পোস্টস

গল্প

মিনুর কথা

১০ জুন ২০২৪

Hassan Sabbir

মিনুর সাথে আমি প্রথম কবে কথা বলেছিলাম মনে করতে পারি না। এমনকি মিনুর 'মিনু' ডাক নাম ছাড়া অন্য কোন নাম আছে কিনা বা আসল নাম কী তাও মনে পড়ে না। মিনু আমাদের গ্রামের বাড়ীর একটু দূরের প্রতিবেশী।

আমাদের গ্রামটা একদম অজপাড়াগাঁ বলতে যা বুঝায় সেটা। বিশেষ করে যে সময়ের কথা বলছি তখন তো পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ আসে নি পর্যন্ত। সেসময় অজপাড়াগাঁ গুলোতে যেটা হতো, দেখা যেতো পুরো গ্রামে হয়তো তিন-চার জন একটু অবস্হাসম্পন্ন লোকের ঘরে 'সাদা কালো' টিভি থাকতো। এগুলো চলতো ব্যাটারীর মাধ্যমে। ব্যাটারীর মধ্যে এসিড ভরে রিচার্জ করতে হতো। দেখা যেতো কয়েকদিন পর পর বাজার, গ্রামে বলে গঞ্জের হাট, থেকে এসিড ভর্তি ব্যাটারী নিয়ে আসা হতো। তখন ডিশের লাইন বলতে কিছু ছিলো না। এই টিভিগুলো চলতো বাইরে একটা লম্বা বাশের মাথায় বাঁধা টিভি এন্টেনার সাহায্যে। এন্টেনা থেকে একটা তার এসে টিভিতে জ্যাকের সাহায্যে লাগানো থাকতো। কোনো প্রোগ্রাম চলার সময়, বিশেষ করে প্রিয় কোন প্রোগ্রাম যখন শুরু হবে, অনেকক্ষণ ধরে সবাই অপেক্ষা করে এড দেখে সময় কাটানোর পর, দেখা যেতো হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। আর একটা সমস্যা হলো হয়তো বাতাস বা অন্য কোন কারণে এন্টেনা নড়ে গেছে, দেখা যেতো বাশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এন্টেনা ঠিক করে টিভির ভিডিও এডজাস্ট করা হচ্ছে। নাহলে টিভি স্ক্রিন 'ঝি ঝি' করবে বা ঘোলা দেখাবে।

এতকিছুর পরেও টিভি দেখার আগ্রহের কারো কোনো কমতি ছিলো না। ঐযে বললাম পুরো গ্রামে মাত্র ৩/৪ টা টিভি। তাই, যার বাড়ীতে টিভি থাকতো, তার বাড়ীতে টিভির ঘরে আশেপাশের যত বাড়ী আছে ছেলে, মেয়ে, বুড়া, বুড়ি, গেরস্থ, কামলা সবাই মোটামুটি হুমড়ি খেয়ে পড়তো। এতে অবশ্য টিভিওয়ালী বাড়ীর কর্তা বা কর্ত্রীর বিশেষ কোন আপত্তি থাকতো না। তবে মাঝে মাঝে কারো সাথে কথা কাটাকাটি থেকে তুমুল ঝগড়া লেগে যেতো। আবার টিভিওয়ালীদের সাথে যাদের ঝগড়াঝাটি তারা টিভি দেখতে আসতো না। অবশ্য এসব মনোমালিন্য একজন আরেকজনের সাথে লেগেই থাকতো কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবার সম্পর্ক জোড়া লেগে যেতো।

আমরা তখন থেকেই বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতাম। দুই ঈদে আর এছাড়া মাঝে মাঝে আয়োজন করে বাড়ী যাওয়া হতো। তখন গ্রামের খুব কম পরিবারই ঢাকা বা শহরে থাকতো। তাই আমরা বাড়ীতে গেলে আশেপাশের বাড়ীসহ আমাদের বাড়ীতে আগে থেকেই ঈদ লেগে যেতো। আমাদের যে মূল বাড়ী, যেখানে আমার চাচার পরিবার, দাদা, দাদী সহ একান্নবর্তী পরিবার বাস করতো, সেই চাচার ঘরেই একটা 'আলাদীনের প্রদীপ' মানে সাদাকালো টিভি ছিলো।

চাচাচাচীর বেডরুমেই টিভি রাখা। মাটির ঘরে রুমগুলো সাধারণত অনেক বড় হয়। ঐ রুমে একটা রাজা-বাদশা টাইপ এলাহী খাট ছিলো যা বিশাল বড়ো, আর চার পাশে রেলিং দেয়া। যখন সবাই টিভি দেখতো খাটে বসার আর জায়গা থাকতো না। তবে খাটে সব ভিআইপি রাই বসতো। মানে যারা ঢাকা থেকে আসছে, বা ঐ বাড়ীর লোক আর যারা মান্য-গন্য। খাটের নিচেই একটা বড় লম্বা টুল রাখা। আর নিচে মাটির উপর 'পাটি' বা মাদুর আর পিড়ি বিছিয়ে সাধারণত আশেপাশের একটু অসচ্ছল প্রতিবেশী বা কামলা শ্রেণীর লোকেরা বসতো। মাঝে মাঝে সবার ফিস ফিস শব্দ এমন আওয়াজ তুলতো যে তা একটা বিশাল গুঞ্জন হয়ে যেতো। তখন দেখা যেতো কোনো মুরব্বি শ্রেণীর নানা বা দাদা একটা বিশাল ঝাড়ি দিয়ে পরিবেশ শান্ত করে দিয়েছে। ও আচ্ছা, আরেকটা বিষয় এই অমূল্য টিভিকে একটা অদ্ভুত বাক্সের ভিতর ভরে রাখা হতো, যা গেইট খুলা ও বন্ধ করা যেতো এবং টিভি দেখা শেষে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়া হতো।

আর সবার সাথে মিনুও প্রতিদিন আসতো। তবে আমি এখানে কখনোই বিশেষভাবে খেয়াল করি নি। আসলে যে ঘটনা লিখবো বলে আজ কলম তুলে নিয়েছি তার আাগে বা পরে মিনু সম্পর্কে আসলে আমি তেমন কিছু জানিই না!

মিনুদের সাংসারিক ও বৈষয়িক অবস্থা খুবই নাজুক ছিলো। একটা মাত্র ছনের ঘর। ভিতরে কখনো যাওয়া হয় নি, তাই বিশেষ বর্ণনা দেয়া সম্ভব না। তবে অবস্হা যে অনেকটা শোচনীয় ছিলো সেটা বলাই বাহুল্য। তাদের বৈষয়িক অবস্হা আগে নাকি এতটা খারাপ ছিলো না। বাড়ীর বয়স্কদের কাছ থেকে যেমন শুনেছি, ওর বাবা জমি কেনা বেচার কাজ, যাকে জমির দালালী বলে, করতেন। তখন অবস্থা মোটামুটি খারাপ ছিলো না। লোকমুখে শুনা কথা যে, তার গরীব এক আত্মীয়ের সরলতার সুযোগে ধুর্তামি করে তিনি কিছু জমি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। 'অভিশাপ' বলে একটা কথা মানুষ বিশ্বাস করে, আর মিনুদের পরিবার সম্পর্কে তারা এটা বলে। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতো এই "অভিশাপের" কারণেই তাদের পরিবারে জ্বীন-ভূতের আছড় আছে।

মিনুর মা আর বড় ভাই পাগল। সবাই বলে জ্বীন আছর করে। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় ভালো থাকে আবার একেকবার মা, আরেকবার ভাইয়ের উপর 'আছর' পড়ে। কখনো কখনো এমন পাগল হয় যে উলংগ হয়ে ঘুরে। বিভিন্ন প্রলাপ বকে। প্রতিবেশী আর আত্মীয় রা অনেক সময় শিকল দিয়ে বেধে রাখতো, আর প্রচুর মারতো! কখনো কখনো ওঝা এনে ঝাড়া হতো। ওঝাও প্রচুর পেটাতো ঝাড়ু দিয়ে। আসলে নাকি ঐ ব্যক্তিকে না, আছর করা জ্বীনকে পেটাচ্ছে!

এগুলো বেশিরভাগই আমরা শুনতাম। তবে মাঝে মাঝে যখন বাড়ী আসতাম, কিছু কিছু দেখতাম। ওর বড় ভাই আমাদের প্রায় সমবয়সী হবে। আমাদের বলতো- আমি পাগল! আবার বলতো- 'তোমার আব্বার চাকরি তো আমার আব্বা বলে দিছিলো এজন্য হয়সে।'

'দেখো তোমার একটা ভালো চাকরি হবে' - 'বিড়ি আছে? একটা বিড়ি দেও!'

যদিও কখনো আমার কাছে বিড়ি বা সিগারেট থাকতো না!

মিনুর আব্বার এগুলো সামলাইতে অনেক বেগ পেতে হতো। ওদের পরিবারের চারজনের মধ্যে ওর বাপ আর মিনুর 'পাগল' হওয়ার কথা কখনো শুনি নাই।

একদিন রাতে কোনো এক অজানা কারনে গোঙানির আওয়াজ তুলে মিনুর আব্বা মারা যান বলে শুনেছি। তারপর তাদের সংসার কিভাবে চলতো এ বিষয়ে আমার আসলে কোনো ধারণাই নাই।

তখন আমি ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এস.এস.সি কোন একটা বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। অনলাইনে যেহেতু পরীক্ষার ডিটেইলস রেজাল্ট দেখা যায় এবং গ্রামে রেজাল্ট দেখার সুব্যাবস্হা নেই, তাই প্রচুর কল আসতো গ্রাম থেকে আত্মীয় স্বজনের আর পরিচিতদের। অনলাইনে রেজাল্ট দেখে দেয়ার জন্য। তখনো অনেকেরটা দেখে দিচ্ছিলাম। কারো রেজাল্টই তেমন ভালো না। বাট অনেকেই ঐ রেজাল্টেই আবার সন্তুষ্টও ছিলো। আমার এক কাছের আত্মীয় ছিলো যে গ্রামে থাকতো, কিন্তু অবস্থা ভালো, সে আশানুরূপ রেজাল্ট করতে পারে নাই। এজন্য একটু হতাশও ছিলাম।

এর মধ্যে একটা কল আসলো-

"ভাইয়া, আমি মিনু! আমার রেজাল্টটা একটু দেখে দিবা।"

আমার তখনো অনেক কিছু দেখার আর অবাক হবার বাকী ছিলো!

মিনু সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়াশুনা করেছে। তার রেজাল্ট 'এ' গ্রেড। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট। তবে তখনকার 'ঐ এ' গ্রেডও যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট!

কিন্তু, সবকিছু ছাপিয়ে আমি ভাবছিলাম- একটা ছনের ঘরের ভিতরে যার মা, আর বড় ভাই অপ্রকৃতস্থ সে খাচ্ছেটাই কী আর 'কুপি বাতি' মিটি মিটি জ্বালিয়ে কখনি বা একটু পড়া শুনা করেছে!!

উচ্ছসিত হয়ে মিনুকে কল ব্যাক করে বললাম-

"মিনু, তুমি তো অনেক ভালো রেজাল্ট করেছো!"

জবাবে মিনুর হতাশমাখা দীর্ঘশ্বাস আর কথাগুলো এখনো কানে বাজে-

"আমাদের আর ভালো রেজাল্ট আর পড়াশুনা, ভাইয়া!"

মিনুর বিষয়ে পরে আর তেমন কিছু জানি না। তবে পড়ে যখন শুনেছি- এসএসসি পাশের পরপরই অভাব থেকে বাঁচতে তার নাকি বিয়ে হয়ে যায়। একটা বাচ্চাও নাকি হয়েছে, ঐ সময় শুনেছি।

তবে, মিনুর সাথে আমার শুধুৃমাত্র একটা কথোপকথনের স্মৃতিই মনে হয় আমি ভুলতে পারবো না-

"আমাদের আর ভালো রেজাল্ট আর পড়াশুনা, ভাইয়া!"