প্রভু-ভৃত্য
পার্থসারথি
*
গৃহকত্রী রুবিনা আখতার, বেগমের কান টেনে ধরে বললেন ; হারামজাদী তোর এত বড় সাহস, আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলিস ! – এই বলে গালে ঠাসঠাস করে কয়েকখানা চড় বসালেন। আর যদি কোনদিন গায়ে হাত তুলেছিস, তবে মেরে হাড় ভেঙে গুড়িয়ে দেব হারামজাদী! বল, আর কোনদিন গায়ে হাত তুলবি?
বেগম দু'দিকে মাথা নাড়ে এবং বলে এমন আর কখনও করবে না।
চোখ রাঙিয়ে রুবিনা আখতার বলেন- মনে থাকে যেন!- এই বলে মেয়ে কণিকাকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলেন।
কয়েকটা হিঁচকে কাঁদুনের সুর ঝেড়ে হাতের চেটোয় চোখের জল মুছতে মুছতে কান্না থামাল কণিকা।
বেগম আঁড় চোখে কণিকাকে এক পলক দেখে মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে রইল।
মায়ের আদরে কণিকা শান্ত হলো। যেন ভোরের শিশির ভেজা ঘাসের ওপর মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে গেল। তারই পাশে দুপুরের প্রখর রৌদ্রতাপে নতজানু বৃক্ষের মতো নিশ্চল বসে আছে বেগম। একবার মনে মনে ভাবে বলবে কিন্তু সাহসে কুলোয় না। যদি আরও কয়েক ঘা পিঠে বসিয়ে দেয়! নানান ভাবনার জালে কথাগুলো নদীর তরঙ্গের মতো মনের অজান্তে বিলীন হয়ে যায়। হয়ত শিশু বয়সে অধিকার বোধটুকু খুবই যথার্থ থাকে। ওরা বুঝতে পারে ঠিকই কার কাছে কতটুকু অধিকার পাওনা। মাথায় আরও কয়েকবার আদরের হাত বুলিয়ে মেয়েকে বুকের ভেতর চেপে ধরলেন রুবিনা আখতার। চোখ পাঁকিয়ে বেগমকে শাসিয়ে বললেন- হাতের বাকি কাজগুলো শেষ করে তবে ভাত খাবি! আর র আগে আমার ছাড়ানো কাপড়গুলো ভালো করে ধুয়ে দিবি।– এই বলে রুবিনা আখতার অন্তর্হিতা হলেন।
কয়েক ফোঁটা অশ্রু টপটপ করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। চাঁপা কান্নার জমাট বাঁধা কষ্টগুলো গ'লে গ'লে ঝর্ণাধারায় নদী হয়ে বয়ে চলেছে। বেগম এরই মধ্যে রপ্ত করে নিয়েছে মারার সাথে সাথে কান্না করতে নেই। তাহলে আরও কয়েকগুণ শাস্তি পেতে হয়। সারাদিন অনাহারেও বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছে। ক্ষুধার তাড়নায় যখন কচি মন যখন হৃদয়ের এপাশ-ওপাশ ধাক্কায় তখন দেহ-মন অবাধ্য হয়ে ওঠে। তাই একবার কাউকে কিছু না বলে বাড়িতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আবারও ফিরে আসতে হলো। শুধু শুধু আসা নয়, বাড়িতে গিয়ে মায়ের হাতেও পিটুনি খেতে হয়েছে।
হারামজাদি, কাজ করবি না তো খাবি কী, আমার মাথা? ঘরে ঢুকবি না। ফিরে যা বলছি।–এই বলে মা মারতে তেড়ে আসল।
উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্থির নয়নে মা জরিনা খাতুনকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আর ভাবতে লাগল- কণিকার মা কণিকাকে কত আদর করে। আর আমার মা আমাকে একবার পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করল না, আমি কেন চলে এসেছি। চলে এসেছি ওটাই প্রধান বিষয়।
আরও কতকিছু এই ছোট্ট মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু বেগম টাল সামলাতে না পেরে উঠানের মাঝখানে মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
জরিনা খাতুন কান্না আর চেঁপে রাখতে পারেননি। শাড়ির আঁচলে চোখের কোণ মুছে রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়ে এসে বেগমের পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন। এবং মায়ায়, মমতায় আর ভালোবাসায় মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন পরম আদরে। তপ্ত রোদের মাঝে শুভ্র মেঘের ছায়া পড়লে যেমন স্বচ্ছ ছায়া পড়ে ঠিক তেমনি বেগমের চোখে ভেসে ওঠল সুখের একটু আভাষ। বেগম খুব ভালো করেই জানে, এই সুখ ক্ষণিকের ; আকাশে উড়ে উড়ে বেড়ানো শুভ্র মেঘের স্থিতিকালের মতো। অল্পক্ষণের মধ্যেই এই ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবে যাবে। যখন বাবা ঊনখোরাকে ঘরে ঢুকবে। তবু যাই হোক, মায়ের বুকের মাঝে নিজেকে হারাতে পারলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ-শান্তি হৃদয়ের পাশে বাসা বাঁধে। তা ক্ষণিকের হলেও অতি দুর্লভ। বেগম আশ্চর্য হয়ে মায়ের কোলে আধ-শোয়া অবস্থায় আকাশ দেখছে। অনেক দূর আকাশে অসংখ্য ঈগল উড়ছে।
সারাদিন কিছুই খাসনি, না?
বেগম দু'দিকে মাথা নাড়ে।
অব্যক্ত যন্ত্রণার ফাঁদে পড়ে মন আঁকুপাঁকু করে ওঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বেগমকে কোলে তুলে নিলেন জরিনা বেগম। কোঠরাগত চোখ, বিবর্ণ উসখো-খুসখো চুল, খসখসে মুখখানি ক্ষণিকের তরে যেন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠল। নিজের খাওয়া এখনও হয় নি। সকলকে খাওয়ানোর পর মাত্র গোসল করে এসেছেন। যা খাবার ছিল মেয়েকে নিয়ে ভাগাভাগি করে দু'জন খেলেন। আসার কারণটা খেতে খেতে মায়ের কাছে বলল বেগম।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েকে বললেন- ওরা বড়লোক মানুষ, ওরা যেভাবে বলে সেভাবেই কাজ করিস। তাছাড়া তুই তো আর আগের মতো না। এখন ওদের এখানে কাজ করিস। বদলিতে তোকে খেতে দেয়। দু'একটা চড়-থাপ্পর দিলেও সহ্য করে নিস। আর কোনদিন পাল্টা হাত তুলিস না। কণিকা তোকে মেরেছে বলে তুইও মারবি? ওরা এখন তোর প্রভু আর তুই ওদের দাস। ওরা যা বলবে তাই করবি, বুঝলি?
*
এই কথাগুলো কিছুদিন কিছুদিন পূ্র্বে জরিনা বেগম নিজেও বুঝতেন না। প্রথম দিকে, কাজে যাবার কিছুদিন পরেই মেয়ে বেগম কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল। আসার কারণ, গৃহকত্রী রুবিনা আখতার বেগমকে প্রচণ্ড মার-ধোর করেছিল।
বেগম কণিকার গায়ে হাত তুলেছিল। প্রথমে অবশ্য কণিকাই বেগমের গায়ে হাত তুলেছিল- কাজের মেয়ে বেগমের অভিযোগ।
কাজের লোক তার মেয়ের গায়ে হাত তুলবে কেন?- গৃহকত্রী রুবিনা আখতার কখনও বরদাস্ত করতে পারেন না।
জরিনা খাতুনও ছাড়বার পাত্রী নন। সাথে সাথেই মেয়েকে নিয়ে সোজা কণিকাদের বাসায় এসে হাজির। ভদ্র লোক! ভদ্র লোক! এমন ভদ্র লোক অনেক দেখেছি। কত ভদ্র লোক আসে আর যায়!- জরিনা খাতুন রীতিমতো চেঁচাতে চেঁচাতে এসে হাজির হলেন।
চেঁচামিচি শুন রুবিনা আখতার বেরিয়ে এলেন এবং বললেন- এমন চেঁচামিচি করছো কেন ?
আমার মেয়েকে মেরেছেন কেন?
তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা কর কেন মেরেছি।
আপনার মেয়েই তো আগে আমার মেয়েকে মেরেছে। তারপর আমার মেয়ে মেরেছে।
তোমার মেয়ের এত বড় সাহস আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে। তারপরও তুমি আমাকে শাসাচ্ছো, এত বড় দুঃসাহস তোমার!
না, চুমা খাইয়া আদর করবো !
অনেক কথা কাটাকাটির পর, জরিনা খাতুন তার মেয়েকে না খাইয়ে রাখবেন তবু আর কাজে দিবেন না বলে হনহন করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু জরিনা খাতুন তার প্রতিজ্ঞা বা রাগ বেশিদিন পুষে রাখতে পারেন নি। অভাবের তাড়নায় সবকিছু ম্লান হয়ে যায়। ওটা ছিল তৎক্ষণাৎ রাগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এখানেও তাকে অবধারিতভাবে হারতে হলো। না খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে পেটে-পিঠে খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভালো এবং অনেক সুখের। অবশেষে একদিন বিকেল বেলা অনাহার ক্লিষ্ট দেহে টলতে টলতে এসে আবার হাজির।
বারান্দায় চেয়ারে বসে কণিকার আব্বা সিহাবুদ্দীন সাহেব দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলেন। জরিনা খাতুন ও বেগমকে আসতে দেখে স্ত্রী রুবিনা আখতারকে ডেকে বললেন- বেগমের মা এসেছেন। কণিকার মা, একটু এদিকে এসো।
জরিনা খাতুন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রুবিনা আখতার এসে উপস্থিত হলেন। তারপর জরিনা খাতুনের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন- কী ব্যাপার, বলে তো গেলে আসবে না! আবার এলে কেন?
জরিনা খাতুন কান্না শুরু করে দিলেন- আপা, আমাকে মাফ করে দেন। সেই দিন রাগের মাথায় আপনাকে অনেক কিছু বলেছি।
বেগম একবার তাকাচ্ছে ওর মায়ের দিকে আবার তাকাচ্ছে গৃহকত্রী রুবিনা আখতারের দিকে। মায়ের আচরণে বেগম ভীষণ অবাক হচ্ছে। যেন ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করছে ঘটনার পরম্পরা।
এত কান্নাকাটিতে রুবিনা আখতার নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। হৃদয়ের কোণে যেন ভালোবাসা জেগে ওঠল। সান্ত্বনার সুরে বললেন- ঠিক আছে আর কান্নাকাটি করতে হবে না। কেন এসেছো বল।
বেগমকে আপনার এখানে রেখে দিন। আর কোনদিন আপনার মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না।
কিন্তু এখন তো আমার কাজের লোকের দরকার নেই।– এই বলে রুবিনা আখতার আঁড়চোখে স্বামীর দিকে তাকান।
সিহাব সাহেব ঘাড় কা'ত করে নীরব সম্মতি জানালেন মেয়েটিকে কাজের জন্য রেখে দিতে।
আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার মেয়েকে রেখে যাও। আর কাঁদতে হবে না।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশে একরাশ রৌদ্রকণা যেন বিচ্ছূরিত হলো। আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ স্বাধীনভাবে উড়ছে।– জরিনা খাতুনের মুখ-মণ্ডলে তা বেশ সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে।
সারাদিন কিছু খাও নি, না?- রুবিনা আখতার জানতে চান।
মুখে কোন কথা নেই। মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে রইল জরিনা খাতুন। পাশে বসা বেগমও নির্বিকার।
বেগম আমার সাথে আয়।– এই বলে রুবিনা আখতার ঘরের ভেতর পা বাড়ালেন। পিছু পিছু বেগম হেঁটে চলল। কিছুক্ষণ পর এক থালা ভাত আর এক বাটি মাছের রান্না তরকারি নিয়ে বেগম হাজির হলো। মা-মেয়ে মিলে অর্ধেক ভাত-তরকারি চেটেপুটে খেল। বাকি ভাত-তরকারি সযতনে গুছিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে জরিনা খাতুন বললেন- আপা, থালা-বাটিটা নিয়ে যাই? পরে এসে ফেরত দিয়ে যাব। বেগমের ইচ্ছে ছিল আরও একটু খাবার খাওয়ার। কিন্তু মা জরিনা খাতুন চুপিচুপি বলল- বাড়িতে সবাই না খেয়ে বসে আছে। ওদের জন্য কিছু রাখবি না?
মায়ের কথা শোনার পর বেগম ভাতের থালায় আর হাত বাড়ায় নি। তবে নিজেকে সংবরণ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। কারণ পেটে এখনও অনেক ক্ষুধা। না খেয়ে দিন পার করা যায় কিন্তু চোখের সামনে খাবার থাকলে তার লোভ সংবরণ করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। বেগম চুপচাপ বসে হাত চাটতে লাগল।
গৃহকত্রী রুবিনা আখতার আরেক থালা ভাত এনে দিয়ে বললেন- এগুলো বাড়িতে নিয়ে যাও। আর আগেরগুলো তোমরা খেয়ে নাও।
জরিনা খাতুন চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। আবেগে কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল। কোন কথা উচ্চারণ করতে পারলেন না। শুধু স্থির দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলেন রুবিনা আখতারের দিকে। সেই থেকে বেগম আর কোনদিন কণিকার গায়ে হাত তুলেনি। নীল আকাশ যেমন স্থির তেমনি বেগমের জীবনের গণ্ডী এখন মনের আঙিনায় আবদ্ধ। আকাশে কখনও শুভ্র চাঁদ হাসির ঝর্ণা ছড়িয়ে স্বর্গীয় করে তোলে, সূর্যাস্তে মনোরম গোধূলির ছোঁয়া পৃথিবীর বুকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। এই আকাশেই আবার ঝড় ওঠে, বজ্রপাত হয় আর চলে মেঘের খেলা।– এই আকাশ যেন বেগমের হৃদয় মন। বেগম কোনদিন ওদের কোন কথা অমান্য করে না। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এটা-ওটা কাজ লেগেই থাকে। চা চাপানো হয়েছে চিনি নেই, যাও বাজারে। কাপড়ের আঁচলে ময়লা একটু ময়লা লেগে আছে, আবার ধুয়ে নিয়ে এসো। ঘরে মেহমান এসেছে কিছু নিয়ে এসো বাজার থেকে। কণিকা কাঁদছে বাজার থেকে কিছু নিয়ে এসো। খাবার টেবিলে বসে থেকে বাজার থেকে ডিম আনানো প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। রান্না শুরু মরিচ নেই, বেগম যাও বাজারে। বন্ধুদের সাথে বিকেলের আড্ডা জমেছে, যাও সিগারেট নিয়ে আসো। মোট কথা প্রতিদিনকার কাজের অন্ত নেই। যেন আধুনিক সভ্যতার অতি উন্নতামানের এক যন্ত্রমানব। মুখে কখনও না শব্দটি আসতে নেই। সৃষ্টিকর্তার এক অনবদ্য সৃষ্টি!
*
অথচ কিছুদিন পূর্বেও কণিকা আর বেগম ছিল দু'জন দু'জনার খেলার সঙ্গী। যদিও কণিকা বেগমের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট। তবুও কণিকা আর বেগম এক অজানা বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কণিকার একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল এই বেগম। তবে দু'জনার মধ্যে ঝগড়া হতো না, তা কিন্তু নয়। তবে তার রেশ বেশিক্ষণ থাকতো না।
বেগম সাচাইল গ্রামের বাসিন্দা আর কণিকার বাবা সরকারি চাকুরে। তাই ওরা সরকারি কোয়ার্টারে থাকে। কোয়ার্টারটা সাচাইল গ্রামের লাগোয়া। কণিকার বাবা সিহাবউদ্দীন ভূঁইয়া তাড়াইল উপজেলা হাসপাতালের একজন কেরানী। মাস ছয় হলো বাজিতপুর থেকে বদলি হয়ে এসেছেন।
সিহাবউদ্দীন সাহেব বেশ মিশুক প্রকৃতির লোক। অফিসের ছোট বড় সবার সাথেই সদ্ভাব। সেটা তার ব্যবহারের কারণেই সম্ভব হয়েছে। তিনি সাধারণত অফিস কামাই করেন না। বরং সহকারী সাহেব মাঝে মাঝে বাড়তি কাজের বোঝা চাপিয়ে ছুটির বায়না ধরেন- স্যার আমাকে আজ বাড়িতে যেতেই হবে। নইলে ভীষণ অসুবিধায় পড়ে যাব।
ঠিক আছে যান, তবে ঠিক সময়ে চলে আসবেন।– এই বলে বাড়তি কাজের চাপ নিয়ে নেন হাসি মুখে।
কিছুদিন যাবৎ মেয়ে কণিকা খেলার সঙ্গী পেয়ে ভীষণ খুশী। মেয়েটির গায়ে ময়লাযুক্ত কাপড়-চোপড় তাই মা রুবিনা আখতার নিজের মেয়েকে মিশতে দিতে চান না। পাছে নিজের মেয়ে বখে যায় কিনা সেই ভয়ে।
সিহাবউদ্দীন সাহেব মৃদু কন্ঠে বলেন- আহা ! ওরা বাচ্চা মানুষ ওদের মাঝে এসব কথাবার্তা ঢুকিও না। ভালো সঙ্গী যখন পেয়েছে একসঙ্গে খেলতে দাও।
রুবিনা আখতার নাছোড়বান্দা, মেয়েকে ওই নোংরা গরীব মেয়ের সাথে খেলতে দিবেন না। হাত ধরে টেনে মেয়ে কণিকাকে ঘরে নিয়ে এলেন। কিন্তু মেয়ে কণিকা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এক সময় রুবিনা আখতার বিরক্ত হয়ে বলেন- আচ্ছা যাও। কিন্তু বেশিক্ষণ খেলবে না। তাড়াতাড়ি চলে এসো।
কথাটা কানে পৌঁছামাত্রই কণিকা এক দৌঁড়ে বাইরে চলে গেল। বেগমকে না পেয়ে কণিকা মর্মাহত হৃদয়ে ফিরে এসে বারান্দার এক কোণে বিষন্ন মনে বসে রইল। বসে আপন মনে কাঠি দিয়ে নিজের দুঃখগুলো মেঝেতে আঁকিবুকি করছে। যেন ব্যথাভরা কথাগুলো পৃথিবীর বুকে গেঁথে রাখছে।
কী হলো মামণি, একা একা বসে আছো যে ?- সিহাবুদ্দীন সাহেব আদুরে কন্ঠে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন।
কণিকা কোন কথা বলল না। অভিমানে দু'গাল ফুলিয়ে পেছন ঘুরে বসল।
মেয়ের অভিমান দেখে সিহাবুদ্দীন সাহেব মুচকি হাসলেন। তারপর দু'বাহুতে জড়ালেন একমাত্র কন্যাকে। কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন। কিন্তু কণিকা নির্বাক। অভিমানে গাল দুটো যেন এক ইঞ্চি পরিমাণ ফুলে আছে। স্ত্রী রুবিনা আখতারকে ডেকে বললেন- দেখে যাও, তোমার মেয়ে ভীষণ রাগ করেছে।
রুবিনা আখতার ভেজা হাতটা শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে পাশে এসে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে মেয়েকে বললেন- কী ব্যাপার মামণি, খেলার সাথী চলে গেছে তাই মন খারাপ? এখন গিয়েছে পরে আবার আসবে। রাগ করে না মা লক্ষীটি!- এই বলে দু'গালে আদরের হাত বুলালেন। কিন্তু কণিকা মায়ের সাথে অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে আব্বুকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল।
প্রথম প্রথম কণিকা যখন অন্যান্যদের সঙ্গে খেলত তখন তেমন একটা পাত্তা পেত না। খেলার মাঝে কোয়ার্টারের কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে আর কিছু পার্শ্ববর্তী এলাকা সাচাইলের। কারও সাথে কণিকার তেমন একটা বনিবনা হতো না। আবার বেগম ওদের কাছে একেবারে পাত্তাই পেত না। এক সময় দেখা গেল কণিকা ও বেগমের মধ্যে বেশ অন্তরঙ্গ তৈরি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে দু'জন এক অজানা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। স্কুল চলার সময়টুকু বেগমের কাছে অসহ্য মনে হতো। প্রতিটি মুহূর্ত যেন যুগের সাথে হেঁটে চলত। কারণ বেগম স্কুলে পড়ে না। তাই ওই সময়টুকু কণিকার শূন্যতায় বুকটা হাহাকার করে ওঠত। অগত্যা বেগম পথের দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতো কণিকা স্কুল থেকে কখন ফিরবে।
*
কাজের লোকের দরকার। তাছাড়া বেগম আর কণিকা দু'জন দু'জনার খুব কাছাকাছি। তার ওপর বেগম ছিন্নমূল এক পরিবারের সন্তান। কাজের কথা যখন বেগমের মা জরিনা খাতুনকে বলা হলো, এক হাসিতেই রাজি- কী যে বলেন, কাজ না করলে খাবো কী?
সেই থেকে বেগম কণিকাদের বাসার কাজের মেয়ে।যাকে শুদ্ধ ভাষায় আমরা বলি ভৃত্য।
এরই মাঝে কীভাবে কাজের ফাঁকে তিন-চারটা মাস কেটে গেল বেগম একেবারেই টের পায় নি। আর বুঝতেই পারে নি একদিনের প্রিয়তমা খেলার সঙ্গীটি এখন অন্য জগতের অচেনা মানুষ। প্রথম দিকে কিছুদিন সম্পর্কটা যথাযথ টিকে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সম্পর্কের জাল ছিন্ন হয়ে গেল এক নীরব ঝড়ের তাণ্ডবে।
আজকের ঘটনায় বেগম কণিকার গায়ে হাত তোলে নি। বেগমকে ভীষণ বিশ্রীভাবে মারছিল কণিকা। নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে কণিকাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু কণিকা ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপরই গৃহকত্রী রুবিনা আখতার মনের খায়েসে হাত চালালেন বেগমের উপর।
আহত শরীর ও মন নিয়ে বেগম এখনও চুপচাপ মেঝেতে বসে আছে। কণিকা এক ঘা বেগমের পিঠে বসিয়ে ভোঁ দৌঁড়ে অন্য রুমে চলে গেল। বেগমের এতক্ষণের ভাবনার জগতে ছেদ পড়ল। ভাবনার জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল বেগম। কিলটা পিঠে ভীষণ লেগেছে। কিন্তু সামান্যতম বহিঃপ্রকাশ করে নি বেগম। শুধু বাতাসে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে বাজতে লাগল- তুমি আমার ভৃত্য আর আমি তোমার প্রভু। বেগম শুধু এতটুকুই অনুভব করল- সে ভৃত্য আর কণিকা প্রভু। কণিকার উপর হাত তোলা মানে পেটের ভাতে টান দেয়া। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য বাঁধা চোখের সামনে। চোখের সূক্ষতম কুদৃষ্টিও যেন প্রভুর গায়ে আঁচড় কাটতে পারে না।
***