*যে মেঘ বৃষ্টির ছোঁয়া পায়নি (ছোটগল্প)*
▪পার্থসারথি
*
দীপা বর্মণ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সহকর্মী যতীন বোসের বাড়িতে এলেন। আরও কয়েকজন সহকর্মী এসেছেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই টুকটাক গল্প করছেন। গল্প বেশ জমে ওঠেছে। এমন সময় যতীন বোস এসে দীপাকে বললেন- আপনি ভেতরে যান। মা'র সাথে একটু কথা বলে আসেন।
কাছে যেতেই যতীন বোসের মা সুশোভনা দেবী বেশ আদর করে কাছে বসালেন দীপাকে। দু'জনার মাঝে অনেক কথা হলো। কথা বলতে বলতে বেশ আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠল এই কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফাঁকে সংসারের কথা জিজ্ঞ্যেস করলেন। স্বামী-সন্তানের খোঁজ নিলেন। পানের খিলিটা নিজ হাতে বানিয়ে দীপাকে খাইয়ে দিলেন। দীপা সত্যিই বিমোহিত হলেন যতীন বাবুর মায়ের মধুর ব্যবহারে। চকিতে নিজের মায়ের আসনে মনে মনে বসিয়ে দিলেন সুশোভনা দেবীকে। হৃদয়ের কোণে ঠাঁই দিলেন উনাকে মা হিসেবেই। গল্প ঐদিকে যেমন চলছে এই দিকেও সমানতালে বেশ জমে ওঠেছে। সুশোভনা দেবী পানের খিলিটা মুখে দিয়ে এক ফাঁকে দীপাকে জিজ্ঞ্যেস করলেন- মা দীপা, তোমার স্বামীর পদবিটা কী বললে নাতো?
দীপা আমতা আমতা করছিলেন; স্বামীর নামটা মুখে উচ্চারণ করতে চাচ্ছেন না। বিচক্ষণ সুশোভনা দেবী তা' বুঝতে পেরে বললেন- স্বামীর নামতো স্ত্রীদের বলা পাপ। তোমার পুরো নামটাই বলো।– এই বলে সুশোভনা দেবী দীপার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দীপাকে যদি কেউ কখনও নাম জিজ্ঞ্যেস করে, তিনি অকপটে বলে দেন। মনের মাঝে কোনরকম রেখাপাত হয় না। প্রথমে নাম জানতে চাওয়াটাতো স্বাভাবিক। কিন্তু যখন নামের পাশাপাশি পদবীটাও জানতে চায় তখন দীপা মনের ভেতর শূন্যতা অনুভব করেন। যা তিনি অর্জন করেননি, পেয়েছেন জন্মগত ভাবে। ভীষণ রাগ হয় যারা পুরো নামটা জানতে চায় তাদের ওপর। মুখ ফুটে কিছু বলাও যায় না আবার সহ্য করাটাও বেশ যন্ত্রণাদায়ক। এইতো কিছুক্ষণ আগেও যাকে মাতৃতুল্য ভেবেছেন তার সাথে তো আর রুক্ষ কন্ঠে জবাব দেয়া যায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ শান্ত ভাবেই বললেন- দীপা বর্মণ।
উত্তর দিয়েই দীপা সরাসরি সুশোভনা দেবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। সুশোভনা দেবীর ভাবান্তর দীপার চোখ এড়াতে পারেনি। দীপা যা ভেবেছিলেন তাই হলো। কথাবার্তা আর আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। কথাবর্তার সুর-তাল-লয় মুহূর্তেই উবে গেছে। কিছুক্ষণ পর দীপা বিদায় নিয়ে উঠে চলে এলেন। কেউ যেন কোন ভাবান্তর বুঝতে না পারে তাই হাসি মুখে এসে সবার সাথে গল্পে ডুবে গেলেন।
মায়ের ডাকে যতীন বাবু ভেতর ঘরে এলেন। দীপা গল্পের আসরে বসে আছেন ঠিকই কিন্তু উৎকর্ণ হয়ে আছেন ভেতর ঘরের কথাবার্তায়।
সুশোভনা দেবীর উষ্ণ কন্ঠ ভেসে এলো দীপার কানে। তিনি তার ছেলেকে বলছেন- আমি বেঁচে থাকতে এসব কী হচ্ছে! অজাত-কুজাত নিয়ে ঘরে এনে তুলছিস!
যতীন বাবু ক্ষীণ কন্ঠে বলছেন- আহ! মা, চুপ করো। দীপা শুনতে পাবেন।
সুশোভনা দেবীর কন্ঠ আরও একটু চড়া হলে ওঠলো- শুনুক, তা'তে আমার কী? অজাত-কুজাত এনে ঘরে তুলবি আর সেটা বলতেও পারবো না? তোরা পেয়েছিস কী, হ্যাঁ? আমাকে তোরা নরকের আগুনে পুড়িয়ে মারবি। এই অজাত-কুজাতের সাথে ওঠা-বসা করার চেয়ে নরকে যাওয়াও ভালো। হায়! ভগবান, আমাকে তুমি নিয়ে যাও। আমি এই নরকে আর থাকতে চাই না।– এই বলে সুশোভনা দেবী ধীর লয়ে বিলাপ জুড়ে দিলেন। যতীন বাবু মাকে ধমক দিয়ে বললেন- মা! অনেক হয়েছে। এবার চুপ করো। যা বলার পরে বলবে।
সুশোভনা দেবী বিলাপ থামিয়ে বলেন- বউমা, ঘরটায় গঙ্গাজল ভালো করে ছিটিয়ে দিও।
কথা শোনেও, না শোনার ভান করে ঊর্মিলা দেবী কিছু না বলে অন্য ঘরে চলে গেলেন।
যতীন বাবু আর কোন কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ মায়ের কাছ থেকে চলে এলেন।সবার সামনে এসেই একগাল হাসি বিলিয়ে দিলেন সবার উদ্দ্যেশে। এই হাসির মর্মার্থ শুধু দীপাই বুঝলেন। অবশ্য এই হাসিটি অন্য কারও দৃষ্টিতে পড়েনি। দীপার চোখে চোখ পড়তেই যতীন বাবু যেন একটু মিইয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে গল্পে যোগ দিলেন তিনি।
বাড়িতে ফিরে এসে পর্যন্ত মনে শান্তি বোধ করছেন না দীপা। মাতৃতুল্য সুশোভনা দেবীর কথাগুলো মনের ভেতর বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তাকে প্রায়ই পড়তে হয়। কিন্তু আজকের ঘটনাটা দীপার অন্তর-বাহির আমূল ওলটপালট করে দিয়েছে। মনের যন্ত্রণার বিষ-বাষ্প রক্তের কণায় কণায় পৌঁছে প্রতিটি মুহূর্তকে বিষিয়ে তুলছে। কোনভাবেই নিজের মনকে প্রবোধ মানাতে পারছেন না। 'বর্মণ' পদবিটাই কী সবকিছু! দীপা ভেবে কোন কূল পাচ্ছেন না। কিছু কষ্ট যেন আজ স্থায়ী আবাস গড়লো বুকের আকাশসম ছোট্ট কুটরিতে। বারবার ফুলে-ফেঁপে ওঠছে কষ্টগুলো।
এ ঘটনার পর থেকেই দীপা নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছেন। হিন্দু সমাজের তথাকথিত স্পৃশ্য লোকদের সংসর্গ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। পারতঃপক্ষে কোন কথাও বলেন না। অবশ্য ঐ ঘটনার পরদিন যতীন বাবু দীপার সাথে আরও আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। দীপা যতীন বাবুকে বুঝতে দেননি যে, তিনি সব কথাই শুনেছেন। তবু দীপার মনে হলো, যতীন বাবু দীপার চোখ দেখেই সব আঁচ করতে পেরেছেন। দীপা স্কুল শেষে আর বেশি সময় বাড়ির বাইরে কাটান না। ছেলে-মেয়েদের নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। আর স্বামীর সেবাযত্নে নিজের মনের কষ্ট ভুলে থাকেন। কিন্তু তবু যখন একাকি হন তখন এই কষ্টগুলো বুকের আনাচে-কানাচে ভীষণ আঁচড় কাটে। কিছু ঘটনা থাকে যা জীবনে কখনও মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা ‰বর্মণ' পদবিটাতো অযাচিতভাবে জীবনের সাথে স্থায়ীভাবে লেপটে আছে।
স্বামী রণজিৎ বর্মণ থানা হেল্থ কমপ্লেক্সের সহকারি পরিদর্শক। মাঝে-মধ্যে সহকর্মী সুহৃদ রশীদ ভূঁইয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ভদ্রলোক স্ত্রী-সন্তান বাড়িতে রেখে এখানে কোয়ার্টারে একা থাকেন। যা বেতন পান এতে পরিবার নিয়ে থাকার সংগতি হয় না। তাছাড়া ইটনা এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না; ভাটি এলাকার সবচেয়ে ভাটি এ ইটনা থানা। তাই সাহস কুলোয় না পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতে। রণজিৎ বাবু বন্ধুবরেষু সুহৃদ রশীদ ভূঁইয়াকে মাঝে-মধ্যে বাড়িতে নিয়ে এসে ভালো-মন্দ খাওয়ান।
আজও এসেছেন। দীপার আচার-আচরণ আজ বেশ রহস্যময় ঠেকছে রশীদ ভূঁইয়ার কাছে। দীপার এ পাশ কাটানোর ভাব না দেখার ভান করছেন রশীদ ভূঁইয়া। অন্যদিনের তুলনায় আজ কথা বলছেন একদম গুনে গুনে। দীপার এমন আচরণে রণজিৎ বাবু কিছুটা ক্ষুন্ন হলেন। পাশের ঘরে ডেকে এনে বললেন- দীপা, তোমার কী হয়েছে?
দীপা বেশ আশ্চর্য হবার ভান করে বললেন- কিছু হয়নি তো!
তাহলে এমন গুমড়ামুখো হয়ে আছো কেন?- এই বলে রণজিৎ বাবু স্ত্রী দীপার চোখে চোখ রাখলেন।
এমনি, আমার মনটা ভালো নেই।– দীপার কন্ঠস্বরে পাশ কাটানোর চেষ্টা।
ঘরে অতিথি এলে অন্ততঃ একটু ভালোভাবে কথা বলা উচিত!- এই বলেই রণজিৎ বাবু উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে এলেন।
দীপা খুব লজ্জিত বোধ করছেন- ছি! মন খারাপ তো থাকতেই পারে। তাই বলে অতিথির সামনে তো এভাবে ব্যবহার করা উচিত হয়নি। মনে মনে নিজেকে শাসন করলেন। তারপর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে এগিয়ে গেলেন রশিদ সাহেবের কাছে। তবে নিজেকে আচমকা পরিবর্তন করে নয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো। এক ফাঁকে রশিদ সাহেবের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিলেন দীপা। রশিদ সাহেব সবসময়ই খুব ফূর্তিবাজ লোক। দীপার এই সংশোধন তিনি সানন্দেই বন্ধুর মতো গ্রহণ করলেন।
*
একদিকে যেমন স্কুলের সহকর্মী বা অন্যদের সাথে সম্পর্কের একটা সীমা রেখে চলেন দীপা অন্যদিকে সম্পর্কের অসীম দ্বার খুলে গেছে রশীদ সাহেবের সাথে। স্কুলের সহকর্মীরাও আজকাল দীপার সাথে মেপে মেপে কথা বলেন। অবশ্য অগোচরে সহকর্মী অনেকে দীপাকে দেমাগী বলতে কুন্ঠাবোধ করেন না। রশীদ সাহেবের সাথে চলে মনের দুঃখ-কষ্টের কথা বলা। রশীদ সাহেবও দীপার একজন উত্তম শ্রোতা। এভাবেই দু'জনার মাঝে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠল। রশীদ সাহেব মাঝে-মধ্যে চোখে চোখে কথা বলেন। দীপা অন্তরে অন্তরে অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠেন। কিন্তু রশীদ সাহেবের সাবলীল চলাফেরা কোনরকম কষ্টের উদ্রেক করে না। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে খোশগল্প।
এভাবেই দু'জনার মনের অজান্তে চোখের ভাষায় কথা বলা প্রাধান্য পেতে থাকলো। দীপা বুঝেও নিজের এ আচরণের স্রোতটাকে বশে আনতে পারেন না। নিজেই নিজের মনকে শাসন করেন আবার নিজের মনের অজান্তেই হয়ে ওঠেন অবাধ্য। ধীরে ধীরে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে স্রোতটা বেশ প্রবল হয়ে ওঠল। রাতের গভীরে চাঁপা কান্নার কষ্ট লুকিয়ে রাখেন। আবার মাঝে মাঝে ভাবেন; এ কী হচ্ছে! এ যে মহাপাপ! এ অবিবেচক কাজে কোনদিন শান্তি আসবে না। অসহায় সন্তানদের মুখগুলো বারবার চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। অজানা ভয় আর আশংকায় দীপার বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে কাঁপে। চোখের জল চোখেই শুকায়। কিন্তু কেন যেন মনটা দিনকে দিন আরও অবাধ্য হয়ে ওঠে। নিয়ন্ত্রণহীন দীপা বেসামাল হয়ে যাচ্ছেন। এতদিন কষ্টের খাদের কিনারা ছিল এক পাশে। এবার উভয় পাশেই গহীন খাদ। চোখ বন্ধ করেই দীপা অনুভব করলেন; দ্বিতীয় খাদের অতলে অনেক কষ্ট নিয়ে চুপচাপ একা শুয়ে আছেন। যেখানে স্বামী-সন্তান কেউ কোনদিন পৌঁছাতে পারবে না। আশা এবং স্বপ্ন ভঙ্গের তাড়নায় ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন দীপা; অসহ্য যন্ত্রণায় দিন দিন নীল হয়ে যাচ্ছেন।
ইদানিং রণজিৎ বাবুও বেশ নিষ্পৃহ। বন্ধুবরেষু সুহৃদ রশীদ সাহেবের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে তেমন কোন কথা বলতে পারেন না। দীপাও আজকাল রণজিৎ বাবুকে প্রায় পুরোপুরিই এড়িয়ে চলেন। এ ক'দিনে রণজিৎ বাবুর চেহারা বেশ মলিন হয়ে গেছে। রণজিৎ বাবুর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সাহস পান না দীপা। সন্তানদের চোখেও যেন নিষ্প্রভতা দেখতে পান। ভেতরের চাপা কান্না লুকানোর জন্য সন্তানদের জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে থাকেন। কিন্তু তবুও কোনরকম শান্তি পান না । মনটা কেমন যেন ছটফট করে। রণজিৎ বাবুর চোখ রাঙানিও দীপা আজকাল তোয়াক্কা করেন না। ধীরে ধীরে ভীষণ অবাধ্য হয়ে গেলেন দীপা।
একদিন সব জল্পনা-কল্পার অবসান ঘটিয়ে রশীদ সাহেবের নীড়ে উড়ে চলে গেলেন দীপা। পেছনে ফেলে এলেন স্বামী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজন আর জন্ম-পরিচিত সমাজ ব্যবস্থার বেড়াজাল। স্বামী-সন্তানদের জন্য মাঝে মাঝে বুকটা খা খা করে। কিন্তু পাষাণে বুক বেঁধে সব চাপা রাখেন। কারণ মানসিক মুক্তির প্রত্যাশায় রশীদ সাহেবের নীড়ে এসেছেন।
রশীদ সাহেবের সাথে দীপার মেশামেশিতে বেশ বাড়াবাড়িই ছিল; তা' কখনও ভালো নয়। সমাজের লোকজন কানাঘুষা করে। রণজিৎ বাবু ভাবতেন এসব নিয়ে; দুর্ভাবনাই করতেন। কিন্তু স্বামী-সন্তান ফেলে রেখে চিরতরে চলে যাবেন তা' কখনও ভাবনায় আসেনি পর্যন্ত। বড় মেয়ে নীতা এবার অষ্টম শ্রেণীতে, মেঝো মেয়ে রীতা ষষ্ট শ্রেণীতে আর ছেলে কুন্তল প্রথম শ্রেণীতে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে রণজিৎ বাবু যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। নীতা এবং রীতা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে যে, ওদের মা আর ওদের কাছে আর কোনদিন ফিরে আসবে না। তাই কারো কাছে কখনও কোন প্রশ্ন করে না। তবে একা হলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে। আর ওদের জড়িয়ে ধরে রণজিৎ বাবুও কান্নায় ভেঙে পড়েন। এছাড়া আর কিছুই করার নেই। কিন্তু কুন্তল অবুঝ বালক। কতক্ষণ পরপর বাবাকে জিজ্ঞ্যেস করে- বাবা, মামণি আসছে না কেন? মামণি কখন আসবে?
রণজিৎ বাবু অবুঝ শিশুকে সান্ত্বনা দেন- তোমার মামণি মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। শীঘ্রই চলে আসবে।
অপেক্ষায় থেকে থেকে অধৈর্য্য হয়ে কুন্তল আবারো বলে- কোথায়? মামণি আসে না তো!
ঠাকুরমা নাতিকে কোলে টেনে নিয়ে নানান গল্প বলেন মায়ের কথা ভুলানোর জন্য। কুন্তল গল্প শোনে, গল্প শোনে। গল্প শোনার মাঝখানে হঠাৎ ঠোঁট বাঁকা করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে- মা! মা! মা!
কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমের কোলে নেতিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে ওঠে খেলাধূলায় মত্ত হয়। লাফালাফি, দৌঁড়াদৌড়ি করে বেড়ায়। আবার মায়ের কথা মনে হলেই ফিরে আসে বাবা অথবা ঠাকুরমার কাছে, জানতে চায়- মা কখন ফিরবে?
*
সময়ের অতল গহীনে দুটো বছর কেটে গেল। দীপা এখন ইয়াসমিন ভূঁইয়া। রশীদ ভূঁইয়ার ঔরসজাত সন্তান নিয়ে ব্যস্ত নতুন জীবন কাটাচ্ছেন। জীবনের পূর্বের অধ্যায় মোটামুটি ভুলে গেছেন। প্রথম প্রথম অসহ্য যন্ত্রণায় কাটিয়েছেন। রাতের আঁধারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। অবুঝ সন্তানদের শূন্যতায় হাহাকার করেছেন। কিন্তু যে অধ্যায় ফেলে এসেছেন তা'তো আর ফিরিয়ে আনার নয়। সময়ের সন্ধিক্ষণে পূর্বের স্বামী-সন্তানদের সরব উপস্থিতি মলিন হয়ে গেল মনের আঙিনা থেকে। নতুন সংসারে এসে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। হাসপাতলের কোয়ার্টারেই জীবন সীমা বেঁধে গেছে।
কুন্তল কাঁদতে কাঁদতে এখন কান্না ভুলে গেছে। মহাকালের কাছে দুটো বছর কিছুই নয় কিন্তু একজীবনে এক সূর্য সমান। কুন্তলের কাছে মায়ের ছবি অনেকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। সে এখন জানে এবং বুঝে ওর মা কাছাকাছিই আছে। কিন্তু আর ফিরে আসবে না। সে ভীষণ অভিমানে বুক বেঁধেছে; মায়ের কথা কাউকে কিছুই বলবে না। এবং মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, দেখা হলেও কথা বলবে না। তবে মাঝেমধ্যে চুপিচুপি ঠাকুরমাকে জিজ্ঞ্যস করে- ঠাকুরমা, মা-কি আর কখনও আমাদের কাছে ফিরে আসবে না?
ঠাকুরমা কুন্তলকে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু সঠিক জবাবে তাকে শান্ত করতে পারেন না। কুন্তল আবার জিজ্ঞ্যেস করে- আচ্ছা ঠাকুরমা, আমাদের ছেড়ে মা ওভাবে চলে গেল কেন? জবাবে কিছু বলতে না পেরে ঠাকুরমা কুন্তলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কষ্টের ভেতর কাটে নির্বাক মুহূর্ত।
আজ হঠাৎ করে কুন্তলের মনটা খুব বেশি রকমের বিষন্ন হয়ে যায়। খেলার মাঠে পর্যন্ত যায়নি। হাঁটতে হাঁটতে সমতল মাঠ পেরিয়ে বাজারে চলে আসে। তারপর কতক্ষণ এলোমেলো ঘোরাফেরা করে। না! মনটা কিছুতেই ভালো লাগছে না। আবার বাড়িমুখো হাঁটা শুরু করে। এবার থানার সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে চলল। দুঃখী চোখ জোড়া মাটিতে রেখেই হাঁটছে। আপন মনে নিজের দুঃখের কথা ভাবছে আর হাঁটছে। থানা পেরিয়ে গোরস্থানের সামনে তারপর এগিয়ে চলল কোয়ার্টারের সামনের রাস্তা দিয়ে। পরিচিত মহিলা কন্ঠ ভেসে আসতেই কুন্তল ফিরে তাকায়। কয়েজন মহিলার আশেপাশে কতগুলো ছেলেমেয়ে খেলাধূলা করছে। একজোড়া চোখে গিয়ে কুন্তল থেমে গেল। মায়ের মুখটা চিনতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। কুন্তল দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক হয়ে। পলকহীন চোখে মাকে দেখছে। চকিতে মায়ের দৃষ্টিও কুন্তলের দৃষ্টিসীমায় আটকে গেল। কুন্তলের গভীর দৃষ্টি মা দীপা বর্মণের বুকের ভেতরটা মুহূর্তের ব্যবধানে ওলটপালট করে দিল; চোখের পাতায় ভেসে ওঠল ফেলে আসা কথকতা। ইচ্ছে হচ্ছে দৌঁড়ে গিয়ে কুন্তলকে জড়িয়ে ধরে হাজারটা চুমোয় ভরিয়ে দিতে। কিন্তু একটা অদৃশ্য দেয়াল দীপার দৃষ্টিকে ক্রমশঃ সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। চেপে রাখা কষ্টগুলো বেশ নড়েচড়ে ওঠছে। কুন্তল পলকহীন তাকিয়েই আছে; মা ডাক দিলেই এক দৌঁড়ে কোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ভাব। কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেয়েই মা দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মা দৃষ্টি সরিয়ে নিলেও কুন্তল তাকিয়ে আছে। সে আশ্চর্য হচ্ছে; মা তাকে চিনতে পেয়েও ডাক দেয়নি। একটা ছোট্ট মেয়ে-বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চলে গেল। কুন্তলের বুক ভরা অভিমান মুহূর্তেই মনের আকাশে ছড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের পথ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মাকে দেখতে পেল না। তারপর বাসার পেছনের ছোট ঝোপে লুকিয়ে বসে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাসাটার ভেতরে তাকাল- ঐ তো দেখা যাচ্ছে, মা ছোট মেয়েটিকে কত আদর করছে। একটু পরপর লুফে নিচ্ছে আর চুমু খাচ্ছে!
এ দৃশ্য অনেকক্ষণ দেখল কুন্তল। যতই দেখছে তার অভিমান আরও গাঢ় হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর মায়ের এই অবহেলা দেখে। একবার তাকায়নি পর্যন্ত! অভিমানে ঠোঁট জোড়া ফুলে ওঠল কুন্তলের। সে মনে মনে নিজের সাথে কথা বলল- আমাকে একটুও আদর করলো না। আমি আর কোনদিন কথা বলবো না।– এই ভেবে অভিমান ভরা বুকে কুন্তল বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। এরপর থেকে আর কোনদিন ওর মায়ের কথা ঠাকুরমাকে কখনও জিজ্ঞ্যেস করেনি। অভিমান মনের মধ্যে পুষে রেখে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। যেমন পাচ্ছে ওর মা দীপা বর্মণ।
শেষ
রচনাকাল: ১১.০৭.১৯৯৬, জগন্নাথ হল, ঢাবি.
প্রকাশিত: সঞ্চারী, আগষ্ট-সেপ্টে, ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা