'ইচ্ছা-চিন্তা-স্বপ্ন-ব্যথা-ভবিষ্যৎ-বর্তমান’—বিরস গান গেয়ে চলেছে এই বর্তমান হৃদয়ে। আর আমি কেবল-ই বেদনার সন্তান হয়ে উঠছি। চারিদিকে রোগ-শোক-বঞ্চনা অথবা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমরা কোনো না কোনো কারাগারে বন্দি; আর বাইরের বিস্তৃত পৃথিবীতে কেবলই ক্ষুদ্র এক শত্রুর অবাধ বিচরণ। এমনি এক সময়ের গ্রন্থিতে একা-একা পথ হেঁটে গিয়েছিলাম। কাঁচা ধানের ক্ষেতের পাশে, কলাপাতার ছায়ায় বসে আছেন দুজন বয়স্ক নারী পুরুষ। দৃষ্টি অবিরত ধান ক্ষেতের দিকে সুদূর প্রসারিত। গিয়েছিলাম এঁদের গভীর শান্তি হৃদয়ে অনুভব করবো বলে। গভীর শান্তি নাকি পেছনে ফেলে আসা আনত সমুদ্দুর; আর তার অবিরত ঢেউয়ের রেখা অঙ্কিত হয়ে আছে এঁদের চামড়ার ভাঁজে, হাতের রেখায়, সমস্ত দেহে। হাতের প্রাচীন লাঠি ব্যক্তিগত যাত্রার একমাত্র সঙ্গী। তারপর, এই পথের উপর যেন অনন্তকাল বসে থাকা। ইতস্তত কলাপাতার ছায়ায় বসে প্রৌঢ়াকে নিয়ে প্রৌঢ় নবান্নের দিন নক্ষত্র-খামারে যাবার প্রতিশ্রুতি দেন কিনা জানা যায় না।
অথবা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মলিন বসন, দক্ষিণ আর পুবের হাওয়া, আর ঘুচে যাওয়া জীবনের সব লেনদেন নিয়ে একে অপরকে শোনান:
“জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে— হারায়েছি আনন্দের গতি;”
তাদের কোনো কথা বলবার প্রয়োজন নেই। কেবল-ই নিরন্তর দৃশ্যপটে খুদিত হয়ে যাওয়া। এই দৃশ্যপটের যখন অবতারণা প্রকৃতিতে তখন ২১ শে আষাঢ়। দিনের বেশিরভাগ সময় ফুলবাড়িয়ার হালিমা বুবুর ফ্যাসফ্যাসানি কান্নার মত বৃষ্টি ঝরে চলে অবিরত। (আমার কাছে হালিমা বুবুর কান্না ঠিক ফ্যাসফ্যাসানি কিনা এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি। তবে শুনেছি, তার স্বামী ঝাঁঝালো স্বরে হালিমা বুবুকে তার ফ্যাসফ্যাসানি কান্না থামাতে বলে)। কখনও কখনও মুষলধারে বৃষ্টি। যেন বিরামহীন এই জলের ধারা ধুয়ে দেবে মহামারীর সব শোক, তাপ, ক্ষতি।
জানালার ধারে বসে জলজ-হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মাখছি। মনে পড়লো, আধঘন্টা আগে সেডেটিভ নিয়েছিলাম পূর্ণ ঘুমের প্রয়োজন বলে। অথচ ঘুম-ঘুম পাখির চোখে সাততলার উপর থেকে দেখছি, অপ্রস্তুত করুণ জলাশয়ের ওপারে উঁচু-নিচু বিল্ডিংয়ে জেগে থাকা টুকরো টুকরো আলো অথবা প্রস্তরের উপর খসে পড়া মৃত নক্ষত্রদের। এই আষাঢ় রাতের আবছায়ায় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি- জলাশয়ে বৃষ্টির পানির আঁকিবুঁকি, আর ইতিউতি তেলাপিয়া মাছের ঘুরে বেড়ানো কেমন এক ছন্নছাড়া মূর্ছনা তৈরি করছে। আরেকটু নিচু ঘরে শুয়ে শুনতে পারলে অবশ্য এই সঙ্গীত ধ্যান-গভীর ঘুমের আবেশ দিত।
নিভুনিভু চোখের পাতায় আকাশে উড়ে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভাবনা হয়ে উড়ছে। জানি না জীবনের উথাল-পাথাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে; এঁদের মত ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্পের ঝুলি নিয়ে; নিভৃত খেজুর গাছের ছায়ায় নীরবে কাউকে মুখোমুখি বসে দেখবার অবসর পাবো কিনা? অথবা অদিতি মহসিনের গাওয়া:
আমরা এমনি এসে ভেসে যাই
আমরা স্নিগ্ধকান্ত শান্তি সুপ্তি ভরা
আমরা আসি বটে, তবু কাহারে দিই না ধরা
আমরা স্নিগ্ধকান্ত শান্তি সুপ্তি ভরা
আমরা আসি বটে তবু কাহারে দিই না ধরা
আমরা শ্যামলে, শিশিরে, গগনের নীলে
শুনতে শুনতে আমার ঘুমিয়ে পড়া উচিত কিনা?
সুতরাং, শুভরাত্রি। সবার মঙ্গল হোক।