পোস্টস

গল্প

সকল শূন্য উজাড় করে

৮ জুন ২০২৪

সুমাইয়া তাহসিন

              জুন মাসের ১২ তারিখ সৃজিতার জন্মদিন। জন্মদিনের ব্যাপারটা সে পুরোপুরি ভুলেই যেত, যদি ঘটনাটা না ঘটতো। বাড়িতে এসে একরকম কচ্ছপের মতো গুটিয়ে দিন পার করছিল সে। দু’একটা পুরনো পড়া বই উল্টে-পাল্টে দেখে; মাঝেমাঝে নতুন দু’একটা বইয়ে বুঁদ হয়ে তার নীরব সময় কেটে যাচ্ছিল। ১১ই জুনের এক অলস দুপুরে মায়ের সাথে গল্প করছিল সৃজিতা। হঠাৎ একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এল। 
ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত রিসিভ করলো ফোনটা: 

-হ্যালো

-আপনি কি সৃজিতা মায়া বলছেন?

-জ্বী, বলুন।

-কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিস থেকে বলছি। আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে। আজ এসে নিয়ে যাবেন প্লিজ।

-সরি, আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমার কোন পার্সেল আসার কথা নয়। আপনি রিচেক করুন।

-ভুল হচ্ছে না ম্যাডাম। ০১৮২...এই ফোন নাম্বার এবং এই নামেই এসেছে। আপনি এসে নিয়ে যাবেন।

             কুরিয়ারের সার্ভিসের লোকটার সাথে এরকম আলাপ হলো তার। ফোন রেখে সৃজিতা ভাবছিল, হঠাৎ তার নামে পার্সেল কে পাঠালো। না জানিয়ে চমকে দেওয়ার জন্য পার্সেল পাঠানোর মতো কেউ তো নেই তার! কিঞ্চিৎ আশঙ্কাও মনে কাজ করলো। এই যুগে কত কিছুই তো ঘটে! তার সাথে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে না তো? যদিও তার বিরুদ্ধে ঘটা করে ষড়যন্ত্র করার মতো গুরুত্বপূর্ণও কেউ সে নয়। তারপরও। ভাবতে ভাবতে সে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিল। এক অজানা তাড়নায় পার্সেলটা সাইন করে নিয়ে এল। রিকশায় বসে অনুভব করলো পার্সেলটা বেশ বড় এবং ভারী। কী হতে পারে? কে পাঠাতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠতে গিয়ে দেখা হলো সালমা আন্টির সাথে। সালমা আন্টি সৃজিতার প্রতিবেশি। একই পাড়ায় থাকে তারা। সালমা আন্টি সৃজিতার কাছে জানতে চাইলো, তার হাতে ওটা কী? সৃজিতা নিজেও অবশ্য জানে না এর ভেতরে কী। আবার পুরোটা বুঝিয়ে বলাও মুশকিল। তাই সে সুবিধাজনক উত্তর দিল, ‘আন্টি', একটা পার্সেল এসেছে ঢাকা থেকে।’ পাশ থেকে অপরিচিত আরেক আন্টি বলে উঠলো, ‘দেখে মনে হচ্ছে কসমেটিক্স-প্রোডাক্ট।’  সৃজিতা ধন্দে পড়ে গেল এবার সে কী বলবে? সালমা আন্টি ঠিক তখনই বলে উঠল, ‘নাহ, ওর কাছে ওসব কি আসবে! ওগুলো হয়তো বই। ওরা পড়ে তো তাই বোধহয় অর্ডার করেছিল।’ 

            সৃজিতা ভদ্রমহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করলো। সে অবাক হলো এই ভেবে যে, সালমা আন্টি এতোটা নিশ্চিত, ওর কাছে কোন বিউটি প্রোডাক্ট আসতেই পারে না। সে শুধু বলতে পারলো, ‘হুম, এগুলো বই। তানিশাকে আসতে বলবেন আন্টি।’ ওঁর মেয়ের নাম তানিশা। সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়ছে এখন। যখন সে ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন থেকে তানিশার সৃজিতার কাছে আসা-যাওয়া। একই পাড়ায় পাশাপাশি থাকে ওরা। সৃজিতার মনে পড়ে, প্রতি ঈদের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা তানিশা এসে বলতো, আপু হাতে মেহেদি পড়িয়ে দাও। সৃজিতা যত্ন করে কোমল দু’টি হাতে মেহেদির নকশা করে দিত। আর বলতো, ‘একেবারে সকালে ধুয়ে ফেলবে। তাহলে ভালো রং হবে।’ মেয়েটি শুধু নরম স্বরে বলতো, ‘আচ্ছা।’ খুব বেশি কথা বলতো না মেয়েটা। ঈদের দিন সকালে বেলা তানিশা সবার আগে এসে সৃজিতার ঘুম ভাঙিয়ে বলতো, ‘কেমন রং হলো আপু, দ্যাখো তো।’ সৃজিতা তাকিয়ে দেখতো, মেহেদীর রং দারুণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু নকশাগুলো এবড়োথেবড়ো হয়ে দুর্বোধ্য কোন নকশায় রূপ নিয়েছে। মনে মনে সে বলতো, আহারে, রাতে মেয়েটা বোধহয় এভাবেই ঘুমিয়েছে। এরপর দু’জনের টুকিটাকি গল্প হতো। কোন কোন ঈদের দিন সৃজিতা তানিশাকে বলতো, ‘এসো তোমাকে একটু কাজল পরিয়ে দিই।’ সৃজিতা খুব যত্ন করে তানিশাকে কাজল পরিয়ে দিত। শ্যামবর্ণ, কোঁকড়া চুল আর ভীষণ মায়াবী চোখের মেয়েটাকে মনে হতো অনিন্দ্য সুন্দর। একদিন সে তানিশার একটা চিরকুট পেল। তাতে লেখা আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে। আপনি অন্যরকম। 

                                                                                                           ---তানিশা

 

            সৃজিতা অনেকবার ভেবেছে একটা চুপচাপ ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মেয়ে এত নীরবে তাকে কেন পছন্দ করবে?  পাশাপাশি বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও বেলকনিতে কদাচিৎ দেখা হতো মেয়েটার সাথে। চিরকুটটা যত্নে রেখে দিয়েছে সৃজিতা। এভাবে কত যে ছোট ছোট ভালো লাগা জমিয়ে রাখে সে! অনেকদিন পর তানিশার কথা ভেবে তার মনটাও ভালো হয়ে গেল। পার্সেলটা নিয়ে এরপর নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল সে। তারপর সাবধানে পার্সেলটা খুললো। প্রথমেই পেল একটি জন্মদিনের কার্ড। যাতে তিনটি গোলাপ পর্যায়ক্রমিক ভাবে অতি যত্নে আটকানো— কুঁড়ি, অর্ধফুটন্ত এবং ফুটন্ত। কার্ডটি খুলতেই পরিচিত একটা পারফিউমের ঘ্রাণও পেল। ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হলো সে। এরপর পেল একটা চিঠি। চিঠিটা রেখে দিলো। রাতে যখন চারপাশ নিশ্চুপ হয়ে যাবে তখন পড়বে বলে। ততক্ষণ এক অজানা কৌতূহল আর শিহরণ নিয়ে থাকা মন্দ কি? ভাবলো সৃজিতা। 

এরপর সে পেল ঐতিহ্য প্রকাশনীর ৬ খণ্ডের জীবনানন্দ রচনাবলী। প্রথমখণ্ডের একপাতায় লেখা জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’ কবিতার অংশবিশেষ— 

  • আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
    আমাদের সকলের আগে শেষ হয়;
    দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ–অবসাদ–
    আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত। 

 

--- সুমায়া কে শুভজন্মদিনে 
                    ১২.০৬.১৮

 

                  আর পেল আর্জেন্টিনার একটা জার্সি। সৃজিতার মনে পড়লো ‘বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮’ নিয়ে তখন বেশ মাতামাতি চলছে চারপাশে। জার্সিতে লাগানো একটা চিরকুট— ‘এটা পরে প্রিয় দলের খেলা দেখো।’ স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো সৃজিতা। একদিকে মনে প্রশ্ন জাগছে, এগুলো গ্রহণ করা উচিত হবে কি? অন্যদিকে ভাবছে, এভাবে কেউ অনায়াসে তার অতিলৌকিক ইচ্ছেগুলো স্পর্শ করে নিত আগে। যদি তাকে হীরের আংটি পাঠানো হতো, তবে সে নির্দ্বিধায় তা প্রত্যাখ্যান করতো। কিন্তু কারো জন্মদিনে ৬খণ্ড জীবনানন্দ যে পাঠাতে পারে,  তার উপহার প্রত্যাখ্যান করা রীতিমত অন্যায়। মনে হলো তার। এরপর সারাদিন একরকম ঘোরের মধ্যে কেটে গেল তার। রাতে যখন চারিদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, তখন সে বারান্দায় গিয়ে চিঠিটি খুলে বসলো। সে স্বগতোক্তি করে বললো, ‘ওহ গড! আই ডোন্ট নো হাউ টু পুট ফর্থ দি মোস্ট এক্সসেপশনাল ফিলিংস ইন্টু ওয়ার্ডস।’ টেকনোলজি আর কনজিউমারিজম যখন সর্বতোভাবে গ্রাস করেছে পৃথিবীকে, তখন যে মানুষ চিঠি লিখতে পারে সে আর যাই হোক গতানুগতিক তো নয়ই। ভাবলো সে। তিন পাতার চিঠির পরতে পরতে সৃজিতা সত্যিকারের অনুভূতির ঘ্রাণ পেলো। 

চিঠির উপরে ডানপ্রান্তে লেখা ০৫ জুন,২০১৮, সায়েন্স লাইব্রেরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর চিঠি প্রেরক লিখেছে-


মায়া,
কেমন আছ? কতদিন পর আবারো লিখছি তোমার কাছে। 
হয়তো দীর্ঘদিন পর এই চিঠি নীরবতা ভাঙলো। 
কিংবা হয়তো নীরবতা আর ভাঙবে না। 
জীবন তো মুখর নয়, নীরব। 
আর এইসব নীরবতা যে অনুবাদ করতে পারে 
সেই তো আমাদের জীবনের দুর্লভ জন।

 

                  সে আরও লিখেছে জীবন তাকে বিস্তর অভিজ্ঞতা দিয়েছে। জীবন সম্পর্কে এত বেশি বুঝে ফেলেছে যে, এখন সত্যি জীবনকে তার বোঝা মনে হচ্ছে। লিখেছে, সৃজিতা ঢাকা ছাড়ার পর শহরটাকে এতো শূন্য আর কখনও মনে হয় নি তার। সৃজিতার সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে ওই জায়গাটা পড়তে যেখানে সে লিখেছে, চশমার লেন্স পরিবর্তন করার জন্য তাকে দুইদিন চশমা ছাড়া থাকতে হয়েছে। অথচ এই শহরে সৃজিতার মতো কোন নিরাপদ আশ্রয় তার নেই। চশমা ছাড়া তার পৃথিবী ঝাপসা, ধূসর, এলোমেলো। সে আরও লিখেছে- মনে পড়ে, ২১ জানুয়ারির কথা? কি অস্থির সময়! তোমার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। নিজে বিপর্যস্ত তবুও কি কঠিন প্রত্যয় নিয়ে আমার পাশে ছিলে। তোমার দেয়া চশমায় আমি পৃথিবী দেখছি।

 

                 এতক্ষণে সৃজিতার বুঝতে বাকি রইলো না পার্সেলটি কে পাঠিয়েছে! এগুলো আদিবের কাজ। সৃজিতার মনে পড়লো যখন আদিব চোখের ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছিল তখন সে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল চশমা। সত্যিই সৃজিতা সেদিন বিপর্যস্ত ছিল। মাঝেমাঝে সৃজিতার ভয় হতো আর সূক্ষ্ম অস্বস্তিও। তার অতোটা পাওয়ার অভ্যেস নেই। পরিবারের সবাই তাকে আদর আর স্নেহের প্রাচুর্যে ভরে রাখবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবারের বাইরে সে এতো টা পেতে অভ্যস্ত নয়। বরং এত দিন সে জেনে এসেছে- স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে নিত্য সংঘাত। মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে বা যত্ন করে তখন তার ভেতরে অবচেতনভাবে একধরণের প্রত্যাশা তৈরী হয়। যখন প্রত্যাশা এবং পাওয়ার মধ্যে গরমিল হয় তখনই মূলত সংঘাতটা তৈরি হয়। তখন সহজ অনুভূতি আর সহজ থাকে না। সৃজিতার ভয় হতো মূলত এখানেই। সে চায় না তার আর আদিবের মধ্যে কোন জটিলতা আসুক। তাই আদিব যখন সৃজিতার অতিলৌকিক ইচ্ছেগুলোকে দিব্যি সত্যি করে তুলতো তখন তার ভয় হতো। যদিও পরিচয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত আদিবের মধ্যে এইরকম অকিঞ্চিৎকর বস্তুবাদী হিসেব-নিকেশ সে দেখে নি। যখন সৃজিতার মধ্যে এইরকম দোলাচল চলে তখন রবি ঠাকুরকে তার বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়। 

প্রবীণ এ কবি যেমন বলেন : 

সহজকে সহজ রাখতে হলে শক্ত হতে হয়। ছন্দকে সহজ করতে চাও তো যতিকে ঠিক জায়গায় কষে আঁটতে হবে। লোভ বেশি, তাই জীবনের কাব্যে কোথাও যতি দিতে মন সরে না, ছন্দ ভেঙে গিয়ে জীবনটা হয় গীতহীন বন্ধন।

 

                আর সৃজিতা খুব ভালো করে জানে, জীবন তার জন্য আরও কঠিন। তাই সে যতীকে এঁটেছিল শক্ত করেই। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর থেকে তাই আদিবের সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। কেউ যখন নিজের সাথে সময় কাটাতে চায়, তাতে বাঁধ সাধবার মতো মানসিক নীচতা আদিবের নেই। তাই হয়তো সেও নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে ফেলে সৃজিতাকে অখণ্ড অবসর দিয়েছে। চিঠিতে সে আরও জানিয়েছে মাস্টার্সের রেজাল্ট দিয়েছে তার। টেনেটুনে ফার্স্ট ক্লাস। 

এরপর লিখেছে-

 

  • জানো মায়া, ইদানীং আমার কী যে হলো! চারপাশের মানুষের ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় গা ভাসাতে ইচ্ছে করেনা। ক্লান্ত কচ্ছপ নয় বরং ঘুমন্ত খরগোশ হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিলে মন্দ কি বলো? গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আমার অত তাড়া নেই। আমি অনুভব করি তুমি সমস্তটা জুড়ে আছো। চেয়ে দ্যাখো মায়া, কী চমৎকার একেকটা দিন কেটে যাচ্ছে! কী চমৎকার একেকটা সকাল! মানুষ আর ক’দিনই বা বাঁচে। মিলেমিশে, প্রাণখুলে ভালোবেসে বাঁচার মধ্যে কী যে সুখ! আর দুঃখ, কষ্ট সে তো চিরকালীন সম্পদ মানুষের। দুঃখ ঐশ্বর্যের মতো। এই চিঠি কখন পাবে জানি না। যদি জন্মদিনের আগে পেয়ে থাকো, তবে জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা নিও। কত কী যে ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কিছুই হলো না। হয়তো সৌম্য সুন্দর এক আগামীকালের জন্য আজকের দিনকে আমরা বিসর্জন দিচ্ছি।

 

সে জানিয়েছে, গত রাতে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমাটা আবারও দেখেছে সে। ‘অদিতি’ (শর্মিলা ঠাকুর) চরিত্রের সাথে সৃজিতার মিল খুঁজে পেয়েছে সে। সবশেষে লিখেছে- 

ইতি 
আদিব 

 

                 কী সাবলিল একটি চিঠি! না আছে মনোরঞ্জন করার ঘনঘটা আর না আছে কোন প্রত্যাশা, অভিযোগ, অথবা মিথ্যে কোন প্রবোধ। যেন চিঠি পড়ছে না সে, মুখোমুখি বসে কথা বলছে চিঠি লেখকের সঙ্গে। সৃজিতা অবাক হলো এই ভেবে যে- এই শাশ্বত বন্ধন কিসে তৈরি হলো, যা সে চিঠির প্রতিটা শব্দে এবং নিজের ভেতরে অনুভব করেছে।  আপাতদৃষ্টিতে এ যুগে এমন সম্পর্ক খুব দুর্লভ, বেমানানও। সৃজিতা তা জানে। আদিবের অনেকদিন আগে বলা একটা কথাকে ভীষণ সত্যি মনে হলো সৃজিতার। একদিন কলভবন থেকে কার্জন যেতে যেতে রিকশায় আদিব বলেছিল, ‘জানো মায়া, আমাদের হয়তো কেউ ভুল করে সত্তর বা আশির দশক থেকে তুলে এনে এই সময়ে ফেলেছে। অথবা আমরা হয়তো ছিলাম অ্যাসিরীয়া, ব্যাবিলনিয়া, মেসোপটেমীয় যুগে। সৃজিতা জানে, তার ব্যক্তিত্বের কাঠিন্যটুকু ভেদ করে তাকে আবিষ্কার করতে পেরেছে একমাত্র আদিব। এখানেই তার সমস্ত ভয়।

 

                 অকারণে কিছু লাইন সৃজিতার মাথায় থেকে যায়। বহুদিন আগে একটা নাটক দেখেছিল সে। আহামরি কিছু নয়। কিন্তু একটি লাইন তার মনে গেঁথে গিয়েছে। যেখানে নায়কের প্রেতাত্মা বলেছিল, ‘আমি বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছি ৪০০ বছরের প্রেম।’ সৃজিতারও মাঝে মাঝে মনে হয়, তারও গহীন ভেতরে জমে গিয়েছে ৪০০ বছরের অনুভূতি। অথচ এমন নিবিড় করে অভাবনীয়কে এত কাছে পেতে সে চায় না। লাবণ্যের মতো সেও বুঝেছে, সকলের চেয়ে বড় যে পাওনা, সে মিলন নয়, সে মুক্তি। তাই সে শক্ত করেই যতি এঁটেছে। সৃজিতা জানে এই যতি ভেদ করে কখনোই সে জানাতে পারবে না, তার এত এত অনুভূতির কথা। অথচ দু’জনই জেনেছে, যে বন্ধন গড়ে উঠেছে তা ভীষণ ধ্রুব। নাই হোক পার্থিব ক্লিশে প্রাত্যহিকতা। হয়তো বছর কুড়ি পরেও সৃজিতার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠবে আদিবের মায়াবী ভরাট কন্ঠের ‘মায়া’ ডাক শোনার জন্য। 

মনে হবে- ‘তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য উজাড় করে?’