তিমির রজনী পার করে উদিত পরাক্রমী প্রত্যুষ অংশুধর,
পুঞ্জিভূত গাঢ় অভ্রের দেয়ালে অংশুর পরাণ যেন বধ।
বিনিশ্চল বায়ুর রেনু করে পার হাঁটছি কাদম্বিনীর মোহিনী ঠিকানার পথে,
কত মানুষের কত অবয়েব, কত স্বপ্ন, কত চিরচেনা ভীড় ভেদ করে,
কালো পিচের বরণীয় সারণির পরে চপলিত কপল ফেলে চলছি কাদম্বিনীর খোঁজে।
শ্রাবণের দ্যুলকে আলোর লুকোচুরির বশে ছায়ার হয়েছে অবসান,
আর কতো সমরণী বাকি? হয় না কেন পরিজানের প্রাচীন সমাপন।
প্রভঞ্জনের দমকা এসে লাগে শরীরের সমগ্র কলেবরে,
অসহ্য ঝঞ্ঝাটের বিপরীতে ঠাই হয়েছে এখন কাদম্বিনীর মেহগনির কপাটে।
দ্বিধার অবকাশ ঝেড়ে বিজন পান্থের রেখায় দাঁড়িয়ে দিলাম কয়েক ঠোকা শেষে,
দ্বার খুলে বেরিয়ে এলো অমিত রমণী যে চোখে চোখে কথা বলে-
"বেলাশেষে তুমি এলে! সবুরের রেশ তাহলে কাটলো এতক্ষণে "
সারস উপহাসে আমরা দুজনে পৌছালাম অন্তঃপুরে।"
কাদম্বিনীর মুখে চোখে রঙ, হাতে গায়ে সাতরাঙা স্পর্শ,
দেখে মনে হয় কোন গোধুলির আড়ং এর রংধনুর মুক্তবেণীর শাস্ত্র।
শীতল হস্তে তুলি গুলো সরিয়ে বসালো আমাকে তার খাটের কিনারায়,
“একটু বস আমি তোমার সাথে চা নিয়ে আসছি এই অবেলায়।"
নিশ্চলতার শংকর অভিধানে নিষ্য আলো-আঁধারে ভব বিলাসিতায় মশগুল
স্থানু তাকের “ছায়াময়ী” বই নিয়ে ঠাই নিলাম আরাম-কেদারায়,
ব্যকুল অনিলের তীব্র কম্পনে উওতলা কেদারা এক তিলোত্তমা স্বর্গের শোরগোল
দু পেয়ালক ধুমো উঠা চা নিয়ে উপবেশিত হলো সে আমার পাশের আলপনায়।
চায়ের চুমুকে দীপ্তি হাসি হেসে বললো" তোমার জন্য এক উপহার আছে,"
উন্মুক্ত হিয়ার পিদিম জ্বালিয়ে সরবে,"সেটা আমায় কি বলা যাবে?"
মনোভাবে সে উঠলো আসন ছেড়ে, আমিও গেলাম তার পিছু পিছু,
টেবিলে কত রঙের ছড়াছড়ি - তুলি, ব্রাশ ,পেন্সিল, আরো কত কিছু,
এক পটুয়া প্রেমিক আমার, কাগজ তুলির বন্ধনে ফুটিয়ে তোলে হাজারো পুত্তলিকার বধু।
অগ্রণী সোহাগের তীব্র হুশিয়ারে বের করে এক মোটা কাগজ তার সৌখিন ক্লিপবোর্ড থেকে,
সুধাকর রূপকথায় অঙ্কিত এক চিত্র যেথায় মম মানবের প্রতিচ্ছবি ভাসে,
সে বসে আছে দুই হাতে পান্ডুলিপি খুলে বারিধির পানে চেয়ে,
সিন্ধুর জলকল্লোল অমৃত তরঙ্গ হিল্লোল দোলা দেয় তার মাঝে।
থোকা থেকে কাঠগোলাপের ঝর্ণা ঝরায় অগ্নিসখার গা ঝেড়ে,
কোন বালুময় কলসদ্বীপে মহীর তিয়াসী সূর্যাস্তের কোলে।
একি ! এযে আমার মনোহর বিরল প্রতিচ্ছবি
কাদম্বিনীর ভবের মধুমিতায় নবরূপে প্রজ্বলিত জলরঙে বসা আমি,
চক্ষু আমার অনিমিখ এই প্রফুল্লনীলোৎপলদলতুল্যের প্রতি।
"কভু দেখিনি চেতনাতীতে ফেলে দেওয়া বিভোল চিত্রকর্ম, হে রূপসী,"
"এবার দেখে নাও, তুমি নিয়ে যাও, হে মনোরায় রবি।"
অদিতি করি না অপলাপ কোন মুঢ়োতার অমিনিশা
রন্ধ্রে রন্ধ্রে খরতান উপনিবেশিত তার কাননের পদতলে,
কুমারী পাণির সহিত অদ্যোপান্ত যোজনে বেরোলো পাতি কাঠের পাতা
কালচে বাদামী পরিমল কাঁচের ফ্রেমে কৌমুদীত তরঙ্গে বেঁধে দিল সে অঙ্কিতার প্রাণজলে।
অনিন্দ্যে তাকিয়ে অভিনিবেশে কত পেরিয়ে যায় মৃতুযকালের পথ
লুপ্ত মোর অন্তবিন্দ্রিয় সওগাত ফ্রেমের বারীন্দ্রের কলকালে,
কাদম্বিনীর ডাকে ফিরে আসে অভিনিবেশ ,তার শ্রুতি যেন দামিনীর রথ -
জীবনের লাটাই প্রাণ ফিরে পায় ভেজা মৃত্তিকার গানে।
প্রফুল্লতার হবে বললো সে যে "অবহিত হয়ে করে দাও প্রিয় ছবিটি দেয়ালের সাথে সন্ধি,
ঝুলিয়ে দাও সেখানে, যেখানে তুমি পাবে উর্ণনাভ থেকে মুক্তি"।
মহাকীর্তি হাতে যাত্রা দিতে হবে বিরাগী নীড়ের নিকটে ফিরে আসতে হলো আবার ঘৃহত্যাগী দুয়ারে
শম্বরকে ফেলে নিঃসংশয় আসে না লহু চিতপটে
কাদম্বিনীর সমীপস্থে সবই অনুকুলে জড়িয়ে ধরলাম তাকে,
উষ্ণ চুম্বন মিশিয়ে দিলাম চিরচেনা শুকপাখির ললাটে
কড়া সমীরণে ডুবে যায় মুখশ্রী তার রেশমী অলকে।
"বিদায় দাও আমাকে থাকছি না আর নিমিষে, যাই আমি রূপিনী"
"আবার এসো কাল, ঘুরবো স্রোতোবহায় ভাড়া করে কোন নিরুপম সালতি"।
অদির বক্ষে ফের তৃষাতুর নীরস মুসাফির,
অন্তরীক্ষ আরো গাঢ় মেঘের দানবীয় সঞ্চারী।
সমীর গতির উছলে একি বড় অনাসৃষ্টি,
মধ্যদিনেরও ভাস্করের কঠোর দীপ্তি মেঘের কালজিয়ায় আঁটি।
মহা ধারাপতনের অকাতরে দান নামবে এই পথিকের বাঁকে -
সিক্ত হবে সমগ্র শরীর হাতে মহাকীর্তি এর সাথে।
ধক করে ওঠে বক্ষ কেন্দ্র চমকে হারালো সব সুখ আপন কক্ষ ছিঁড়ে।
নিস্তার পাবে আলেখ্য কি দুর্ভেদ্য বর্ষানোমুখের কাছে?
বজ্রকন্ঠে ভূতল কাঁপিয়ে পড়লো অশনি অনুভা ঘন ঝলকে,
সৌদামিনীর সহিত অদয় হল কৃষ্ণ অম্বুধারের বারি নিখিল কোঁকিয়ে।
বৃষ্টির সাথে ভেসে যাবে আমার শৌখিনীর অনুরাগের কারুকাজ,
কিঞ্চিৎ আশ্রয়ের খোঁজে জিগর বড়ই বেদনার অভিলাষ।
নীরের নিগর নিনাদের বীতংসের আচরি,
শোণিত করে চিত্রজল, কিণাঙ্কের মমতায় ঢাকি,
অন্তরায় থেকে যায় মনোরথ, আমি যে কুম্ভিলক আনাড়ি।
অভ্রের বর্ষণে নিসর্গ অন্তরে শরীর দৃঢ় অয়োময়
নিপুনের ফ্রেমে জলের চলাচলে খেঁচর মেলেছে অভিপ্রায়,
আপন গৃহের অভিমুখে বৃষ্টি গেছে থেমে অদ্রির প্রান্তরে
কাগজের ওপর শখের আঁকাআঁকি বারিশের গরাসে।
ঝাপসা ফ্রেমে জলের কলরব কোথা গেল তিমিরবিদারী,
তুমুল বিক্ষোভে মনস্কাম জাগে যেন কালকুলট সেবন করি ।
গলা ধরে যায় তীব্র ঝিঝিপোকায় কেন পেলাম রঁজিত শাস্তি,
কোথায় মানব কোথায় ফুল কোথায় সিন্ধু কোথায় পান্ডুলিপি?
সিক্ত তেনাময় কাগজ সলিলের বিনেতার বারোরঙের কোলাকুলি।
অন্তরাত্মার আহাজারি যেন মনে হয় মহীধর ধসের দন্তাল,
শান্ত নিশব্দ চারিদিকে হরিৎ শ্যামলে মিলেছে মৃণাল।
আকালের তাঞ্জামে চড়ে ভেসে এলো টেলিফোনের বিরহিনী খরাতন,
রিসিভার তুলেই কানে এলো কাদম্বিনী বামাস্বর আহরণ।
"ঠাইকি হয়েছে তার তোমারি অবসাদের দেয়ালে, প্রিয় মনোরায় রবি?
গত তিরিশে এঁকেছি সেজে আমি এই একটিমাত্র ছবি।"
সিক্ত আঁখি থেকে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে পড়ে কপোল ঘেসে,
কন্ঠনালী কারাবন্দি, সহস্রা আরাধনায় ক্ষুদ্র কম্পনো আসে না ভেসে ।
নিস্তব্ধ বসুধায় কোন কথা নাই শুধুই মৌনতার সংগীত বাজে,
অনাহারের প্রকৃতি কেন বশে নেয় অন্যের সুখ, সঞ্চয় গুলো লুটে,
কল কেটে যায় বুঝিনা সেথা মানব মূর্তি হয়ে থাকি রিসিভার কানে টেনে,
এত ভরসার কত ভালোবাসার তেজস্বীর পরম দুর্গতি বাঁচাতে পারলাম না দিনের সমরে।
ধীমান সময়ের দিশা হারিয়ে কত সময়ের কতো হলো চলাচল -
সর্ব খুঁয়িয়ে ধ্বংসের মৃদুনাদে উপরে পৃথিবীর পদাতল।
জীবনের কন্দোলে মৃন্ময়ী অভিলাষ গেছে মহাকালে ভেস্তে,
কে যেন এসেছে হঠাৎ, কে দরজা দাপায় মনোবেদনার অকালে এসে।
খুলে দিয়ে দ্বার ফিরে এলো প্রাণ এ যে কাদম্বিনী,
অকস্মাৎ চিত্তে নীলাম্বরী পরে তুলোমিঠে বিভাবরী।
এক ঝটকায় সে চলে গেল আবাসের অন্তঃপুরে,
স্বপ্নভাঙ্গানো ফ্রেমটি কোলে নিয়ে ছুঁয়ে দেখে বারে বারে।
বেষ্টনী খুঁড়তেই জলের কলকলে গেল নীল শাড়ীটা ডিজে,
কুহক ভরা অঞ্জন চোখে তাকায় অকপটে,
কেন পুণ্য চলে যায় অবিরাম কত শূন্যের কোলাহলে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে এসে কাছে বলে আমায় চুপি চুপি
"মনোতপে আছো কেন, আমি আছি, হইনি কোন স্বৈরিণী,
আঞ্জুমানে বনতির তীরে নব্যভাবে অঙ্কনের পণ নিলাম আমি এই কুমুদ রমণী"।
প্রভূত আহবানে মৃত নগরে ফিরে এলো সজীবতা যেন সে কথার বাজিকর,
প্রতিভা প্রলয়ে নব্য প্রতিভা স্থানান্তরিত কত রাত্রির নক্ষত্রালোকিতের ভেতর।
"পঙ্কিল মালিন্য বসন ছেড়ে পড়ে নাও কোন ঝলমলে পোশাক,
অতীত মুছে নিজেকে দাও সুনীল কুসুমের প্রদোষ অবকাশ,
শ্রাবণ দিনের শেষে পরিমল অম্বরের চন্দ্রিমায় মিশি আসো,
ছাদে চলো তাই স্বচ্ছ হয়ে এসে আমার পাশে বসো"।
অনিমিষার ঘোর কেটে গেলো শেষে শুভ্র কপোত উড়ে দুর্বার,
আমিও পড়েছি নীল পাঞ্জাবি, রূপসীর সাথে মিলিবার।
মারণাস্ত্রময় প্রতিপক্ষ ঘুচেছে অদ্যোপান্ত নিরাপত্তায়,
সহচার্যে তরঙ্গিত পদার্পণ দুজনের জীবসত্তায়।
বরাভয় সোপান বেয়ে চপল ধায়ে ছাদের দিকে আগমন
নিরঞ্জনায় পাশে দূরে রেখে অমৃত হুতাশন।
শীতল মাখা ছাদ, পবনের তাত্ত্বিক কোলাহল চমকায় স্বাপ্নিক নিয়মে
কোণে দোলনা একা দোল খায় হাসনাহেনার স্তুতিকর সনে।
হাসনার নিনাদের রৌশনি বেশে বসলো আমার পাশে
পরমা অভিমানে বাম বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে পরিতোষ নিশিতে,
মেঘ সরে যায় পূর্ণিমা হাসায় হিমাংশুর প্রদ্যোতিত করতলে।