যে কথা হয়নি বলা তোমাকে ছুঁয়ে
▪ পার্থসারথি
*
চোখে চোখ পড়তেই স্বাগতা মুম ও নিরুপম পলকহীন আর ভাষাহীন মুহূর্তে ডুবে গেল। চোখে চোখে দু'জন ডুবে গেল এক অজানা ভুবনে। যেখানে শুধু ঘাস-ফড়িং-এর দুর্দান্ত ছোটাছুটি, প্রজাপতির পাখায় পাখায় আনন্দের রঙ আর আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ওপর ভালোলাগার ছড়াছড়ি। এই কয়েক মুহূর্তেই যেন দু'জন দু'জনার মনের ভেতর হাবুডুবু খেতে খেতে ভালোবাসার বনভূমিতে চিত্রল হরিণ সেজে গেছে।
স্বাগতা মুম নিজেকে সামলে নিয়ে লাজুক হেসে নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। আর নিরুপম দৃষ্টি জোড়া মেলে দিলো শান্ত আকাশে। আহ! অজানা শিহরণে নিজেকে মাখিয়ে এখন যেন ভীষণ ক্লান্ত নিরুপম। সুখের ক্লান্তিতে নিজেকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিরুপম এখন অন্যভুবনের বাসিন্দা। সুখের অনুরণনে নিজেকে ডুবিয়ে ডুবিয়ে সুখ নিংড়ে নিচ্ছে সে। চোখ জোড়ার ভেতর ছিল ভালোবাসার রঙ, রঙে ছিল সুখ মাখামাখি আর এই সুখেই ডুবতে চাচ্ছে আজীবনের জন্য। স্বাগতা মুমকে আরও এক পলক দেখার জন্যে নিরুপমের চোখ জোড়া এদিক-ওদিক খুঁজছে। কিন্তু ছাদবাগানে সে নেই। নিরুপমের দৃষ্টি জোড়া ছাদবাগানের ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ, এই এখন এই বাগানটাকে যেন স্বর্গ মনে হচ্ছে নিরুপমের কাছে। এখনও জানালার পাশে চুপটি করে বসে আছে আর মনের ভেতর ভালোবাসার মানুষটি এখনও তোলপাড় করে যাচ্ছে। এ এক অন্যরকম ভালোলাগা। যেখানে স্বর্গীয় সুখেরা সবসময় লুটোপুটি খায় আর ভালো লাগায় দোলায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিরুপম মনের ভেতর এঁকে নেয় ভালোলাগার অনুভূতিটুকু...
প্রিয়তমা, তোমাকে দেখার পর-
আমার মনের আকাশ রঙিন হয়ে গেছে
মন-বাগানে খেলা করে বসন্তের এলো হাওয়া
পৃথিবীর সকল ফুল খুবই আপন আমার কাছে
মনে হয় সকল গান দোয়েল পাখির গাওয়া।
প্রিয়তমা, তোমাকে দেখার পর-
পূর্ণিমার রাত চাঁদের আলোয় ছাওয়া
সকাল-দুপুর-বিকেল কিংবা অন্য সকল বেলা
তোমার মনের গহীন বনে চুপি চুপি যাওয়া
তুমি প্রিয়া মেঘ ডেকো না, হবে শুধু মনকে নিয়ে খেলা।
প্রিয়তমা, তোমাকে দেখার পর-
মনের উঠোন অগোছালো শিউলি ফুলের মেলা
হৃদয় বাগান সেজেছে আজ লক্ষ গোলাপ এসে
পাখির ডানা ফিরছে ঘরে এখন গোধূলী বেলা
মনের আকাশ ওঠছে হেসে মেঘের কোলে ভেসে।
প্রিয়তমা, তোমাকে দেখার পর-
আমার সময় আমার কাছে তোমায় শুধু দেখা
রঙধনুর সাত রঙে তাই আমার স্বপ্ন বোনা
তুমি আছো আমার পাশে নইকো আমি একা
সকল সময় হচ্ছে আমার ভ্রমর-গান শোনা
ক্ষণে ক্ষণে প্রজাপতি দিচ্ছে আমায় দেখা।
প্রিয়তমা, তোমাকে দেখার পর-
বেঁধেছি আমার ঘর মনের ভেতর
ভ্রমর গানের সুরে,
রাতের আকাশ তারায় ঢাকা তারার ভেতর
তুমি থেকো আমার মনে এমনি করে
আমি না-হয় ভেবেই যাবো পুরো জীবনভর।
*
স্বাগতা মুমকে দেখার পর থেকেই নিরুপম যেন এখন অন্যজগতের বাসিন্দা- চোখের তারায় তারায় ওই মুহূর্তটুকু সুখ ঢেলে দেয়। চোখ জোড়া যেন বারবার কাছে ডাকে।
সূর্যটা হেলে পড়েছে অনেকক্ষণ। নিরুপম অধীর আগ্রহে জানালার পাশে চুপচাপ বসে আছে। আর দৃষ্টি জোড়া ওই ছাদপানে। প্রিয়তমা স্বাগতা মুম এখনও আসছে না। নিরুপম অপেক্ষায় আছে আর আপনমনে ভাবছে কখন আসবে তার মনের মানুষটি- সত্যিই মনের এবং প্রাণের মানুষ। চোখে চোখে কথা হয়েছে কয়েক যুগের না-বলা কথা। যেন দু'জন দু'জনার লক্ষ-কোটি বসন্তের বাগানের একজোড়া লাল গোলাপ। নিরুপমের দৃষ্টি এলোমেলোভাবে স্বাগতার বাগান জুড়ে মনে মনে হাঁটছে আর ভালোবাসার কথা ভাবছে।
বাগানে নানান ফুলের ছড়াছড়ি। আর ফুলে ফুলে ভ্রমরের ওড়াউড়ি যেন সময়কে চঞ্চল করে তুলছে। সাথে সাথে নিরুপমের দৃষ্টিজোড়া যেন অশান্ত হয়ে খুঁজছে প্রিয়তমার উপস্থিতি। বাগান আছে, ফুল আছে, আছে ভ্রমরের ওড়াউড়ি... সব আছে শুধু নেই সে। যে আসলে সব সার্থক হবে। সার্থক হবে এই অপেক্ষার পালা। নিরুপমের অপেক্ষা... অপেক্ষা... অপেক্ষা... আর ডুবে থাকা মনের চঞ্চলতায়।
হঠাৎ লাল-হলুদ রঙে মাখামাখি প্রজাপতিটা নাকের ডগায় বসেই আবার উড়ে চলে গেল। আর প্রজাপতির উড়ে-চলা পথ হেঁটে হেঁটে নিরুপমের চঞ্চল দৃষ্টি জোড়া চলছে। প্রজাপতি এখন উড়ছে স্বাগতা মুমের দৃষ্টি সীমানায়। নিরুপম আনন্দে আত্মহারা- ভালোবাসার চুমোয় চুমোয় প্রজাপতিকে যেন আরও রাঙিয়ে তুলল। প্রজাপতি এবার বসল স্বাগতা মুমের ফুল-ছোঁয়া অঙ্গুলিতে- বসেই আবার উড়াল। ওর দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে চলল- প্রজাপতিটা আবার উড়ে এলো নিরুপমের কাছে। এক আশ্চর্য ভালোলাগায় দু'জনার দৃষ্টিযুগল আবার একত্র হলো তবে এক মুহূর্তের জন্যে। মায়ের আচমকা ডাকে স্বাগতা ফিরে তাকায়- কিছু বলবে মা?
এদিকে এসো। দেখো, এই ফুল গাছটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক আছে মা, আমি যত্ন নেব। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আচ্ছা, খেয়াল রেখো।– এই বলে মা গাছটায় একটু জল ঢেলে দিলেন। তারপর আবারও গাছে গাছে জল ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। আর স্বাগতা মুম মায়ের ওপর সাবধানী দৃষ্টি রেখে রেখে নিরুপমের দৃষ্টিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ভালোবাসার খুশীর রঙ মনের ভেতর মেখে মেখে বারবার লুণ্ঠিত হচ্ছে ইচ্ছের সাগরে ভেসে ভেসে। স্বাগতা মুম ইচ্ছে করলেই আর নিজেকে সামলাতে পারছে না; এক অজানা মোহে, ভালোলাগার টানে বারবার ফিরে ফিরে যাচ্ছে নিরুপমের দৃষ্টি সীমানায়। যেখানে ছড়িয়ে আছে ভালোলাগার মুহূর্ত, প্রজাপতির উড়ে চলা আনন্দঘন চঞ্চলতা আর নীড়ে ফেরা পাখিদের ডানায় ডানায় ভরপুর সুখ। ভালোলাগার মুহূর্তে নিজেকে রাঙিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। যেখান থেকে ফিরে চলে আসা একেবারেই অসম্ভব। দু'জন দু'জনার মনে এবং প্রাণে গেঁথে গেছে এক অজানা সুখে। মনের ভেতর সুখ রাঙিয়ে দু'জন আজ এক বাগানের ফুল। গোধূলি লগ্নে চলে যাবার সময় স্বাগতা মুম এক ঝলক হাসির রঙ ছড়িয়ে নিরুপমকে ভাসিয়ে গেল। নিরুপম আনন্দের বন্যায় হবুডুবু খাচ্ছে...
তোমার দেখা না পেলেই-
কষ্টগুলো মিছিল করে
বুকের পাঁজরে হাঁটে;
আঘাতে আঘাতে আমি নীল হয়ে যাই।
তোমার দেখা না পেলেই-
চোখ দুটো উৎকন্ঠায়
ভীষণ অধীর হয়ে ওঠে;
পথ হারিয়ে আমি একা হয়ে যাই।
তোমার দেখা না পেলেই-
কষ্টগুলো উচ্চমানের পুষ্টি পেয়ে যায়;
কষ্টের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে
আমার উচ্ছ্বাস ব্যথার ছোঁবলে চুষে নেয়।
তোমার দেখা না পেলেই-
গোধূলীর প্রাণকাড়া পাখির কলকাকলি,
শুভ্র মেঘে মেঘে শরতের খেলা,
ভালোবাসার চঞ্চলতায় ফাগুনের ছবি,
জোড়া-শালিকের ঠোঁট ছোঁয়া মুহূর্ত,
সবকিছুই অতি সাধারণ হয়ে যায়।
তোমার দেখা না পেলেই-
যুগ যুগ বেঁচে থাকার ইচ্ছের মৃত্যু হয়,
মিছিলের কথা বেমালুম ভুলে যাই;
ভুলে যাই নিজেকে নিজের অবহেলায়।
*
ক্ষণ যায়, দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়- নিরুপম আর স্বাগতা মুমের ভালোবাসায় রঙ ছড়ায়। চোখে চোখে কথা হয়, কথা হয় ভ্রমরের গানে গানে। একজনের মনের কথা প্রজাপতি পৌঁছে দেয় অন্যজনের মনে। ভালোবাসার বলয়ে ওরা এখন সুখপাখি। কিন্তু কাছাকাছি হয়ে, পাশাপাশি বসে, হাতে হাত রেখে কথা বলা হয়নি এখনও। এখনও হয়নি দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে আলাপন। দুঃসহ করোনাকালীন সময়টা সত্যিই নিষ্ঠুর- ঘরের ভেতর বন্দী করে রেখেছে। সাথে সাথে বন্দী হয়ে আছে মানুষের জীবন। ওরাও নিরুপায় হরিণীর মতো ছটফট করছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। দৃষ্টিতে হেঁটে হেঁটেই চলছে ওদের সুখের ও প্রেমের আলাপন। দু'জনই বুঝে গেছে যে, ওরা পরস্পরের ভালোবাসায় নিমগ্ন। ভালোবাসা নামের এক অজানা সমুদ্রে ওরা রঙিন প্রজাপতি। চোখের ভাষায় ভাষায় ওরা আকাশে রঙ ছড়ায়। মনের ভেতর ফুটিয়ে তুলছে সুখের আলপনা। নিরুপম মনের রঙের রঙতুলিতে এঁকে নিলো এক মহাকাব্য। মহাকাব্যের কথকতা প্রিয়তমা স্বাগতা মুমকে জানাবে বলে এক টুকরো কাগজের বুকে রঙিন পেন্সিলে এঁকে দিলো মনের আলাপন...
প্রিয়তমা-
যেদিন থেকে তুমি
আমার খুব কাছের মানুষ হলে
সেদিন থেকেই যাবতীয় খুচরো সুখ সঞ্চয় করছি।
বলাতো যায় না-
গগনের অনন্ত বুক থেকে
শুভ্র মেঘ কখন উধাও হয়ে যায়,
পাখিদের ধর্মঘট
শুরু হতেইবা কতক্ষণ
প্রেক্ষাপট সৃষ্টির কোন সীমাবদ্ধ ঋতু নেই।
প্রিয়তমা-
ইচ্ছে হয়
হাজারটা চুমু খাই,
তবু বাসনার বুকে আঘাত হেনে
খুচরো সুখের সঞ্চয় বাক্স খুলে
যা হয় কিছু রেখে দিই।
সবইতো তোমার-আমার
নিতান্ত একান্ত যদিও নয়
তুমি এবং আমিইতো বিশ্বজগৎ,
তুমি কি পারবে না
খুচরো সুখের সঞ্চয় বাক্সে
তীব্রতার চরমসীমা লঙ্ঘন করে কিছু রাখতে?
ইতি- তোমার নিরুপম।
ইশারা করতেই স্বাগতা মুম দেয়ালের কার্ণিশে এসে দাঁড়ালো। হৃদয় নিংড়ানো কথার জালে আঁকা মহাকাব্যের চিঠিখানা ছুঁড়ে দেয় স্বাগতা মুমের ছাদবাগানে সে। চিঠিখানা হাতে নিয়েই স্বাগতা মুম চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় নিরুপমের চিঠিখানা। দু'জনার খুশিতে আর আনন্দের জোয়ারে যেন বাগানময় পায়চারি করছে রঙিন প্রজাপতিরা। আর গুনগুন করে ভালোবাসার অনুরণন ফুলে ফুলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভ্রমর। নিরুপমের আনন্দে ফুলেরা বাগানে দোল খাচ্ছে যেন জোছনার আকাশে তারার মেলা মিটমিট করে জ্বলছে। আনন্দের বন্যা সামলাতে স্বাগতা মুম চোখের ইশারা টেনে বলল- নিরুপম! তোমার-আমার ভালোবাসা চির অম্লান। আমি তোমার বুকে শান্তির নীড় তৈরি করে আজীবন বেঁচে থাকতে চাই।
নিরুপম চোখের ইশারায় প্রজাপতির রঙ ছড়িয়ে মনের কথা জানিয়ে দিলো।
*
এক সপ্তাহ পর...
নিরুপমের কাছে পুরো পৃথিবীটাই যেন স্থবির হয়ে আছে। স্থবির হয়ে গেছে প্রতিটিক্ষণ... প্রতিটি মুহূর্তের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে চলে কষ্টের লুটোপুটি। পুরো এক সপ্তাহ হয়ে গেল স্বাগতা মুমের কোন দেখা নেই। সেই যে চিঠিটা দেয়া হলো তারপর আর দেখা নেই। চিঠি পেয়ে কি সে মনে কষ্ট পেয়েছে?- নিরুপম মনে মনে ভাবছে। আবার স্বগোক্তি- এমনতো হবার কথা নয়। চিঠি পেয়ে সে তো আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। তাহলে?
নিজেকে সামলাতে সামলাতে নিরুপম একেবারে বিপর্যস্ত। বিপর্যস্ত মনেই লকডাউনকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নিরুপম। ওরা এই এলাকায় নতুন এসেছে আর স্বাগতা মুমদের বাসাটা পাশাপাশি হলেও উল্টোমুখের গলি দিয়ে যেতে হয়। নিরুপম বাসাটা ঠিকই খুঁজে পেয়ে যায়। কিন্তু! এ বাসার কাউকেতো সে চেনে না। তাই বাসার সামনেই কিছুক্ষণ পায়চারি করে। অতঃপর বুদ্ধি এঁটে বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞ্যেস করে। বাগানের কথা বলতেই দারোয়ান বলে- স্বাগতা'দির কথা বলছেন?
নিরুপম উৎফুল্ল হয়ে বলে- ঠিক, একদম ঠিক!
নিরুপায় নিরুপম আর কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে আলাপে আলাপে জানতে পারলো স্বাগতা করোনায় আক্রান্ত এবং এখন খুবই খারাপ অবস্থা। হাসপাতালে ভর্তি আছে।
নিরুপম নির্বাক; ভাষাহীন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
দারোয়ান জানতে চায়- কিছু বলবেন?
নিরুপম নির্বাক!
কিছু বলতে হবে উনাদের?- দারোয়ান আবারও জানতে চায়।
সে চুপচাপ। আর মনে মনে ভাবছে- বলারতো আছে অনেক কিছুই। কিন্তু! কোন উপায় নেই এই মুহূর্তে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা এ্যাম্বুলেন্স এসে গেইটের সামনে থামলো। বিপর্যস্ত এক ভদ্রলোক এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামলেন। সাদা মাস্ক পরা। তবে স্পষ্টতঃই কষ্টের ছাপগুলো কপালে লেপটে আছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। নিরুপম হতবাক এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই মুহূর্তে কী করবে কিছুই বুঝে ওঠতে পারছে না। এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার নেমে এসে দারোয়ানকে যেন কী বলল। তারপর দারোয়ান ইন্টারকমে কথা বলল।
পরিবেশটা বেশ থমথমে। দারোয়ান এগিয়ে এসে নিরুপমকে বলল- উনি স্বাগতা'দির বাবা।
এলোমেলো হাওয়ার ভেতর নিলয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মুহূর্তেই গগনবিদারী চিৎকারে বাতাস দুঃখের হাওয়ায় কাঁপাতে কাঁপাতে একজন মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নামছেন। মনে হচ্ছে স্বাগতার মা। বেশ বেসামাল... কিন্তু সামলাবার মতোও পাশে কেউ নেই। এসেই ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন- আমার স্বাগতা কোথায়!
ভদ্রলোক নিজেকে সামলে স্ত্রীকে আগলে ধরে এ্যাম্বুলেন্সের কাছে এলেন। নিরুপম অবচেতন মনে ওদের কাছে এগিয়ে এল।
লাশের মুখমণ্ডল থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়েই মা-বাবা দু'জন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ওদের সামলাতে কেউ নেই। দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। নিরুপম এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর ভেতর জগৎ কান্নার জোয়ারে ওলট-পালট হচ্ছে প্রতিক্ষণ। কিন্তু কাঁদবার মুহূর্ত ওর কাছে অদৃশ্য। চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে- ভাষাহীন কষ্ট; পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম কষ্ট। পাথরচাপা কষ্ট বুকে ধারণ করে নিরুপম স্বাগতার মা-বাবাকে সামলাতে চেষ্টা করে। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে সবাই কিছুটা শান্ত হয়।
ভদ্রলোক প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে নিরুপমের দিকে তাকান। নিরুপম নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- কাকাবাবু, স্বাগতা আমার বন্ধু।
ভদ্রলোক দৃষ্টিতেই সব বুঝে নেন। তবে এমন দুঃসময়েও মেয়ের বন্ধুকে কাছে পেয়ে মনের ভেতর একটু উষ্ণতা অনুভব করেন। তারপর বলেন- বাবা, তুমি চলে যাও। নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছো- স্বাগতা করোনায় আক্রান্ত ছিল। তুমি কাছে এলে তোমার ক্ষতি হতে পারে।
নিরুপমের নির্লিপ্ত উচ্চারণ- আমার কিচ্ছু হবে না কাকাবাবু।– ‰আর মনে মনে উচ্চারণ করে- আমারতো সবকিছুই শেষ। আমার আকাশ ভেঙে খান খান!'
শান্ত হয়ে সাদা কাপড়ের ভেতর শুয়ে থাকা স্বাগতার ওপর দৃষ্টি পড়তেই নিরুপমের ভেতরটা তোলপাড় করে ওঠল। ভাবতেই কষ্ট হয় এমন নির্বিকার স্বাগতার কথা; যে চোখে ছিল ভাষা, উড়ন্ত চুলের ভেতর ছিল পাখির ডানা আর চোখের ইশারায় ছিল ভালোবাসার প্রজাপতি-রঙ। সবকিছুই উবে গেছে মহাকালের গহ্বরে সারাজীবনের জন্যে। ভাবতেই নিরুপমের মনের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে। তবু তাকিয়ে দেখে প্রিয়তমাকে... যার সাথে ছুঁয়ে আছে ভালোবাসার রঙিন সময়ের সকল ছবি। কাছাকাছি হয়ে কপালে হাত রেখেই নিরুপম ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মনের ভেতর জগৎ অস্বাভাবিক ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে। মনের ভেতর কষ্টের উচ্চারণ-
তুমি ভালো থেকো প্রিয়তমা
রেখেছি যতনে তোমার কথা
যে কথা হয়নি বলা তোমাকে,
তুমি ভালো থেকো প্রিয়তমা
কষ্ট শুধু বুকের ভেতর-
'ভালোবাসি' হয়নি বলা তোমাকে ছুঁয়ে!
শেষ
রচনাকাল: ০৮.০২.২০২২, রায়ের বাজার, ঢাকা