"ডায়েরি"
লেখা: আসিফ হোসাইন
★★★★
ওর সাথে সম্পর্কটা আমার প্রায় দুই বছরের। বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসছে প্রতিনিয়ত।
নীলাকে প্রায় দুইমাস ধরে তোষামোদ করছি, তোমার মা বাবার সাথে কথা বলবো। নীলা চারপাঁচ বুঝ দিয়ে এড়িয়ে চলছে ব্যাপারটা।
আজকে নীলার সাথে যেভাবেই হোক ওর বাসায় যেতে হবে। তুমুল ঝগড়া লাগার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও এই রিস্কটা নিতে হবে আমার। ওকে ছাড়া বিয়ে করতে পারবো না কাউকে। নীলাকেই আমার দরকার। নীলা কেন ওর মা বাবার সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছে না, সেটা বুঝার জন্য হলেও আজকে যেতে হবে।
যথাসময় নীলা উপস্থিত হলো। ওর চেহারার মধ্যে সবসময় একধরনের বিষন্নতার আভা লেগে থাকে। বিনয়ী, নম্র ভদ্রের কোনটারই কমতি নেই ওর ভিতর। রুপে, গুনে সবদিক থেকেই যেন ও নারী সমাজের আদর্শ। ওর চুল, চোখ, নাক ঠোঁট সবকিছু মিলিয়ে এক মায়ার জাল। এই জালে আটকে পড়েছি আমি। জাল থেকে বের হওয়ার কোন সম্ভাবনাই আমার ভিতরে নেই।
নীলা হেসে দিয়ে বললো,
- কি আমার উপর অনেক রাগ বুঝি?
আমার রাগের অভিনয় করতে হবে। সাহসে কুলোচ্ছে না। ও যদি কান্না করে তাহলে আমি মরেই যাবো। ওর কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি আমার নেই। তবুও একটু রাগী ভাব নিয়ে ওর হাত ধরলাম।
- চলো, তোমার বাসায় যাবো।
নীলার মুখে মেঘের আবরণ পড়লো। খুব নিচু স্বরে বললো,
- আমি যাবো না।
এবার রাগ না দেখালে হবে না। হাত ধরে টান দিয়ে নীলাকে দাঁড় করালাম।
- তোমার যেতেই হবে, চলো।
নীলা কথা বাড়ালো না। চোখ ছলছল করছে। ওর দিকে তাকাচ্ছি না। তাহলে হেরে যাবো নিশ্চিত।
নীলা লক্ষী মেয়ের মতো ওর বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসলো। আলিশান বাড়ি। পরিপাটি সবকিছু। নিয়ে গেল ওর বেডরুমে। আমাকে বসতে বললো। ও অন্য রুমে চলে গেলো। ফিরে আসলো ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধাকে নিয়ে। উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। নীলা বৃদ্ধাকে বললো,
- নানু ওর নাম শিশির।
নানু আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। নীলাকে বললো,
-ঠিক আছে তোমরা কথা বলো।
নীলা আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। নীলা ওর বইয়ের ডেস্ক থেকে একটি মোটা নীল রঙের ডায়েরি আমার হাতে দিলো। বললো,
- আমার বাবা- মার সাথে পরিচয় হও।
নীলার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডায়েরি-র পাতা উল্টোতে থাকলাম। নীলা বললো,
- পুরোটা পড়বে এখন।
আমি নীলার থেকে চোখ ফিরিয়ে ডায়েরির প্রথম পাতায় চোখ বুলালাম,
"""" তাং: ০৪- ০৪- ১৯৯৪
রাত দুইটা বাজে। পাক্কা একঘন্টা যাবত আমি ঘড়ির কাঁটার প্রতিটা সেকেন্ড গুনে চলেছি। টিকটিক সেকেন্ডের কাঁটার সাথে আমিও এক,দুই, তিন............. গুনে চলেছি। অপেক্ষা করছি শাহিনের জন্য। ও আমার স্বামী। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমার পাশেই শুয়ে আছে নীলা। আমার মেয়ে। ওর বয়স আজকে দুই বছর হলো। শাহিন বলেছিল, বারোটার আগেই চলে আসবে। মেয়েকে জাগিয়ে রেখেছিলাম ওর জন্যই। বারোটায় ফোন দিয়ে বললো, কাজের চাপ। আসতে দেরী হবে। নীলার চোখ ঘুমে কাতর। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগেও একবার বলেছে,
- বাবা আসবে কখন?
বললাম,
- এসে পড়বে মা। তুমি ঘুমিয়ে যাও। সকালে তুমি আমি আর তোমার বাবা ঘুরতে বের হবো।
নীলার যখন এক বছর তখন থেকেই ও সাজুগুজু পছন্দ করে। আমার মেকাপ বক্স নিয়ে কি যে করে সারাদিন পাগলিটায়! লিপিস্টিক নিয়ে ঠোঁটে দিবে। মুখে মেকাপ করবে। কপালে লাল লিপিস্টিক দিয়ে টিপ দিবে।
খুব হাসি পাচ্ছে আমার। নীলাকে এখনি একটি চুমু দিতে হবে। আমার মেয়েটা অনেক লক্ষী। সারাদিন কি যে পাঁকা পাঁকা কথা বলবে! আমার বাবা মা যদি আমাদের বিয়েটা মেনে নিত! ইশ! নীলাকে পেয়ে বাবা খুব খুশি হতো।
****
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শাহিন এসেছে রাত পৌনে চারটায়। এসেই শুয়ে পড়লো। আমি বললাম,
- মেয়ের জন্য কিছু কেনার সময়টাও হয়ে উঠেনি আজ?
শাহিন বললো,
- সকালে বের হবো নে। এখন ঘুমাও।
ঘুম থেকে উঠে পড়লাম সকালেই। মেয়েকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম। শাহিনকে ডাক দিয়ে আমি আর নীলা গোসল করতে গেলাম। গোসল শেষ করে নীলাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম। আমার মেয়েটাকে পুরো পুতুলের মতো লাগছে! ও যে সাজুগুজু করতে পেরে কি খুশি!
শাহিন বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে শেভ হচ্ছে। আজকের দিনটা মনে হয় শাহিন আমাকে দিচ্ছে। নীলাকে ঝড়িয়ে ধরে খুশিতে 'ইইইইই' করে উঠলাম। বুঝতে দিলাম না শাহিনকে। তবে শাহিনকে আমি বলবো, 'আমার অতকিছুর দরকার নেই। একটু সময় দিও আমাকে আর মেয়েকে, তাহলেই হবে।'
নিজেও খুব সুন্দর করে সেজে নিলাম। নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, কপালে টিপ, চোখে কাজল। একদম পরিপূর্ণ সাজ।
শাহিনও রেডি হয়ে গেলো। পান্জাবী পড়েছে লম্বু পাগলটায়। হিহিহি!
বের হয়ে পড়লাম তিনজন। আমার মেয়ের মুখ দেখেই শান্তি। মুখ থেকে যেন ওর হাসি থামছেই না। শাহিন বললো, চলো অশোক নগর পার্কে যেয়ে বসি।
শাহিনকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, 'তুমি এতো ভালো কেন?'
বিয়ের আগে আমরা অশোক নগরে গিয়েই বসতাম। ও খুব ভালো করেই জানে, আমার সবথেকে পছন্দের জায়গা অশোক নগর।
পার্কে পৌঁছে নীলা-কে ছেড়ে দিলাম মুক্ত পৃথিবীতে। ও এক দৌড় দিয়ে দূর্বাঘাসের উপর পড়ে গেলো। তবুও খিলখিল করে হাসছে। শাহিন দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো নীলাকে। আদর করতে থাকলো চোখে মুখে। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, বাবা- মেয়ের খুনশুটি দেখে। আমার সুখের সংসার.. আমার সুখের সংসার........
দুপুরের খাবার খেতে বসেছি রেস্টুরেন্টে। শাহিনের ফোন আসলো কোথা থেকে যেন। ফোন কেটে দিয়ে শাহিন বললো,
- আমার অফিসে যেতে হবে।
আমি খুব রেগে গিয়েই বললাম,
- তুমি না আজকে ছুটি নিয়েছো?
শাহিন বললো,
- মিটিং আছে। তুমি নীলাকে নিয়ে বাসায় চলে যেও।
শাহিন খাবারের অর্ডার দিয়ে চলে গেলো। বিয়ের আগে রাগ সামলাতে পারতাম না। হাতের সামনে যা থাকতো তাই ভেঙে ফেলতাম। এখন রাগ সামলানো শিখে গেছি। নীলার জন্য। বিয়ে হলে নাকি মেয়েদের সংসারী হতে হয়। সংসারী হতে গেলে মনে হয় রাগ সামলাতে হয়, সেক্রিফাইস করা শিখতে হয়।
মেয়েকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলাম। আমি আর আমার মেয়েই ঘুরবো। দরকার নেই শাহিনের। ও ওর কাজ নিয়েই থাকুক। রিকশা নিয়ে ঘুরবো পুরো শহর। মেয়ে না থাকলে হেটে হেটেই ঘুরতাম। আমার রাগ কমানোর ভালো ওষুধ হাটা।
ঘুরেটুরে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরছি।
হঠাৎ মেয়ে বলে উঠলো,
-মা, ঐ দেখো বাবা!
মেয়ের কথায় তাকালাম। শাহিনকে দেখেও আমি নীলাকে বললাম,
-ওটা তো তোমার বাবা না। তোমার বাবা তো অফিসে।
রিকশাওয়ালাকে খুব দ্রুত রিক্সা চালাতে বললাম।
★★★
শাহিনের প্রতি আমার বিশ্বাসটা অনেক। হয়তো অফিসের কোন কাজেই ও এদিকটায় এসেছিলো। কিন্তু পাশে মেয়েটি কে? দূর কী ভাবছি এগুলো! হয়তো ওর অফিস কলিগ হবে..
বাসায় এসে শাহিনকে ফোন দিলাম, ধরেনি। হয়তো কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আমি এই সময় ফোন দিচ্ছি কেন? না.না.. ওর প্রতি তো আমার বিশ্বাস আছে। আসলে পাশের মেয়েটির সাথে ও হেসে হেসে কথা বলছিল তাই মনে হয় এমন লাগছে।
রাত নয়টার দিকেই শাহিন বাসায় আসলো। বেচারা লম্বুর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আজকে আমাদের রেস্টুরেন্টে রেখে অফিসে যাওয়াটা ওর কাছেই ভালো লাগেনি। আমি স্বাভাবিক থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
- অতঃপর আপনার ছুটির দিনের কাজ শেষ হলো?
শাহিন বিশ্রী ভাষায় একটি গালি দিয়ে বললো,
- আমার সাথে মজা কম করবি।
কথাটা বলেই রুমে চলে গেল। আমিও কথা বাড়ালাম না। হয়তো মাথা বিগড়ে আছে। সকালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শাহিন না কখনোই আমাকে এত বিশ্রী ভাষায় গালি দেয়নি। নীলা জেগে ছিল। শাহিনের অশ্রাব্য ভাষার গালিটা ও বোঝেনি। কিন্তু শাহিনের এমন আচরণের সম্মুখীন আমার মেয়েও কোনদিন হয়নি।
নীলা চুপ হয়ে আমার কোলে শুয়ে আছে। বায়না, বিরক্ত কোনটিই করছে না। আমি যে শাহিনের কথায় কষ্ট পেয়েছি সেটা বুঝতে দেয়া যাবে না। নীলার কপালে আলতো করে চুমু দিলাম। বললাম,
- মামনি, কালকেও আমরা ঘুরতে যাবো কেমন? সুন্দর করে সাজুগুজু করিয়ে দিবো, বেলুন কিনে দিবো, চকলেট কিনে দিবো।
নীলা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আমার মেয়েটা মনে হয় সত্যিই ভয় পেয়েছে। শাহিনের এতক্ষণে হয়তো রাগ কমেছে। নীলা-কে নিয়ে বেডরুমে ঢুকলাম। শাহিন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে শাহিনের সামনে বসালাম। নীলাকে শাহিন কোলে নিয়ে আদর করলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। আমার মেয়ের দিকে একবারও তাকালো না। মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনীতে গিয়ে দাঁড়ালো। নীলা আমার কোলে এসে মাথাটা কাঁধে রেখে শুয়ে পড়লো।
খুব জোরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। শাহিনের কি হলো হঠাৎ! এমন আচরন কেন ওর। কিছু যে জিজ্ঞেস করবো, তাও করতে পারছি না মেয়ের জন্য।
নীলা ঘুমিয়ে পড়েছে। শাহিন এখনো ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছে। আমি গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতেই মোবাইল স্ক্রীনটা লক করে দিল।
- কিছু বলবা?
রাগে আমার শরীর কাঁপছে। হঠাৎ ওর কি হলো! এমন আচরণ করছে কেন! একদিনে মানুষ এতটা পরিবর্তন হয় কিভাবে? রাগ সামলে নিয়ে বললাম,
- তুমি কি অসুস্থ ফিল করছো?
শাহিন জোরে চেঁচিয়ে উঠলো।
- কি বলতে চাচ্ছো তুমি? আমি পাগলামী করছি? কত্ত বড় সাহস তোমার! চোখের সামনে থেকে যাও বলছি... তা না হলে খারাপ কিছু হয়ে যাবে।
আমার মেয়ের জন্য ভয় হচ্ছে। ও উঠে গেলে আরো ভয় পেয়ে যাবে। শাহিনের দিকে অনুরোধের দৃষ্টি নিয়ে বললাম,
- আস্তে কথা বলো। কি করলাম আমি? তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?
শাহিন হিংস্র জানোয়ারের মতো আমার সামনে এসে এলোপাথারী থাপ্পড় দিতে লাগলো! আমি একটুও বাঁধা দিচ্ছি না। ওর দিকে শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমার এই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকানো দেখে হয়তো ওর মায়া হলো। ব্যালকনী থেকে সোজা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
আমার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। বাবাকে খুব মিস করছি। একদিন গোসল না করার কারণে মা চুল ধরে টান দিয়েছিলো, আর বাবার সে কি রাগ! মা'র সাথে প্রায় একমাস কথাই বলেনি। এই প্রথম কেউ আমার গা'য়ে হাত তুললো। তাও যার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে পরিবার ছেড়েছিলাম সে....
ফজরের আজান দিচ্ছে। ঘুমানো দরকার, গভীর ঘুম।
***
সকালে মেয়ের কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙলো। বিছানা থেকে উঠেই জড়িয়ে ধরলাম। আমার মেয়েতো কখনো এমন করে কান্না করে না! ওর কি হলো! আমি ওর কান্না দেখে নিজেও কান্না করছি।
- কি হইছেরে মা? কাঁদছিস কেন?
মেয়ে হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
- বাবা আমার হাত খুব জোরে ধরে টান দিয়েছে।
শাহিনকে খুন করতে ইচ্ছে করছে আমার। ডাইনিং থেকে ফল কাঁটার ছুরি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ও ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কার সাথে যেন কথা বলছে। ওর হাসি দেখে চমকে উঠলাম। এক নিমিষেই আমার সব রাগ অভিমান চলে গেল। ও তো শাহিন নয়। শাহিন কখনো এভাবে হাসে না। তারমানে, গতকাল শাহিনকে আমি হারিয়ে ফেলেছি?
ড্রয়িংরুমে আবার ফিরে আসলাম। মেয়ে আর কান্না করছে না। নিজে থেকেই মেকাপ বক্স ওর সামনে নিয়ে আসলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। ওর হাসিতেই আমার সুখ, শান্তি সব।
****
ইদানিং হারিয়ে ফেলা শাহিনকে খুব মিস করছি। এই শাহিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে। যে মেয়েটার সাথে শাহিনকে দেখেছিলাম সেই মেয়েটাই এই শাহিনকে গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে যায় গেটের সামনে। কষ্ট পাওয়া তো দূরে থাক, আমার কোন ধরনের অনুভুতিই নেই ওর উপর। সবাইকেই আমি বলেছি, নীলার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ইদানিং সবাই আমাকে পাগল ভাবে। যে লোকটা রাতের বেলা মদ খেয়ে এক মেয়ের গাড়ি থেকে নামে সেই লোকটাই নাকি আমার স্বামী। ওদের মনে হয় হিংসে হতো আমার সুখের সংসার দেখে। শাহিনকে ওরা খুঁজেও দিচ্ছে না। ওরা বলে এই শাহিনই আমার আগের শাহিন....
***
অনেকদিন হলো। আর সহ্য করা যায় না। থানায় যেতে হবে। জিডি করতে হবে। মদ খেয়ে প্রতিদিন যে লোকটা আমার বাড়িতে থাকে, লোকে যাকে আমার স্বামী বলে, ওই লোকটাকেই অনুরোধ করলাম,
- আমার একটু থানায় যেতে হবে। একটা জিডি করবো।
লোকটা একটু ভয় পেলো। কাঁপা গলায় বললো,
-কিসের জিডি?
আমি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললাম,
- আমার সবথেকে বড় সম্পদটা হারিয়ে ফেলেছি। সেজন্যই জিডি করবো। যাবেন আমার সাথে একটু?
লোকটা রাজি হলো। উনাকে নিয়েই থানায় গেলাম।
পুলিশ জিজ্ঞেস করলো,
- কিসের জন্য জিডি করবেন?
আমি বললাম,
-প্রায় একমাস যাবত আমার স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছি না।
যে লোকটিকে এখনো সবাই শাহিন বলেই জানে, উনি উঠে দাঁড়ালো। আমার হাত ধরে বললো,
- কিসব উল্টোপাল্টা বলছো। তাহলে আমি কে? বাসায় চলো।
পুলিশগুলো হাসছে। একটা শব্দ আমার কানে স্পষ্ট শোনালো,
- আরে ভাই বাসায় না পাগলা গারদে নিয়া ভর্তি করান।
রাগে ইচ্ছে করছে সবগুলো পুলিশকে খুন করি। লোকটি আমার হাত ধরে টেনে হিচড়ে থানা থেকে বের করলো। আমি বারবার মিনতি করে বলছি,
- আপনি আমার স্বামী হতে যাবেন কেন? ছাড়েন আমাকে প্লীজ। জিডিটা করতে দেন। আমি আমার স্বামীকে অনেক মিস করি।
সেদিন আমাকে জিডি করতে দেয়নি। মনে হয় আমার স্বামীকে ঐ মেয়েটা মেরে ফেলেছে। তাই হাতের চুড়ি, নাকফুল সব খুলে ফেলেছি। সিদ্ধান্ত নিলাম এই বাড়ি ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো । নিজের কাছেই নিজে এক সপ্তাহ সময় নিলাম। মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবো এটা নিয়েই ভাবতে হবে....
***
রাত দুইটা বাজে। আমি লিখতে পারছি না। আমার হাত থরথর করে কাঁপছে। কারণ আমি মাত্র ধর্ষিত হলাম ঐ শাহিন রুপী মাতালটার কাছে। সবাই বলে ও নাকি আমার স্বামী! কিন্তু কই? ওর জন্য তো আমার একটুও অনুভূতি জন্মালো না। বরং অন্যসব ধর্ষিতা মেয়ের মতোই আমার এখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার নীলার কি হবে? তাছাড়া এই সমাজের কাছে তো আমি ধর্ষিতা না। সমাজের কাছে বিঁচার দিলেও বলবে পাগল হয়ে গেছি। সমাজের চোখে তো ঐ মাতাল, চরিত্রহীন ছেলেটাই আমার স্বামী! খুব তাড়াতাড়ি এই বাড়ি ছাড়তে হবে।
***
গতকালের মতো আজকেও আমাকে ধর্ষণ করতে এসেছিলো। মেরে ফেলেছি মাতালটাকে! কত বড় সাহস! বটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছি। আহা! মনের ভিতরে একধরনের তৃপ্তি পাচ্ছি। হয়তো এই সমাজ আগামীকাল পত্রিকায় লিখবে,
"বউয়ের হাতে স্বামী খুন!"
কিন্তু আমি তো আমার স্বামীকে খুঁজেই পাই না প্রায় একমাস যাবত। আমিতো মাতাল, চরিত্রহীন, ধর্ষক একটা জানোয়ারকে মেরেছি।
***
জেলখানার কনডেম সেলের ছোট্ট খুপরিতে বসেই সময় পার হচ্ছিলো এই কয়েক মাস। আজ ডায়েরিটা হাতে পাওয়াতে প্রায় ছয়মাস পর জীবনের অন্তিম মুহুর্তের শেষ কিছু কথা লিখতে বসলাম।
আমার বিচার কার্যক্রম দ্রুত ট্রাইবুনালের মাধ্যমে করা হয়েছে। আলোচিত শাহিন হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার মৃত্যুদন্ডের রায় দেওয়া হয়েছে।
আজ আমার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। আমার শেষ ইচ্ছে জানতে চেয়েছিলো। আমি বলেছি, আমার মেয়ে আর আমার বাবা-মার সাথে দেখা করতে চাই। আর আমার ডায়েরি-টা আমার মৃত্যু কার্যকর করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সাথে রাখতে চাই। ইচ্ছেগুলো পূরণ করেছে।
এতক্ষণ আমার মেয়ে আমার সাথেই ছিল। আমি বসে ছিলাম। নীলা আমার কোলে চুপ করে দুই হাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিলো। আমি এতোদিন কারাগারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলাম। একফোটা চোখের পানিও ফেলিনি। আর খুন করার জন্য কোন অনুশোচনা মনের ভিতর একবারও তাড়া দেয়নি। বরং আমি হাসিমুখেই মৃত্যুটাকে বরণ করতে চেয়েছি। নীলার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করছে। বাবা-মার সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা হলো। কি যে কান্না করছিল দুজন! আমি তখন হেসেছি!
- কেন কাঁদছো তোমরা? এত মায়া কিসের এখনো? আমি দেখা করতে চেয়েছি শুধু আমার মেয়েটাকে যেন তোমরা দুজন ভালোভাবে দেখে রাখো এটা বলার জন্য, যাও এখন।
বাবা কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো। আমি খুব রাগী কন্ঠে পুলিশকে ডাক দিয়ে বললাম,
- উনাদের দুজনকে বের করেন এখান থেকে এই মুহূর্তে।
কান্না করতে করতেই বের হয়ে গিয়েছে উনারা।
নীলাকে আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে দুজন নারী পুলিশ। আমার মেয়েতো আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সে কি কান্না! আমি চোখ বন্ধ করে শুধু সৃষ্টিকর্তাকে বলছি, 'আমার মেয়ের কান্না দেখার ধৈর্য দাও আমায়...
নীলাকে নিয়ে যাওয়ার দুই মিনিট পরও ওর চিৎকার আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার পাশে যেসব মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিলো তারাও কান্না করছিলো মা মেয়ের দৃশ্য দেখে।
আমি উনাদের দেখে হাসার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চোখের পানি থামাতে পারছিলাম না। এক পুলিশ আপা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে উচ্চস্বরে কেঁদেই দিল। আমিও কারো কাঁধে মুখ লুকিয়ে কান্না করতে চাচ্ছিলাম। উনার কাঁধে মুখ লুকিয়ে ভিষণ কান্না করলাম।
সময় প্রায় শেষ। এখন আমি ঠিক আছি। আমার মেয়েকে সৃষ্টিকর্তা দেখবেন। এ পৃথিবীর কাছে আমি অপরাধী হলেও নিজের মনের কাছে নিরপরাধ। বিদায় পৃথিবী.....
-----আউশি সিকদার।
****
ডায়েরি-টা নিঃশব্দে বন্ধ করলাম। চোখ দিয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিলাম। নীলার দিকে তাকালাম।কেমন যেন এক ধরনের হাহাকার মনের ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার। চোখদুটো খুব জ্বালাপোড়া করছে। লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। নীলা আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখদুটোও ছলছল করছে। গাল ভিজে আছে। ও নিজেও কান্না করেছে।
নিজেকে সামলে অনুতপ্ত স্বরে শুধু বললাম,
- সরি।
চোখ বন্ধ করে কান্না করছি। নীলা আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মাথা রেখে ও নিজেও কান্না করছে। আমি ওর কানের সামনে মুখ নিয়ে বললাম,
- আন্টি একদম নিরপরাধ ছিলেন।
এবার নীলা উচ্চস্বরে কান্না শুরু করলো। হাউমাউ করে কান্না! কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো,
- আমার মা অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন, অনেক কষ্ট পেয়ে।
★সমাপ্ত★