এখন এখানে শেষ শ্রাবণের পূর্ণ চাঁদ আর লোডশেডিং সাথে নিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে চুপি-চুপি রাত নামে। একেক বাড়িতে সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত একেক রকম। যে কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঠাহর করলে ঠিক টের পাওয়া যাবে- কোনো নির্জন বারান্দায় সন্ধ্যা নামে ঘোর বিষণ্নতায়, কোনো বাড়িতে খুব কোলাহলে আর কোথাও ‘মুখোমুখি দু’জন কিন্তু মাঝখানে অনেকটা বারণে’ সন্ধ্যা নামে। যেমন— নব্বইয়ের দশকের মধ্যবিত্তের নস্টালজিয়া আক্রান্ত সন্ধ্যা। বাড়ির বাচ্চারা পড়তে বসো রে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাজার থেকে হাঁকডাক করতে করতে পুরুষেরা বাড়ি ফিরে আসো রে; বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘরে ঘরে আলো দাও রে; কুপি-হারিকেন-চার্জার লাইটের আলো-আঁধারিতে সাপলুডু, শীতল পাটি পেতে জ্যোৎস্না অথবা ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী; মায়েদের গল্প আর একে অন্যের কানাকানি সমালোচনা; অন্য কোথাও সন্ধ্যের মুখে বনবিড়ালের চুরি করে নিয়ে যাওয়া সদ্য ডিমফুটে বের হওয়া মুরগীর বাচ্চা। আরো কত কি!
ক্ষুধায়, দারিদ্র্যে, আগামিকালের দুঃশ্চিন্তায়, কপালের ভাঁজে ভাঁজে, বিত্ত-বৈভবে সন্ধ্যা নামে নানান রঙে৷ বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার টানাপোড়েনের গভীরে সাধারণ মানুষের দুর্গতি যেমন প্রচ্ছন্ন থাকে, তেমনি সন্ধ্যা নেমে রাত হওয়া অব্দি সময়টা ইভেন্টফুল, ক্রুশাল লাগে আমার কাছে।
এখানে জানালার একপাশে পিডিবির বিস্তৃত খোলা জমি। অগভীর দীর্ঘ পুকুর পার হয়ে অদূরেই গাছপালা ঘেরা পলেস্তারা খসে যাওয়া ক’খানা ঘর। দেয়ালজুড়ে আগাছা আর শ্যাওলার দল। সারা দিন-রাত মিলিয়ে হাতেগোনা গুটিকয়েক মানুষের আনাগোনা। পুকুরের পাড়ে সব সাদা রঙের ছাগল ঘুরে ঘুরে সবুজ ঘাস খায়। মধ্যদুপুরের নির্জনতায় এতগুলো সাদা ছাগলের সবুজ ঘাস খাওয়ার দৃশ্য কেমন সুররিয়েল লাগে! সন্ধ্যা নামতে নামতে জায়গাটা আরো শুনশান হয়ে যায়। এখানে এমন ‘চুপি-চুপি রাত নেমে এলে, কে যেন আবার হেঁটে চলে যায় খালি পায়। মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়ের রাতে, ঠিক বেজে ওঠে জেরেমির বেহালা। যেন পাড়াপড়শিরা সব্বাই জানে ওই পোড়ো বাড়িটায় অঞ্জনের সেই কালো সাহেবের ভূত। হারানো সে সুর শুনতে চাইলে, বাজাতে চাইলে মনের বেহালাটা, চলে এসো তুমিও এই কালি ঝুলি মাখা পোড়ো বাড়িটায়।’
বাড়ির অন্যপাশে আরেকটা জলাশয়, তুলনামূলক আকারে ছোটো। পাড়ে ততধিক ছোটো একটা বাঁশঝাড় আর অদূরে টিনের একচালা ঘরে দু’টো পরিবার। এইসব দৃশ্যের জন্মের শীতলতা যেন আমার গায়েও লাগে। দূর্মূল্যের বাজারে ‘গ্রাটিফিকেশন অব ইমপালস’র জন্যই হয়তোবা একা মানুষের সংসারের বাজারের সাথে তিনটে ড্রাগন ফল, দু’টো কিউই আর চারটে পেয়ারা কিনে বাড়ি ফিরি। পড়ন্ত বিকেলে টকটকে ওয়াইন কালারে কালিজিরা ছড়ানো ড্রাগন ফল সাদা প্লেটে কেটে রেখে ভাবি, এরচেয়ে বরং শাহজাদী আপার বুড়ো বয়সের ছোটো মেয়েটার স্কুল ড্রেস বানাতে দিয়ে এলাম যেদিন, মেয়েটা যেদিন ড্রেস পরে বেণি দুলিয়ে স্কুলে গেলো সেই দৃশ্য ঢের তৃপ্তিকর। কাজের ফাঁকে এসে আর ডাকাডাকি করবে না: “মা স্কুল থেকে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।” এভাবে চারপাশে যেন আয়েশের কাছে মৌলিক চাহিদার কেবল-ই নগ্ন পরাজয়; পরিমাণের কাছে উৎকর্ষতার আর স্থূলতার কাছে সূক্ষ্মতার। এইসব স্রোতের বিপরীতে একা চলা যায় কি? বিশেষত যখন মানুষের সবক্ষেত্রে অবক্ষয় এসে গেছে?
উত্তরবঙ্গের প্রসিদ্ধ গরমে প্রথম প্রথম সাতকাহনের দীপাবলির সেই নে-খালি গ্রামের কথা মনে পড়তো। যেখানে ইলেক্ট্রিসিটি থাকতো না প্রায়ই, অনাবৃষ্টি, খরা আর তীব্র দাবদাহে চারপাশে কেবল এক ফোঁটা সবুজের সম্ভাবনাহীন রুক্ষতা। যেন যেকোনো সময় দরজায় কড়া নেড়ে প্যাঁচপেঁচে হাসি দেবে অর্জুন নায়েক, খবর দেবে উন্নয়ন আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির। ধীরে ধীরে অবশ্য গরমের অনুভূতি নির্লিপ্ততার মতো সয়ে গেছে। ‘নির্লিপ্ততা যেমন প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বস্তি দেয় কিন্তু একবার অভ্যেসে এসে গেলে বিস্তর ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। চারপাশে যা হচ্ছে হোক, জীবন জীবনের মতো চলুক এর মতো।’ অবশ্য দু’দিন থেকে কিছুটা ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে। মানুষের এই নিরন্তর অ্যাডাপটেশন ক্ষমতাও ভুলিয়ে দেয় না যে— সবকিছুরই একটা সীমা রয়েছে। প্রকৃতি-পরিবেশের সাথে মানুষের যত যথেচ্ছ বৈরী আচরণ তারও। অন্যের জন্যে খোঁড়া গর্তে নিজের পতন যেমন শেষ মুহূর্তে ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টের পায় না মানুষ। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্তের ছয়টি দেয়াল ভেঙে পড়ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে সব স্বতন্ত্রতা। যেন সব এক রং, এক ধাঁচ।
এবারে হয়ত আর শরৎকালের আকাশ দেখার অপেক্ষায় অনন্তনীল সকাল হবো না। মৌসুমী ভৌমিকের অনন্যকে যেন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোত্থাও— ‘চারিদিকে এত শব্দ, এত চিৎকার তবু কী নিদারুণ দৈন্য!’