পোস্টস

গল্প

জীবন ফুরাবার আগে।

১০ জুন ২০২৪

ওয়ালিউর রহমান

মূল লেখক মোঃ ওয়ালিউর রহমান

খুব দ্রুত নতুন এক শহর গড়ে উঠছে। যেন চঞ্চল কিশোরীর মতো। এ ঘর ও ঘর থেকে এ পাড়া ও পাড়া সবখানেই তার বেখেয়ালী পায়ের ছাপ।সেই দূরন্ত নবীন শহরের কোলঘেঁষে এক নিভৃত গ্রাম।নাম—জাহানপুর। খেটে খাওয়া মানুষের বাস সেখানে।তাদের জীবনে নেই চাকচিক্য আর আভিজাত্যের বাহাদুরি।প্রান্তিক এসব মানুষের গল্পও কেউ শোনে না, শোনার আগ্রহও পায় না।একজীবন তারা স্বপ্নহীন কাটিয়ে দেয় অবলীলায়।খুব কম চাহিদা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় তারা প্রথম হবে নির্দ্বিধায়।

ধরনীর অন্য সকল প্রান্তের ন্যয় জাহানপুরেও রোজ সূর্য ওঠে।রাতে ওঠে গোলাকার চাঁদ। মেঘহীন আকাশে বসে তারাদের মেলা।রাতের বৃক্ষরা দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দেয় সবুজপল্লীর প্রতিটি ঘর।জোনাকির আলো বৃক্ষদেহে দেয় আলোর অলংকার।এসব দৃশ্যে প্রকৃতিপ্রেমী কোন কবি তার কবিতার কাঁচামাল পাবে বৈকি।কিন্ত নিরীহ সরল  ঐসব খেটে খাওয়া মানুষের তাতে পেটে সামান্যতম অন্ন পড়বে না।এসব ঐশ্বরিক সৌন্দর্য তারা চেয়েও দেখে না।দেখে আনন্দও পায় না।
তাই তো রোজ কাক ডাকা ভোরে শুরু হয় তাদের জীবন সংগ্রাম।এসব সংগ্রামের নেপথ্যে থাকে একেকটি চরিত্র। যারা নিয়মমাফিক জীবনকে বয়ে নিয়ে যায় গন্তব্যে। নিরুৎসাহিত গন্তব্যে পৌঁছে শুরু হয় 
ফেলে আসা রঙিন সময়ের হিশেব-নিকেশ।

টিন আর কাঠের বন্ধুত্বে গড়ে ওঠা এক নির্জন গৃহে একা বসে আছেন বৃদ্ধ আজগর। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে তিনি আজ ক্লান্ত। চুলে শুভ্রতার চিহ্ন। শরীরের চামড়ায় কুঁচকানো ভাব। দেহশক্তিতেও যেন ভাটা পড়েছে।বেশিদূর হাঁটতে দু পা সায় দেয় না।চোখে দেখা দৃশ্যগুলোও মনে হয় ঢেউয়ের মতো, আকাঁবাঁকা, অমসৃণ। যৌবনের স্মৃতি রোমন্থন করেই বেলা কাটে তার।জীবন সংসারে এখন তিনি একা।একদা আনন্দে কাটানো জীবটাই তার কাছে পানসে লাগছে আজকাল।সংগ্রামের পথে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যেন খেই হারিয়েছেন। 
কিসের যেন শুন্যতা সারাক্ষণ বুকজুড়ে ছোটাছুটি করে।কিন্তু কারণ খুঁজে পায় না সে।নিয়ম করে আহার, আর স্রষ্টার ইবাদাতে দিনের সমাপ্তি ঘটছে প্রত্যহ।বার্ধক্যের রোগগুলো তার নিয়মিত খেলার সঙ্গী।তাদের মন জুগিয়ে খেলা টিকিয়ে রাখতে হয়,নইলে যে সব তছনছ হয়ে যাবে।মাঝে মাঝে এনে দিতে হয় বাহারি সব বিস্বাদ ফল; যার অন্য নাম— ঔষধ ।একাকিত্বের দংশনে জীবনের শ্বাস আটকে যেতে চায় সর্বক্ষণ। বিদায়ের স্বাদ নিতে মন হয়ে ওঠে মরিয়া।কিন্তু চাইলেই কী স্বেচ্ছায় বিদায় নেয়া যায়।পৃথিবীর এ অতিথিশালায় যাওয়া-আসা হয় এক অদৃশ্যের ইশারায়।ফিরে যেতে তার ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকতে হয়। স্বার্থপর সমাজের শুশ্রূষার নাটকে সবাই তাকে ভালোবাসে বটে, কিন্ত সবাই যে বিরক্ত তা সে টের পায়।শেষ বেলায় শরীর যে বড্ড নিরুপায়। কারো উপদ্রবে পরিণত হতে তার মনও সায় দেয় না।কিন্তু কিবা করার আছে তার।
কোমড়ে গামছা পেঁচিয়ে আজও তার ফিরতে ইচ্ছে করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ঢেরায়।ইচ্ছে করে ঘরময় কোলাহলে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে, কিন্তু তা যে অসম্ভব! এটাই যে জগতের নিয়ম।এ নিয়ম যে তাকে মান্য করতে হয়।
শুন্য ঘরে কেউ যে তাকে সঙ্গ দেয়ার নেই,কাঠপোকাদের কাতর আর্তনাদ তাই সাক্ষ্য দেয়।
জানালার ফাঁক গলে হুড়োহুড়ি করে কিছু সূর্যআলো এসে পাসে বসে আজগরের।সেই  আলোর সাথে একান্ত আলাপে নিজের ভুলগুলো শুধরে আসার সুযোগ খুঁজে দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে সে।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,কেন এমন হলো?
সবারই কী এমন হয়?আমার জীবনে কী খুব বেশি ভুল ছিল।বৃদ্ধ বয়সে সবার মনের ভাবনা কী আমারই মতন হয়?

মূলঘরের দরজার সন্নিকটে  দুলতে থাকা নারকেল পাতায়,  ফ্যাফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাতর আজগর হিশেব মিলাতে চায় ফেলে আসা দিনগুলোর।যৌবনে সব ছেড়ে যাদের গড়তে অকাতরে নিজেকে বিলিয়েছেন,তারাই যেন আজ খুব অচেনা।
তাদের কাছে ঘেঁষতেও বড় সংকোচ হয়। দায়িত্বের পাহাড় নিয়ে ছুটে চলা পথে কতবারই তো হোঁচট খেয়ে আবারও উঠতে হয়েছে স্থির হয়ে।নিজের স্বাদ আহ্লাদকে পাত্তা পেতে দেননি ক্ষুণাক্ষরেও। 
পরম যত্নে পরিচর্যা করেছেন, আগলে রেখেছেন নিজের বাগানের সব ফুল।আক্ষেপ জেগে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, বাগানভরা সেসব সুবাসিত ফুল হারালো কোথায়!
কোথায় গেল সুখ-দুঃখ নিবেদনে চাহিদা পূরণ করে নেয়া সেসব মুকুলগুচ্ছ ।
আজ বৃদ্ধ বড় একা, একাকীত্বে ভরা আশিতীপর বৃদ্ধ আজগরের জীবন।

সময়ের হেলায় বৃদ্ধ আজগরের নিবাসে থাকা কোলাহল ছড়িয়ে গেছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।তাকে একা করে।একাকীত্বের যন্ত্রণা দিয়ে।যারা চলে গেছে,তারা হয়তো
আর ফিরবে না।তিলে তিলে দেহভেজা  ঘামের বিনিময়ে যে রত্নখনি গড়ে তুলেছিলেন আজগর,যেসব রত্নগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর শোভা বর্ধনে চারিদিকে।সেগুলোর চাকচিক্য ঢিকে আছে সংসারধর্মে।একটু বিবর্ণ হতেই তা নেমে আসবে আসগরের কাতারে।তারপর শুরু হবে তাদের একাকীত্ব, তাদের বিদায়ের ক্ষণগণনা। সমাজের বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিশেবে সমাধি ঘটবে আরো অনেক আজগরের।