথায় গেল!
চোখ জোড়া ছানাবড়া করে আক্কেল আলী খোয়ারের ভেতর তাকিয়ে আছে। কোনরকম কথাই যেন মুখ থেকে বের হতে চাচ্ছে না। একেবারে নির্বাক।
নীরবতা ভেঙে হাজী আহম্মদ মিয়া বললেন- আক্কেল, তাড়াতাড়ি বের হ! যেখানেই থাকুক আমার ছেলেকে খুঁজে বের করে নিয়ে আয়।
আক্কেল আলীর অস্ফুট উচ্চারণ- হুজুর, খুটিটাও সঙ্গে করে নিয়ে গেছে! এত বড় গাছের গোড়ার খুটিটা কীভাবে নিয়ে গেল!- এই বলে আশ্চর্যভরা দৃষ্টিতে মনিবের দিকে তাকিয়ে রইলো আক্কেল আলী।
হাজী সাহেবের মনের ভেতর নানান কথা ঘুরপাক খায়- সে তো এখন আর মানুষ নয়! বিশালাকার এক দৈত্যের বাস মনের ভেতর। এই সামান্য খুটি তার কাছে এখন কোন বোঝাই নয়। অথচ রাজ্যের দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা আর বেদনার প্রতিলিপি এই খুঁটি। যা সে এখন একা অর্থহীন জীবনে বয়ে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করে হাজী সাহেব বললেন- আর দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি খোঁজ করে নিয়ে আয় আমার একমাত্র আদরের সন্তান আদর আলীকে।– বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠলেন তিনি।
কালবিলম্ব না করে আক্কেল আলী দলবল নিয়ে বের হয়- যেভাবেই হোক উন্মাদ আদর আলীকে খোঁজে বের করে আনতেই হবে। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে পুরো দিন কেটে যায়। গোধূলী পেরিয়ে আক্কেল আলী ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসে। তন্নতন্ন করে সব জায়গায় খুঁজেছে; আশেপাশের সব গ্রাম দেখা হয়ে গিয়েছে। পরিচিত অথবা অপরিচিত কারও বাড়িই খুঁজতে বাকি রাখেনি সে। আশ্চর্যের ব্যাপার এতবড় খুটিটা সঙ্গে করে কীভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আবার ধারে কাছে কোথাও সে নেই- নিশ্চয়ই দূর কোথাও চলে গিয়েছে।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় নিরুদ্দেশ আদর আলীর কোন খোঁজ মিলেনি, একেবারে উধাও! পৃথিবীর যত দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা আর বেদনা ওই খুটিতে বেঁধে আদর আলী একাকি উধাও। আর খুটির বাঁধা দুঃখের প্রতিচ্ছায়া ফেলে রেখে গেছে হাজী আহম্মদ মিয়া আর সোহাগী বেগমের জীবনের পরতে পরতে।
শেষ
০২.১২.২০২১
রায়ের বাজার, ঢাকা।