কুড়িগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভ্রমণ
উত্তরের এই জনপদের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য- যা সমগ্র উত্তর বাংলা থেকে কুড়িগ্রামকে ভিন্ন করেছে। শুধু তাই নয়, কুড়িগ্রামের প্রতিটি উপজেলার প্রাচীন ইতহাস দারুণ সমৃদ্ধ।
‘ভাওয়াইয়া গানের ধাম, নদ-নদীময় কুড়িগ্রাম’ কুড়িগ্রাম জেলা স্লোগানটিতে বোঝা যায় ভাওয়াইয়া গান আর নদীবিধৌত অঞ্চল হিসেবে কুড়িগ্রামের সুখ্যাতি রয়েছে। কুড়িগ্রামের প্রতিটি উপজেলার প্রাচীন ইতহাস আমাকে দারুণ সমৃদ্ধ করেছে। চলুন যাই কুড়িগ্রামের ঐতিহ্য ভ্রমণে—
এই ভ্রমণ রচনায় পুরো কুড়িগ্রামের ঐতিহ্য ভ্রমণ তুলে আনা সম্ভবপর নয়। তাই অল্প কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ভ্রমণ গন্তব্য পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। ভ্রমণ শুরু করছি তাহলে জেলা সদর থেকে। জেলা শহরের তিনটি জিনিস দারুণ অভিভূত করেছে আমাকে। একটি জাহাজবাড়ি, পরিত্যক্ত একটি বিশ শতকের ভবন আর পুরোনো রেলস্টেশন। যদিও এই স্থাপনাগুলোর কোনোটাই খুব বেশি যত্নে নেই। এটিই আমাদের সীমাবদ্ধতা। ইতিহাসের উপকরণের কমতি নেই আমাদের, শুধু পর্যটকদের জন্য দেখার উপযোগী করে উপস্থাপন করা নেই।
বিশ শতকের ভবন :
কুড়িগ্রামের প্রায় মানুষ এই ভবনটিকে বলে কুড়িগ্রামের জমিদারবাড়ি। এটি ছিল আসলে এসডিওর বাসভবন। এসডিওর অর্থ হলো সাব-ডিভিশনাল কর্মকর্তা, যিনি ছিলেন মহকুমার প্রধান কর্মকর্তা। কুড়িগ্রাম মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হওয়ার পর নিশ্চয়ই ভবনটি পরিত্যক্ত হয়। জেনেছি পরে টেলিফোন অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এখন একেবারেই ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাই দোতলায় উঠবার সাহস হলো না। এই ভবনের অবস্থান শহরের সবুজপাড়া এলাকায়। কাঠামো দেখে এটিকে ২০ শতকের বলেই অনুমেয় হয়। তবে সঠিক নির্মাণকাল জানতে পারিনি।
পুরাতন রেলস্টেশন :
বেশ কয়েক বছর আগে একটি ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম কুড়িগ্রাম শহরের, সোর্সটা মনে পড়ছে না এখন। শহরের মাঝখান দিয়ে রেলপথ। দারুণ মনকাড়া ও ভিন্নরকম লেগেছিল ছবিটি। বিকালের আলো প্রায় নিভু নিভু। সে সময় গিয়ে দাঁড়ালাম পুরোনো রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। যদিও দেখে বোঝা যায় না সেটি প্ল্যাটফর্ম ছিল। আমার ছবি তোলা দেখে, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। আরও বললেনÑ ‘ঢাকা থেকে কেউ এসে, ভাঙা রেলস্টেশনের ছবি তুলছে, এই প্রথম দেখলাম আমি।’ ওনার সঙ্গে বসেই মিনিট বিশেক কথা বলে পুরোনো স্টেশনটা সম্পর্কে অবগত হলাম। পুরাতন স্টেশন এলাকা এক সময় ছিল জাঁকজমকপূর্ণ এলাকা। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৭ সালে। ১৯৬০-এর দশকে বলা যায়, এটি ছিল শহরের বিনোদনকেন্দ্র। খুঁজে খুঁজে দেখলে রেলস্টেশনের অবকাঠামো চোখে পড়ে। বেশির ভাগ স্থানে লোকালয় গড়ে উঠেছে। সোনালি দিন এখন শুধুই স্মৃতি।
মুন্সীবাড়ি :
মুন্সীবাড়ির অবস্থান উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ি ইউনিয়নে। মুন্সীবাড়ি যাওয়ার আগে আমি ভাবছিলাম এটি মুসলিম কোনো জমিদার বা অভিজাত বণিকের বাড়ি। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে বুঝতে পারলাম। এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, তবে টাইটেল মুন্সী কেন! সেই ইতিহাসে যাওয়ার আগে উলিপুর সম্পর্কে দু-চার কথা না বললেই নয়। সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবেই উলিপুর পরিচিত। থানা প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৯৩ সালে। ইসলাম প্রচারে কিছু অলি এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তাই এই এলাকার নাম হয়েছে উলিপুর। আবার ধামশ্রেণির শিবমন্দির, দোলমঞ্চ রয়েছে এ অঞ্চলে। ব্রিটিশ সময়ে এটি ছিল একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। বাংলা একাডেমির বইতে পড়েছি মুন্সীবাড়ির নির্মাণকাল ১৮৮০ সাল বা তার কিছু পূর্বে।
কিংবদন্তি ও জনশ্রুতি থেকে যেটুকু জেনেছি, স্বামীর মৃত্যুর পর স্বর্ণময়ী দেবী এই অঞ্চলের জমিদার হন । এলাকায় জমিদার স্বর্ণময়ী দেবী প্রতিষ্ঠিত স্কুল রয়েছে, যার নির্মাণকাল ১৮৬৮ সাল। জানা যায়, স্বর্ণময়ী ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ও প্রজাদরদি জমিদার। তার অধীনে মুনসেফের চাকরি করতেন বিনোদি লাল। সেই মুনসেফ বা মুন্সী থেকেই এই বাড়ির নাম মুন্সীবাড়ি। বর্তমান কালের সাক্ষী হয়ে যে অট্টালিকাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি তৈরি করেন বিনোদি লালের পালকপুত্র শ্রী ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী। স্থানীয়রা বলছেন, জমিদার, বিনোদি লাল কিংবা ব্রজেন্দ্রলালের কোনো সন্তানাদি ছিল না। এখন জমিদারবাড়ির আশপাশে সেবায়েতরা বসবাস করছে। আর মন্দিরে পূজা-অর্চনা ও দেখভাল করছে। বর্তমানে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বোর্ড ঝুলছে। উলিপুর থেকে ফেরার সময় ক্ষীর মোহন খেতে ভুলবেন না যেন!
চান্দামারী মসজিদ :
চান্দামারী মসজিদের ছবি বইতে দেখেছি একদম সাদা রঙ করে ফেলা হয়েছে। অবকাঠামো দেখে এটিকে মুঘল সময়ের মসজিদ মনে হয়। তাই সেটির রঙ সাদা হওয়ার কথা নয়। বোঝা যাচ্ছে পরবর্তীতে সংস্কার করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর থেকে অটোরিকশায় চেপে যখন চান্দামারী মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালাম, কিছুক্ষণ থমকে থাকলাম। মসজিদের তিনটি গম্বুজ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না মসজিদের সামনে থেকে। মসজিদ চত্বরে সামনের অংশ এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে, পুরো মসজিদটি ঢাকা পড়েছে। উপরন্তু সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে নকশা করা টাইলস।
ঘড়িয়াল ডাঙ্গার অজানা মঠ :
রাজারহাটের জমিদারবাড়ি দেখব বলে চান্দামারী মসজিদ থেকে ঘড়িয়াল ডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা করেছি। পথে জিজ্ঞেস করতে করতে যাচ্ছি, কেউই বলতে পারছে না জমিদারবাড়ির কথা। ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নে প্রবেশের মুখে গ্রামের একজন বয়োজ্যেষ্ঠের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন ‘কিসের জমিদার বাড়ি, কোথাও কিছু নেই, শুধু একটি মন্দির আছে।’ তিনি জানালেন জমিদারের নাম ছিল যোগেশচন্দ্র রায়। অল্প দূরে যেতেই চোখে পড়ল প্রায় মৃত একটি মঠ। গ্রামবাসীর কাছে কোনো তথ্যই পেলাম না। বাড়িঘর সব বিলুপ্ত। বিলুপ্ত না বলে, দখল হয়ে গেছে বলা ভালো। মঠ আর এর পাশে রয়ে গেছে বিশাল দীঘি। মঠটির বেশ কয়েকটি জায়গায় ফাটল ধরেছে। কতদিন আর টিকবে কে জানে! এরপর রাজারহাটের একজন ইতিহাসপ্রিয় ব্যক্তি খন্দকার আরিফের সঙ্গে কথা হয় ডিজিটাল মাধ্যমে। ওনার কাছে জানতে পারি ঘড়িয়ালডাঙ্গা জমিদারির কথা। ঈশানচন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন ঘড়িয়ালডাঙ্গার জমিদার। দত্তকসূত্রে তিনি জমিদার হয়েছিলেন। চন্দ্রের মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র রায় ও যোগেশচন্দ্র রায় নামক তার দুই পুত্র দীর্ঘকাল জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন।
নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ী:
প্রায় বিলুপ্ত নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ি। ফুলবাড়ী উপজেলায় এর অবস্থান। ফুলবাড়ী থানা সদর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৪ সালে। স্থানীয় অভিমত অনুসারে এই অঞ্চলে নানা ধরনের ফুলের চাষ হতো। তাই নামকরণ হয়েছে ফুলবাড়ী। স্থানীয় জমিদার জগৎ দেবেন্দ্রনাথ রায় এই নামকরণ করেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফুলবাড়ী কুড়িগ্রাম জেলার একমাত্র থানা, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন ও মুক্তাঞ্চল ছিল।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে নাওডাঙ্গার পরগনার জমিদার বাহাদুর শ্রীযুক্ত বাবু প্রমাদা রঞ্জন বক্সী এটি নির্মাণ করেন। পরবর্তী জমিদারির উত্তরসূরি বীরেশ্বর প্রসাদ বক্সী নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়িতে একটি মাইনর স্কুল এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে নাওডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজ। জমিদারবাড়ির অল্পকিছু দূরে একটি মঠ রয়েছে, সেটি জমিদারবাড়ির অংশ ছিল বলে অনুমান করছি। সেটিরও দেখলাম বেশ সংস্কার সাধন হয়েছে। কুড়িগ্রাম থেকে ফুলবাড়ী উপজেলা সদরের বাজারে এসে সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে জমিদার বাড়ীটি।
বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজ:
বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ব্রিজগুলোর মধ্যে একটি। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গ সোনাহাট ইউনিয়নে অবস্থিত। ব্রিজটি দুধকুমার নদের ওপর দিয়ে অবস্থিত। ভারতের মনিপুর রাজ্যে বাংলাদেশের লালমনিরহাট থেকে ইংরেজরা রসদ ও সৈন্য স্থানান্তর করার কাজে এই সেতুটি নির্মাণ করে। ১৮৮৭ সালে বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। প্রাচীন এই সেতুটি দিয়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতায়াত করত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা এই সেতুটির একটি অংশ বোমায় উড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সেতুটি আবার মেরামত করা হয়। বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজটি মূলত একটি রেলসেতু। সেতুটি প্রায় ১২০০ ফুট লম্বা। বঙ্গ সোনাহাট সেতুতে দাঁড়ালে চারপাশের দৃশ্য সত্যিই বেশ মনোরম। সেতুর ওপর থেকে সূর্যাস্তের মোহনীয় দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। আমিও উপভোগ করেছি।
আমি ঢের বুঝতে পারছি, অন্য ভ্রমণকারী ও পাঠকের কুড়িগ্রামের ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ জন্মেছে। দেরি না করে বর্ষা শুরুর আগেই ঘুরে আসুন কুড়িগ্রাম।
কুড়িগ্রাম সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য –
মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুল কুড়িগ্রাম জেলার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নির্মাণকাল ১৮৬৮ সাল
বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম কুড়িগ্রাম ভ্রমণ করেন ১৯৩০ সালে।