পোস্টস

পোস্ট

বত্রিশ বচোর থ্রি সেবেনটি নাইন করা লোকের কতা বলতে এসেচি, বাওয়া!

১০ জুন ২০২৪

অয়ন ইসলাম

গৌরচন্দ্রিকাঃ

হেঁ, হেঁ – লেকার নাম শুনেই তো মালুম হচ্চে কার কতা বলচি। যদি এখনো বুজতে না পারো, তবে চুপ করে ডেঁড়িয়ে থাকো সব্বাই। খবদ্দার, নড়েচো কি মরেচো!  কী বললে, একনো বুজতে পারোনি? লে হালুয়া! তাহালে এরা তো দেকচি জান কেরোসিন করে দেবে! তবে ইনিও যে সে পাত্তর নন, বাওয়া! ইনি স্বয়ং সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ চৌধুরী। তা, ডেঁড়িয়ে কেন, মশিয়েগণ! একটা করে সীট লিয়ে ডাউন হয়ে যান। এক মিলিটেই ইনার কতা সব পরিষ্কার করে বুজিয়ে দিচ্চি। 

প্রিয় পাঠক, কাল্পনিক এই স্বগতোক্তি থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কার কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আজকের চরিত্র বিশ্লেষনের পাত্রটি আর কেউ নয়, বাংলা রহস্য সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি, একমেবাদ্বিতীয়ম, আদি ও অকৃত্রিম গিলটি মিঞা। 

পুরো বইয়ের জগৎ তো বাদই দিলাম, শুধু এক রানা সিরিজেই কতশত প্রিয় চরিত্রের সমাহার। মাসুদ রানা বাদ দিলেও রাহাত খান, সোহেল, গগল, রেমারিক, রডরিক-ল্যাম্পনি, আতাসি-মার্শিয়া কিংবা গোঁফের ফাঁক দিয়ে বিশ্রী করে হাসা মিশ্রী খান – কতজনই তো এসে উঁকি দিয়ে যায় মনের মুকুরে। তারপরও যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে রানা সিরিজের কোন একটা চরিত্র নিয়ে লিখবো, তখন কিভাবে কিভাবে যেন এই কেলেকুলো বেঁটে মানুষটা অসীম ভালোবাসার দাবী নিয়ে সামনে এসে হাজির হয়ে গেলো। তার এই নিষ্পাপ ভালোবাসা অবহেলা করবে সে সাধ্য আছে কার? তাই আর দেরি না করে আসুন চট জলদি একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক গিলটি মিঞা নামের এই সাধারণ অথচ অসাধারণ চরিত্রটির উপর। 

 

শুরুর কথাঃ

যাঁদের জানা নেই, তাঁদের জন্য আগে গিলটি মিঞা তথা মাসুদ রানা সিরিজ নিয়ে একটু বলি আগে। এসপিওনাজ বা স্পাই থ্রিলার বললেই বিশ্বব্যাপী মানুষজনের সবার আগে মনে পড়ে ডাবল ও সেভেন ওরফে জেমস বন্ডের কথা। কিন্তু আশি/নব্বই এর দশকের বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা যে কোন বইপড়ুয়াকে জিজ্ঞেস করুন - এক মূহুর্ত দ্বিধা না করে উত্তর আসবে - মাসুদ রানা! হ্যাঁ, মাসুদ রানা - আমাদের, একান্তই আমাদের ন্যাশনাল হিরো। সেবা প্রকাশনী থেকে নিয়মিত প্রকাশিত বাংলা স্পাই থ্রিলার সিরিজের নাম চরিত্র মাসুদ রানা। লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন ওরফে কাজীদা। সেই ১৯৬৬ সালে ধ্বংস পাহাড় বই দিয়ে এই সিরিজের যাত্রা শুরু, চারশতাধিক বই নিয়ে এখনো পর্যন্ত সে যাত্রা সগৌরবে বিরাজমান। মাসুদ রানা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা বিসিআইয়ের (কাল্পনিক) একজন দুর্দান্ত দুঃসাহসী স্পাই, আর রানা এজেন্সী নামের বেসরকারী গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। গোপন মিশন নিয়ে রানা ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। বিভিন্ন মিশনে বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে বিভিন্নভাবে তাকে সহায়তা দেয়। কোন কোন চরিত্র ঘুরে ফিরে আসে একাধিক বইতে। এমনই একটি চরিত্র গিলটি মিঞা, যাকে দেখা গেছে সাগর সঙ্গম থেকে শুরু করে নীল আতংক, বিদেশী গুপ্তচর, ব্ল্যাক স্পাইডার, পপি, হাইজ্যাক ইত্যাদি অনেক বইয়ে।  

গিলটি মিঞার সাথে সিরিজের মূল চরিত্র মাসুদ রানার দেখা হয় সাগর সঙ্গম নামের বইতে। ছোটখাট, কালো রঙের এই মানুষটার প্রতি রানার অন্য রকম একটা মমতা তৈরি হয় শুরুতেই। পরে দেখা যায় গিলটি মিঞা পেশায় একজন চোর। আর রানা না জেনেই এই ঝানু চোরকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসে খুনীর হাত থেকে। কৃতজ্ঞ গিলটি মিঞা নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে পেশায় চোর হলেও সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত, অনুগত এবং কর্মতৎপর একজন মানুষ। রানাকে ভালো লেগে যাওয়ায় সে থেকে যায় রানার সাথে, রানাও তার সাথে জড়িয়ে পড়ে মায়ার এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে। এরপর আরো বিভিন্ন বইয়ে এসেছে গিলটি মিঞা। রানার সংস্পর্শে এসে চুরিবিদ্যা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তার প্রাক্তন পেশায় অর্জন করা বিভিন্ন দক্ষতা ও যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে প্রায়ই রানাকে অপরিসীম সাহায্য করে। 

 

কিছু তথ্যঃ 

এবার কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক গিলটি মিঞা সম্পর্কে। প্রথম কথা প্রথমে – কাজীদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র হচ্ছে গিলটি মিঞা। 

নামঃ তার পুরো নাম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ চৌধুরী। নাম শুনে রানা বলেছিল “বলো কী, সৈয়দের ছেলে হয়ে তুমি…”। তাতে গিলটি মিঞার নিষ্পাপ উত্তর – “আমি সৈয়দের ছেলে না, স্যার। আমার ছেলেপুলে যারা হবে তারা হবে সৈয়দের ছেলে। নামের সামনে পিচনে নিজেই দুটো ছাপ মেরে নিইচি। এ রকম অনেকেই করচে হরহামেশা। একবার চালু হয়ে গেলে আর ঠেকায় কে? কেউ সন্দো করে না।”

এই তো গেলো আসল নামের বৃত্তান্ত। কিন্তু এই নামকেও ছাপিয়ে যে নামে পাঠকের কাছে সে সর্বাধিক পরিচিত, সেই গিলটি মিঞা নামের উৎপত্তি? নামটা নাকি গিলটি মিঞার ওস্তাদের দেয়া। তাই এ নামে আপত্তি করেনি সে। যদিও তার “পচোন্দ না” এই নাম। গিলটি কথাটার মানে ভাল না। বারবার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই কথাটা স্বীকার করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়ে পাঁচবারের বার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই বলে উঠেছিলো – গিলটি। এই শুনে তার ওস্তাদ হেসেই খুন। তার নামই দিয়ে দিলো গিলটি মিঞা। সেই থেকে এই নামেই সে জায়গা করে নিয়েছে পাঠকের মনে।

শারীরিক বৈশিষ্ট্যঃ গিলটি মিঞার শারীরিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে – “লম্বায় বড়জোর চার ফুট তিন ইঞ্চি। যেমন বেঁটে, তেমনি শুকনো, আর তেমনি মিশমিশে কালো।” মাঝে মাঝে কোন বইয়ে দেখা যায় তাকে বাম পাটা টেনে টেনে হাঁটতে। তবে খূঁড়িয়ে হাঁটুক আর ঠিক করেই হাঁটুক, গিলটি মিঞার চলাফেরা একেবারে বেড়ালের মত নিঃশব্দ। পায়ের শব্দ তো দূরের কথা, কাপড়ের সামান্যতম খসখস শব্দও ওঠে না সে হাঁটার সময়ে। 

অস্ত্রঃ শুরুতে কোন অস্ত্র ছিল না গিলটি মিঞার কাছে। গোলাগুলিতে তার ভীষণ ভয় বলে পিস্তল-রিভলভার চালাতেও চায়নি। পরে রানা এজেন্সী তথা বিসিআই তার জন্য একটা স্পেশাল রিভলভারের ব্যবস্থা করে দেয়। বুলেটের বদলে এই রিভলভার মার্বেল ছুঁড়ে মারে। এই অস্ত্র পেয়ে গিলটি মিঞা এতটাই খুশি যে অনুশীলন করে করে অসাধারণ দক্ষ হয়ে উঠেছে সে। মার্বেল ছুঁড়ে ঘরের অন্যপ্রান্তে রাখা টিকটিকির ডিম ফাটিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। 

 

চরিত্র পর্যালোচনাঃ

ভাষাঃ গিলটি মিঞার কথা বললে সবার আগে যে জিনিসটা মানসপটে ভেসে ওঠে তা হলো তার ভাষা। “ক্যালকাটা” শহরের উচ্চারণে বাংলা বলা গিলটি মিঞার ভাষাটা খুব মজার শোনায়। কাজী আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য অনুযায়ী তিনি গিলটি মিঞার ভাষার জন্য তাঁর মায়ের বাচনভঙ্গীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কাজীদার মা বড় হয়েছিলেন কলকাতা শহরে। তিনি যে ভাষায় কথা বলতেন, সেটাকেই একটু অদল বদল করে কাজীদা বসিয়ে দিয়েছেন গিলটি মিঞার মুখে। আর গিলটি মিঞার সেই বিখ্যাত উক্তি – নড়েচো কি মরেচো! বাংলা সাহিত্যে যদি না-ও হয়, তবে অন্ততঃ বাংলা রহস্য সাহিত্যেই একটা অমূল্য সংযোজন। এই সুযোগে একটা কথা বলে রাখি – নড়েচো কি মরেচো কথাটা আমার কাছে পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো কিংবা আমারে নিবা মাঝি লগে ইত্যাদির চেয়ে কোন অংশেই কম মনে হয় না। 

উক্তির কথা যখন উঠলোই, তখন আরেকটি জিনিস খোলাসা না করে বললে চলছে না। চুরির শাস্তির ক্ষেত্রে আইনের ধারার নাম্বার হচ্ছে তিনশত ঊনআশি। এই সূত্র ধরে চুরি না বলে গিলটি মিঞা বলে থ্রি-সেবেনটি নাইন। বত্রিশ বছর ধরে এই পেশায় থাকার কারণে গিলটি মিঞার আরেকটি বিখ্যাত উক্তি “বত্রিশ বচোর এ লাইনে আচি।”   

গিলটি মিঞার ভাষার কথা বললে “ইন্টারন্যাশনাল জবান” উল্লেখ করতেই হবে। যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলে নিই। ঘটনা হচ্ছে, বিদেশী কোন ভাষা গিলটি মিঞা জানে না, এমনকি শুদ্ধ বাংলাও বলতে পারে না। অথচ পৃথিবীর যে কোন লোকের সাথে, তার ভাষা যাই হোক না কেন, মনের ভাব আদান প্রদানে ওর কোন অসুবিধা হয় না। কীভাবে? এর উত্তরই হলো ইন্টারন্যাশনাল জবান। দুনিয়ার বহু দেশে গেছে গিলটি মিয়া, কমবেশি কিছুদিন করে থেকেছে। সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা থেকে কিছু প্রচলিত শব্দ মুখস্থ করে নিয়েছে সে। এভাবে বাংলা, উর্দু, হিন্দী, আরবী, ফার্সি, ইংরেজী, জার্মান, রুশ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ সহ আরও কিছু ভাষার সংমিশ্রণে অদ্ভুত জগাখিচুড়ি নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করে নিয়েছে সে। হ্যাঁ, এটাই ইন্টারন্যাশনাল জবান। এবং এটা বুঝতে কোন দেশের কোন ভাষাভাষী মানুষেরই অসুবিধা হয় না। তবে…, - শুধু বিদেশীদের সাথে এই ভাষায় কথা বলে গিলটি মিঞা । বাংলাদেশীরা তার মুখের বাংলা তবু হয়তো বুঝে নেবে, কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল জবান কিছুই বুঝবে না!

ব্যক্তিত্বঃ গিলটি মিঞার চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে সারল্য। সে একেবারে শিশুর মত সরল। বারবার বিভিন্ন বইতে তার এই দিকটা খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। এর পাশাপাশি ফুটে উঠেছে তার অন্তর - এক্কেবারে নিষ্কলুষ। সাধারণতঃ দেখা যায় সহজ সরল চরিত্রগুলো বোকাসোকা কিসিমের হয়ে থাকে। কিন্তু গিলটি মিঞা মোটেই বোকা নয়। শারিরিক দূর্বলতার কারণে সে হয়তো শত্রুপক্ষের জন্য আতঙ্কজনক কেউ নয়, কিন্তু তাই বলে সে আবার নিতান্ত নির্বিরোধী, নিপাট ভালোমানুষ গোছেরও কেউ নয় যে ইচ্ছে হলেই কেউ তাকে পাপোশের মত মাড়িয়ে দেবে। গরম দেখাতে এসে কতজন “চোটপাট দেকাবেন না বাওয়া, আমি রানা এজেন্সির ডিটেকটিব আচি” টাইপের ধমক খেয়ে লেজ গুটিয়ে মানে মানে কেটে পড়তে বাধ্য হয়েছে। কিংবা প্রধান ভিলেনের চোটপাট শুনতে শুনতে হাত পা বন্দী থাকা গিলটি মিঞা এ অবস্থাতেও ঐ ভিলেনেরই মুখ তাক করে থো করে থুথু ছুঁড়ে মেরেছে। তাই শিশুর সারল্য, নিষ্পাপ অন্তর আর সাহসী ব্যক্তিত্ব - এই তিনে মিলে গিলটি মিঞা হয়ে উঠেছে এক অনন্য চরিত্র, যার জুড়ি নেই কোথাও। 

গিলটি মিঞা অত্যন্ত বিশ্বস্ত। রানা চোখ বন্ধ করে যাদের উপরে ভরসা করতে পারে, তাদের মধ্যে গিলটি মিঞা একজন। আর রানার প্রতি ওর ভালোবাসা! “আপনার দাম লাক টাকা হলে আমার দাম হাজার টাকা” বলে রানার হাত থেকে নিজের হাতে বোমা নিতে চেষ্টা করার মধ্যে দিয়ে রানার প্রতি যে অপরিমেয় ভালোবাসার প্রকাশ পাওয়া যায়, তার তুলনা কোথায়? 

দূর্বলতাঃ বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না – চোরের মন পুলিশ পুলিশ? প্রবাদটা তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি! চোরের মধ্যে পুলিশের ভয় বোধহয় সহজাত। একুশ দফা জেল আর হাজতখাটা গিলটি মিঞাকেও তাই দেখি আমরা পুলিশের আতঙ্কে আধমরা হয়ে যেতে! আর একটা ভয় বোধহয় দারোগার মার। মাঝে মধ্যেই দারোগার মারের কথা বলে গিলটি মিঞা। 

 

শেষ কথাঃ

রানা সিরিজে গিলটি মিঞার আবির্ভাব ছিলো অনেকটা কমিক রিলিফ হসেবে। কিন্তু সেখান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সে বিশাল মাপের একটা চরিত্র হয়ে গেছে, আর আপামর পাঠকের মনে একটা বিশেষ স্থান দখল করে ফেলেছে। পার্শ্ব চরিত্র হলেও গিলটি মিঞা ছাড়া রানা সিরিজ যেন পানসে, যেন লিকার ছাড়া দুধ চা!