সাল ১৯১৫।
ঐ জামাল মিয়া ঘরে আছো নি?? জমিদারের পেয়াদা শমসের ডাকছে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। বুকের ভেতর ধকধক করছে। কিছু খাজনা বাকি আছে। শাস্তি দেবে নিশ্চই। ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে বউটা। দড়ির উপর রাখা জামাটা টান দিয়ে নিয়ে পড়ে দরজা খুলে বেরুলাম। না শমসেরের চোখ ঠান্ডা, আগুন নেই। তবে ঘটনা কি?
সালাম। এই সময়ে আসলেন?
হ। জমিদার বাবু তোরে ডাকতাছে।
আমারে??
হ।
কেন?
চল। গেলে বাবুই বলবেন।
কৌতুহল আর ভয় মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। চললাম শমসেরের সাথে। পেছনে ফিরে দেখি বউয়ের চোখ ছলছল করছে। ভয় পেয়েছে ও। আমি স্বাভাবিক হওয়ার ভান করলাম।
জমিদারের বাড়ি পৌছে দেখি আরও ১৫-২০ জন দাড়িয়ে আছে। সব জওয়ান চাষা। বয়স্ক কেউ নাই। সবার চোখে কৌতুহল।
একটু পর আসলেন জমিদার জগদীস বাবু। সাথে থানার বড় বাবু। বিশাল গদিতে আরাম করে বসলেন জমিদার বাবু। হুকাবরদার হুকা এগিয়ে দিলো। আয়েশ করে বাবু কয়েকটা টান দিলেন।চোখ মুঁদলেন। তারপর চোখ খুলে নায়েবকে বললেন যারা আসছে তাদের মধ্য থেকে তাগড়া দেখে ১০ জনকে রেখে বাকিদের বিদায় দিতে। নায়েব হুকুম তামিল করলো। ১০ জনের ভেতর আমি পড়ে গেলাম।
বাবু হেসে বললেন, “কি খবর তোদের??”
আমরা মুখ চাওয়া- চাওয়ি করতে লাগলাম। এইরকম বদমেজাজি, বাজখাই গলার জমিদার এত সুন্দরভাবে কথা বলছেন কেন।
আজ্ঞে কত্তা ভালো.....
ভালো তো থাকবিই।ব্রিটিশরাজের রামরাজত্বে বাস করিস তোরা।যুদ্ধ লাগছে শুনছিস?
কিসের যুদ্ধ কত্তা?
আরে মূর্খের দল সাহেবদের সাথে জার্মানদের যুদ্ধ লাগছে।
কত্তা জার্মান কারা?
ওত জানা লাগবে না তোদের। তোরা যুদ্ধে যাবি। গভমেন্টের জন্য যুদ্ধ করবি। কেউ আর একটা বাড়তি কথা বলবি না। এখন থানার বড়বাবুর সাথে যা।
আজ্ঞে কত্তা।
আমাদের কলিকাতা পাঠানো হলো। সেখান থেকে জাহাজে করে করাচী। জীবনে প্রথম সমুদ্দুর দেখলাম।বিশাল জাহাজ। বিটিশগো কতো বুদ্ধি রে… এত্ত বড় জাহাজ পাল- বৈঠা ছাড়াই মেশিং দিয়া চালায়!!! সেই মেশিং আবার কয়লা খায়। ইয়া মাবুদ। শুনেছি রেল গাড়িও নাকি কয়লা খায়।কলিকাতা আসার সময় জীবনে প্রথম রেলে চড়লাম। সে বিশাল শকট। সাহেবদের কোনো কাজই আমার মাথায় ঢুকে না। এদের সাথে যুদ্ধ করে পারার সাধ্য কার??
জাহাজ পৌছলো করাচী বন্দরে। ট্রেনিং শুরু হলো আমাদের। এতদিন পুলিশের কাছে বন্দুক দেখেছি। স্বপ্নেও ভাবি নি নিজ হাতে বন্দুক চালাতে পারবো। কত রকম কৌশল শিখালো। এই বন্দুক দিয়া গুলি কইরাও নাকি শত্রু ঠেকানো সম্ভব না। শত্রু চলে আসতে পারে একেবারে হাতের কাছে। তাই বন্দুকের সাথে ছুড়ি লাগিয়ে হাতাহাতি লড়াই করতে হবে। ছুড়ির নাম বেয়নেট। ট্রেনিং এ কষ্ট হলেও তিন বেলা পেট পুরে খেতে পারছি। এটাই আশার কথা।
ট্রেনিং ক্যাম্পে দিন ভালোই কাটতে লাগলো। কত জাতের মানুষ!! বাঙালি, পান্জাবী , গুজরাটি, মারাঠী……..। ট্রেনিং যখন শেষের দিকে তখন নতুন একটা বাঙালি ছেলে আসলো। নাম নজরুল। চমৎকার গান গাইতে পারে। শুনেছি ওর কবিতাও নাকি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে।
আমাদের যুদ্ধ যাওয়ার সময় চলে আসলো। কীসের জর্মনদেশ কিসের কি। আমাদের পাঠানো হলো বসরায়।মুসলমান সৈনিকরা ফিসফাস করতে লাগলো ঐটা তো রাবেয়া বসরীর দেশ। একটা বিষয় খেয়াল করলাম। সিপাহিদের প্রতিটা ইউনিটে সাহেবরা হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে দিয়েছে। শুধু হিন্দু বা শুধু মুসলিম কোনো ইউনিট নাই।