এক অনিশ্চিত স্তব্ধতায় ছেয়ে গিয়েছিল আমার জীবন। দুটো বর্ষাকাল শেষ হবার পরও যখন সেই নিরবতা কাটলো না তখন আমি বুঝতে পারলাম এটা অনন্তকাল ধরে চলবে। হতাশা নয়। এটা এরকম একটা মুহূর্ত,যেটা কখনো কাউকেই বোঝানো সম্ভব নয়। এমনকি নিজেকেও না। সাঁতার জেনেও বিষাদের বর্ণহীন রঙে আমি ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। নাকি কেউ আমায় অতলে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো তা আমার অজানা। যেখানে অস্তিত্বের সংগ্রামে মানুষ নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেয়,সেখানে আমি বারংবারই নিজের অস্তিত্বকে মুছে দিতে চাইছিলাম। নিজের অসীম ভাগ্যকে ত্যাগ করে কামনা করছিলাম নিজের মৃত্যুর।
কিন্তু হতাশা বা নৈরাশ্যের স্তরে মানুষ বেশিদিন থাকে না। আমার সাথেও সেটাই ঘটলো। আমিও একটা সময় পর সব ভুলে সাধারণ জীবনযাপন করতে শুরু করলাম। তবে ভাগ্য আমায় সঙ্গ দিলো না। বইয়ের পাতা উল্টানোর মতো করে কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে আমার জীবন থেকে আরো কয়েকটি বর্ষাকাল চলে গেলো। সাথে করে নিয়ে গেলো আমার বেঁচে থাকার সকল পিছুটান। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর যখন মা মারা গেলেন তখন আমি বুঝলাম এ বিশ্বচরাচরে আমি এখন স্বাধীন। বহুকাল ধরে বদ্ধ রুমে আটকে থাকা পাখিটা যেমন ছাড়া পেয়ে খুশিতে পাগল হয়ে যায় আমার অবস্থাটাও ঠিক সেরকম। আমি সেরকমই স্বাধীন ভেবেছিলাম নিজেকে সেদিন।
অনুভূতি শূন্য মানুষ আমি। তাই তাদের মৃত্যুতে আমার দুঃখ হয়নি কিংবা হয়তো তাদের মৃত্যুটা আমায় আরো হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে পরিশেষে আমার জীবন থেকে যখন "নাম নেই" নামের মেয়েটা চলে গেলো, মুমূর্ষু স্তব্ধতা যেন আমার আত্মার সাথে মিশে গেলো তখন। আমি বুঝতে পারলাম আমার জীবনে আর কোন পিছুটান নেই। এখন আমি পরিনত হতে পারবো সত্যিকারের আমিতে।
তখন আর ঘুম ভাঙলে কোন কিছুর তাড়া থাকতো না। থাকতো না জগতের কোন কিছু নিয়ে কৌতূহল! দুঃস্বপ্ন গুলোও সময়ের চিলেকোঠার কোন এক কোণে হারিয়ে গিয়েছিলো। কারণ চিন্তা শূন্য একজন মানুষ কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে? সব কিছুকেই রঙহীন, ধূসর, একঘেয়ে ও বিরক্তিকর লাগত। নিজেকে অনেকটা সমুদ্রের কিনারায় পড়ে থাকা এক খন্ড নিষ্প্রাণ পাথর মনে হতো, যার জলের তৃষ্ণা নেই ঠিকই, কিন্তু জল তাকে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যায়। চোখের সামনে কিছু ফ্যাকাসে চিত্র প্রতিনিয়ত ভেসে বেড়ায়,যা কিনা আমার মানবজীবনে তীব্র হতাশা নামিয়ে দিচ্ছিলো। হতাশা থেকে ক্রমাগত ছড়িয়ে পরা শাখা প্রশাখা গুলো বিষন্নতার পথেই বিস্তারিত হয়। কারণ নতুন পথের দিশা তাদের কাছে নেই। তারপর হতাশা যখন আমার চৈতন্যে পুরোনো আত্মার মতো ভর করত, তখন আমার হাতের আঙুলের চামড়াগুলো রুক্ষ হয়ে প্রাচীন শেওলার মতো ঝরে পরত দেহ থেকে।
আমার অর্ধমৃত প্রাণ জীবন ত্যাগ করে একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছিল সভ্যতার নামে তৈরি হওয়া ব্যাধিগ্রস্ত এক সমাজের স্বার্থের প্রবল দাপটের মধ্যে। যেই সমাজ ধ্বংসকে ঘিরে সমাবর্তিত, সেই সমাজ আমায় বাঁচিয়ে রাখবে কি করে? তাইতো বিকেলের শেষ আলো বর্ণচ্ছটা মেঘের শরীর ভেদ করে যখন অন্ধকার মুছে দেয়ার চেষ্টা করতো তখন ধূসর বিষন্নতা সমস্ত পৃথিবী থেকে মুছে গিয়ে আমার মধ্যে জড়ো হয়ে আমার হৃদয়কে অসহনীয় যন্ত্রণায় ভরে দিতো। এরপর দিনের শেষ ভাগের শুরুতেই আমার ক্লান্ত দেহ তার এই অস্তিত্বের ভার বইতে না পেরে নেতিয়ে পরতো, তারপর যখন রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিত আর ওমনি শরীর ডুবে যেতে থাকতো তোশকের ভিতরে। নরম তুলোরা আমার হাতে পায়ে সুরসুরি দিতেই আমি তলিয়ে যেতাম গভীর নিদ্রায়। তখন সটান তীব্র দৃষ্টি দিয়ে একটি কাঁচের বাজপাখি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাকে দেখে মনে হতো আদিকাল থেকে সে ক্ষুধার্ত। এই বুঝি সে আমাকে মৃত ভেবে খেতে চলে আসে।
মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আমার ঘর্মাক্ত চিন্তায় জীবনের ভাঁজ পরত। নিজেকে বুঝাতাম, জীবন আমাকে জায়গা দিবে কি দিবে না তা আমার জানা নেই কিন্তু আমি আর জীবনকে আমার জীবন নিয়ে সমাজ ও সমাজের অর্থনীতির হিসেব করতে দিবে না। যেমন করে শহরের বড় বড় দালানের নিচে চাপা পরে যায় হাজারো বৃক্ষের মৃত্যুর গল্প,তেমনি আমার অস্তিত্বকে আমি এ জীবনের নিচে চাপা পরে যেতে দিবোনা। এসব চিন্তা করতে করতে আবার হুট করেই তলিয়ে যেতাম গভীরতম নিদ্রাহীন নিদ্রার মাঝে ।
বহুদিন পরের কথা, কোন এক মনে না রাখা আষাঢ় মাসের বর্ষাকাল তখন। সন্ধের শুরুতে যখন আকাশে মেঘ ভার করেছিলো তখন আমি এক পুরাতন বৃক্ষের পাশে গড়ে তোলা বেঞ্চে বসে এক আবহমান নদীর দিকে চেয়ে ছিলাম। শীতল হাওয়া বইছিলো। সাথে ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি। কত যুগ পর এই বৃষ্টি আমার গায়ে তার প্রলয়ঙ্কারী চিত্র এঁকে দিয়েছিলো,সেটাও বোধকরি আমার মনে নেই। তবে একটি ঘটনা আমার মনে রয়ে গেছে। আমি সেদিন বর্ষাকালকে সেই নদীতে ডুবে যেতে দেখেছিলাম। এটা দেখার পর কোনদিন আমি আর বাড়ি ফিড়িনি।