"কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোলো
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো"
কৈশোরেই মানব মনে প্রথম অনুভূত হয় প্রেমের। প্রেম জনিত এই আবেগ কেউ কেউ আরো আগে মানে শৈশবেই অনুভব করতে পারে তবে সে অনুভবের অর্থ তখন জানা থাকে না, বুঝতে পারে না যে ওর নাম প্রেম তখন শুধুই ভালোলাগা থাকে। এরপর শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করলে সহপাঠী, পাড়ার খেলার সাথী কিংবা পরের গলিতে বাস করে এমন কেউ যাকে দেখলে মনে খুশি খুশি লাগে আবার কেমন জানি লজ্জাও হয়, ইচ্ছে হয় এগিয়ে এসে দু চারটা কথা বলুক আবার দেখে ফেলতে পারে এই ভয় নিজেকে লুকিয়ে ফেলতেও ইচ্ছে হয়। আর তাই তো গানে বলে,'গোপনের প্রেম গোপনে গিয়েছে ঝরে,আমরা দুজনে কখন গিয়েছি সরে।'
কৈশোরের এই প্রেমগুলোর বেশিরভাগই তেমন কোনো পরিণতি পায় না তবে একটি চারা গাছ যখন মাটি ভেদ করে অনুভব করতে পারে বসন্তের প্রথম আভাস তেমনি জীবন জুড়ে থাকে এই প্রথম প্রেমের বাতাস আর তার অনুভব থেকে যায় হৃদয়ের গহীন খাঁজে। পৌঢ়ত্বে সে সব স্মৃতি হয়তো কখনো কখনো মনচিত্রে ভেসে ওঠে। অস্ফুট স্বরে মন বলে, আহা! 'কিশোর বেলার সেই হরিণী।'
শুরুতেই কৈশোরকালীন প্রেম নিয়ে এত কথা বলছি কারণ আজ যে বইটি নিয়ে আলোচনা করবো তা এমনই একটি কৈশোরের প্রথম প্রেমের গল্প। সোভিয়েত কথাসাহিত্যিক রুভিম ফ্রেয়ারম্যান রাশিয়ার প্রেক্ষাপট, সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ আর সেই সাথে কৈশোরের প্রেম নিয়ে রচনা করেছেন 'ডিঙ্গো' উপন্যাসের প্লট। বার্চের ডালে তুষার লেগে থাকা, সিডারের ঘন বন, ফুটে থাকা মার্শলিলি আর আইরিস ফুল, পাইন গাছ, বেরীর ঝোপ, বল্গা হরিণ, স্লেজগাড়ি এতসব প্রাকৃতিক বর্ণনাগুলো পড়তে পড়তে কল্পনার চোখে ভেসে উঠে সে সব। তুষার ঝড়ের সময় আলাদা করা যায় না কোনটা নদী আর কোনটা আকাশ সামনের সব ঢেকে যায় সাদা কুয়াশায় এমন ভাবেই লেখক বর্ণনা করেছেন যে ষড়ঋতুর দেশে বসেও যেন অনুভব করা যায় বরফ শীতল আবহাওয়া আর তুষারের ছোঁয়া। উপন্যাসে প্রাকৃতিক বর্ণনাগুলো লেখক নিশ্চয় এ ভাবনা থেকে দিয়েছেন যে, কৈশোরে এসব ছোটোখাটো প্রাকৃতিক জিনিসগুলোই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়, বৈষয়িক ভাবনা তেমন থাকে না বলে প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দেয়া সহজ হয় আর তখন প্রেমে পড়ার অনুভূতির ফলে প্রকৃতির ভেতরে প্রেমের সেই সৌন্দর্যগুলো ফুটে উঠে।
তানিয়া আর ফিল্কা সহপাঠী। একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা, ফিল্কা ছাড়া তানিয়া যেন অসহায়। সব বিপদে প্রথম মনে হয় ফিল্কার কথা আর ফিল্কাও তানিয়ার জন্য পিঁপড়ের শরবত, কাঁচা মাছ সংগ্রহ করে। তানিয়ার মন খারাপ হলে নিজেকে বোকা প্রমাণ করে ক্লাসে ভুলভাল তথ্য বলে যেন তানিয়ার মুখে ফুটে উঠে একটুখানি হাসির রেশ। তানিয়াকে কষ্ট দিতে ফিল্কার ভালো লাগে না তাই পুরো মানচিত্র জুড়ে মারোসিকা নামের দেশ খুঁজে না পেলেও বলে, ' আলবাত মারোসিকা নামে দেশ আছে। আমি জানি তো। এই পুরোনো মানচিত্রটা কোনো কাজের নয়। সবকিছু নেই এতে। আমার পষ্ট মনে আছে, ইশকুলে মারোসিকা পড়ানো হয়েছে।' তানিয়াও বুঝতে পারে ফিল্কার বলা মিথ্যাটুকু তবুও শান্তি পায় এ মিথ্যা শুনে। বুঝতে পারে সত্যিকারের বন্ধু বলে কিছু আছে তবে। ফিল্কা সামান্য বিষয় নিয়েও তানিয়ার সাথে গল্প করে। তানিয়া আর ফিল্কার মাঝে চলে আসে কলিয়া নামক একটি ছেলে। প্রথমে কলিয়ার প্রতি তানিয়ার এক ধরণের ক্ষোভ ছিল এর অন্যতম কারণ হলো কলিয়া তানিয়ার বাবার দত্তক নেয়া সন্তান। ছোটোবেলা থেকে তানিয়া বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত মায়ের সাথে ডিভোর্স হওয়ার ফলে। সেই বাবা ফিরে আসেন তার বর্তমান স্ত্রী ও কলিয়া সহ। বাবার নতুন বাসবভনে তানিয়া যায় কিন্ত কলিয়াকে দেখে মনে হয় বাবার সব ভালোবাসা কলিয়া নিয়ে নিয়েছে। তবুও সময়ের পালাক্রমে ও ঘটনার প্রেক্ষিতে বন্ধু থেকে কলিয়া ভালোবাসার মানুষ বনে যায়। ফিল্কার তানিয়ার জন্য কতো কী করা, তানিয়ার কীসে সুখ, কীসে দুঃখ এসব ভাবার পরও, এত কিছু করার পরেও যখন কলিয়াকে তানিয়া ভালোবেসে ফেলে তখন বাবার প্রতি তানিয়ার রাগ প্রশমিত হয়, সে বুঝতে পারে বাবার বিষয়টি আর তখন বাবাকে বলে, 'বাবা,প্রিয় বাবা! ক্ষমা করো আমায়। তোমার সাথে কত রাগ করেছি। কিন্তু এখন আমি বুঝি। এটা তোমার দোষ নয়। এখানে দোষ না আছে আমার, না আছে তোমাদের, না মায়ের। পৃথিবীতে কত মানুষই আছে যাদের ভালোবাসা যায়! তাই না বাবা?'
এই উপন্যাসে স্কুলের শিক্ষিকা আলেকসান্দ্রা ইভানোভনাকে দিয়ে কৌশলে লেখক সাম্যবাদ প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন। যেমন বছর শুরুর ক্লাসের প্রথম দিনে আলেসান্দ্রা মঞ্চে উঠেই আবার নিচে নেমে পড়লেন আর মনে মনে বললেন, ' যদি রঙিন চার টুকরো কাঠ তাকে অন্য সবার চেয়ে উঁচুতে তুলে আনে, তাহলে" সব মানুষের পৃথিবী " আর রইল কোথায়!' তাই তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে চলে এলেন যাতে দূরত্ব ঘুচে যায়। উপন্যাসের শেষে এসে তানিয়া আর ফিল্কার কথোপকথনে হৃদয়ে এক ধরণের মিহি বেদনা অনুভব হয়। সেই বেদনা হয়তো পাঠকের মনে জাগাতে পারে কৈশোরের প্রেমের স্মৃতি। আর এমন একটি প্রেমের উপন্যাসের নামকরণ কেনো ডিঙো তা আর বলছি না কারণ সে কথা জানতে আর না বলা আরো বিস্তারিত বিষয় জানতে পাঠক পাঠ করতে পারেন এই বইটি। এই উপন্যাসটি নিয়ে 'Dikaya sobaka Dingo' নামে ১৯৬২ সালে ইউলি কারসিক এর পরিচালনায় রুশ ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল।
উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শামসুদ্দোহা তৌহীদ। এই বইয়ে রুভিম ফ্রেয়ারম্যান বেশিরভাগ বর্ণনায় কাব্যিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। অনুবাদকও চেষ্টা করেছেন সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে। যেমন দুটো লাইন উদ্বৃতি দিচ্ছি যখন তানিয়া জানতে পারে তার বাবা আসছে সেই সময়ে তানিয়ার মনের অবস্থার বর্ণনা এমন, " আনন্দ ধরে না তার মনে, এ কি ব্যাধের তৃপ্তি শরবিদ্ধ হরিণ দেখে, নাকি তেষ্টা পাওয়া পথিকের স্ফূর্তি এক গেলাস ঠান্ডা জলে?"
আবার কোথাও কোথাও মনে হয়েছে অনুবাদক ইচ্ছে করেই একটু পুরোনো ধাঁচের শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন হয়তো উপন্যাসের সময় ও প্রেক্ষাপট চিন্তা করে। অনুবাদের ভাষা প্রাঞ্জল। আশাকরি বইটি পরে পাঠকের ভালো লাগবে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে পেন্ডুলাম থেকে ২০২৩ সালে। এর মুদ্রিত মূল্য মাত্র ৩৫০ টাকা।