পোস্টস

চিন্তা

আমাদের সংস্কৃতির বিপর্যয় কীভাবে ঘটছে?

১০ জুন ২০২৪

মোঃ হাছান

মূল লেখক মোঃ হাছান

সারাদেশে তরুণদের মাঝে পশ্চিমা সংস্কৃতি চর্চা যেন বেড়েই চলেছে। তাদের কাছে যেন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে মাদক সেবন, ছেঁড়া-ফাঁড়া পোশাক থেকে গ্যাং কালচার। মূলত হিন্দি বা ইংরেজি ছবির কাল্পনিক চরিত্রগুলো তাদের কাছে বাস্তব মনে হয়। বছর তিনেক আগেও মুরব্বি বা নিজের থেকে বয়সে বৃদ্ধ কাউকে দেখলে তরুণরা সম্মান শ্রদ্ধা সবকিছুই প্রকাশ করত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই টিকটক প্রজন্মের তরুণরা যেন ভিন্ন সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সমাজে বিষফোড়ার মতো এ টিকটক প্রজন্মটা গড়ে উঠছে। তাদের উগ্রতা বা সহিংসতা কতটুকু তা যাচাই করতে হলে আপনাদের টিকটক সামাজিক মাধ্যমে চোখ গুলতে হবে অথবা  ঢাকা শহরের জানজট পূর্ণ রাস্তায় দেখা যাবে ছিনতাই বা চাঁদাবাজিতে অথবা স্টেশনে মাদক সেবনে ব্যস্ত এ টিকটক প্রজন্মটা। তাদের আরও সহিংসতা প্রবণ করতে পাবজি বা ফ্রি ফায়ার মতো খেলাগুলো দেশে প্রচলিত আছে। এ ধরনের মাধ্যমগুলোতে যেসব তরুণরা আসক্ত তাদের সঙ্গে সাধারণ তরুণদের পার্থক্য করলেই বোঝা যাবে কতটুকু উগ্র এবং সমাজের জন্য বিষফোড়া এ টিকটক প্রজন্মটা।


 

আসলে এসব বিনোদনের মাধ্যমগুলো কীভাবে সংস্কৃতির পরিবর্তন করছে সেটা আমাদের লক্ষ্য করা দরকার। তবে শুধু টিকটক বা পাবজির জন্য তরুণরা ভিন্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে এমন না। পর্নোগ্রাফি ও মাদকের ছোবলে তরুণ প্রজন্মটা সহিংসতা প্রবণতা হয়ে যাচ্ছে। তাদের গ্যাংয়ের দাপটে ধরাশায়ী হয়ে গেছে দেশের এক শ্রেণির মানুষ। এলাকার মুরব্বিদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে এ অপসংস্কৃতি চর্চার ফলে। কেন যেন সবাই সবার কাছে অপরিচিত। তরুণ প্রজন্মটা কেমন এক অভেদ্য দেওয়ালে বন্দি হয়ে আছে। সুস্থ সংস্কৃতি ও তার বিকাশ না থাকায় তরুণরা বাধ্য হয়েই নিজেদের অজান্তে জড়িয়ে পড়ছে এক ভয়ংকর জগতে। এর ফলাফলও চাইলে দেখতে পারেন আপনার শহরের অলিগলিতে। সেখান অল্পবয়সি তরুণরা নেশায় বিভোর। হিংস্র করেছে কাউকে, কেউ আবার পাগল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এমন সংখ্যা কম নয়। সংস্কৃতির সঠিক চর্চার অভাবে তরুণ তরুণীরা নিজেদের জানান দিতে, শৌর্য, বীর্যের অবস্থা ব্যবহার করছে আজ টিকটক নামক এ মাধ্যমকে। আর তাদের এ অপসংস্কৃতি চর্চার প্রভাবে রাস্তাঘাটে পথেপ্রান্তে মানুষকে মারধর, হয়রানি, নেশা, ইভটিজিং, কখনো বাইক যোগে দূরে গিয়ে জমি দখল, এলাকার দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজি এবং সেই টাকায় ফুর্তি করার অপরাধ বেড়েই চলেছে।


 

সাধারণভাবে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির একটি স্বতন্ত্র রূপ থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের সংস্কৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাহলে যদি আমরা বাংলাদেশের কথা বলতে চাই, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, পশ্চিমা সংস্কৃতি বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর উলেস্নখযোগ্য মাত্রায় প্রভাব সৃষ্টি করতে বিভিন্ন তৎপরতা চলছে। টিকটক, ফেসবুক রিল্‌স, ফ্রি ফায়ার, পাবজি অথবা ভয়ানক পর্নোগ্রাফি উঠতি বয়সের তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয়, তা যে ভাষায়ই বলা হোক না কেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ অপসংস্কৃতি খুব ধীরে ধীরে আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করেছে, যার নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে অশ্লীলতার অবাধ প্রসার যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বৃদ্ধি। তবে এসব ছাড়াও ভারতীয় মাধ্যমগুলো ফেলে দেওয়ার মতো না। যার প্রমাণ্য চিত্র উঠে আসে সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীর মাইজদীতে নির্মম পরিণতির শিকার তাসমিয়া হোসেন অদিতা তার 'সর্বশেষ' দৃষ্টান্ত। যিনি তার নিজের বাসায়ই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। হত্যার দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেওয়া আবদুর রহিম স্বীকার করেছেন তিনি ভারতীয় একটি ধারাবাহিক ছোট দৈর্ঘ্য সচেতনতামূলক সিরিজ ক্রাইম পেট্রোল দেখে এসব শিখেছেন। উপরোলিস্নখিত 'সর্বশেষ' শব্দটি লেখার কারণ হলো ক্রাইম পেট্রোল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘটানো এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে পিরোজপুরে ১৩ বছর বয়সি এক কিশোরকে অপহরণের পর হত্যা, চট্টগ্রামে টাকা না পেয়ে ভাবিকে হত্যা, একই জেলায় মা-ছেলেকে হত্যা, কেরানীগঞ্জ এবং সাভারে দুই রিকশাচালককে হত্যাসহ বহু চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের পর আসামিরা জবানবন্দিতে ক্রাইম পেট্রোল দেখে শেখার কথা বলেছেন। শুধু হত্যাকান্ড নয়, ক্রাইম পেট্রোল বা ভয়ানক পর্নোগ্রাফির প্রভাবে ধর্ষণ, চুরি, অপহরণ, নিপীড়নসহ অনেক অপরাধ ঘটানোর নজির রয়েছে- যা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বারবার ওঠে এসেছে। আসলে এসব মাধ্যমগুলো বিনোদনের জন্য ব্যবহার হলেও তার ভিন্ন প্রভাব পড়ছে আমাদের সংস্কৃতিতে।


 

এখন প্রশ্ন আসাটা অস্বাভাবিক নয় যে, টিকটক, ফ্রি ফায়ার, পাবজি, পর্নোগ্রাফি, ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের সঙ্গে অপরাধের যোগসূত্র কী? এর কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জনসাধারণকে বিনোদন দেওয়ার জন্য এসব মাধ্যমগুলোতে এমন সব নেতিবাচক কৌশল প্রচার করছেন- যা সাধারণত জনসাধারণের কাছে অজানাই থাকে। এই মাধ্যমগুলো থেকে অপসংস্কৃতি শিখে তা বাস্তবে প্রয়োগ করে সমাজে অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে উঠতি বয়সের তরুণরা। এছাড়াও পাবজি বা ফ্রি ফায়ার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সহিংসতায় জড়ানোর অহরহ নজির রয়েছে। এটি সত্য যে, আমাদের দেশে যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার একমাত্র কারণ অবাদে বিনোদন মাধ্যমগুলো ব্যবহার, সেটা টিকটক অথবা পাবজি বা ভারতীয় সিরিয়াল যাই হোক না কেন।


 

তবে শুধু বিদেশি বিনোদন মাধ্যম বা পর্নো সাইটগুলো যে সংস্কৃতি ধ্বংস করছে এমনটা না। দেশের সিরিয়ালগুলো আজ অশ্লীলতা বা বেহায়াপনার চর্চা করছে। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। কিছু নতুন পরিচালক তাদের জনপ্রিয়তা বা সমালোচনার জন্য এমন ধরনের চলচ্চিত্র এবং নাটক প্রচার করে। যেখানে সব অশালীন দৃশ্য বা নোংরা সংলাপ ব্যবহার করছে- যা যে কোনো সভ্য সমাজে সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে তারা সমাজে চরম নৈতিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছেন, যাদের মূল লক্ষ্যবস্তুই হলো এই দেশের তরুণ প্রজন্মটা। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের একটি বহুল আলোচিত-সমালোচিত ধারাবাহিক ওয়েব-সিরিজ 'হোটেল রিলেক্স'। যাতে কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ এবং নোংরা সংলাপের সয়লাব ঘটানো হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বর্তমানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ এই সিরিজগুলোর নিয়মিত দর্শক। নাটকে প্রচারিত নোংরা সংলাপগুলো স্থান-কাল ভুলে অবাধে ব্যবহার করে তারা জানান দিচ্ছেন তাদের কতটা নৈতিক অবনমন ঘটেছে। এ ধরনের আরও অনেক অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে- যা শুধু অশ্লীলতারই প্রসার ঘটাচ্ছে- তা নয় বরং নিঃশেষ করে দিচ্ছে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আসলে তারা সংস্কৃতি চর্চার দোহাই দিয়ে অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত করছে তরুণ প্রজন্মটাকে। সেদিকে তাদের কতটা খেয়াল আছে সেটা আমাদের অজানা।


 

তবে এ অপসংস্কৃতি চর্চার থেকে বাঁচার একটি পথ হতে পারে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। অপসংস্কৃতিকে রুখতে প্রয়োজন সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ। দেশকে এই সাংস্কৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষায় বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের এগিয়ে আসা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নৈতিক শিক্ষাও, শিক্ষামূলক গুণাবলিবিহীন বিনোদনের উপাদানগুলো বর্জন করা। তাছাড়া নেতিবাচক বিষয়বস্তু সংবলিত অনুষ্ঠানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা থেকে বিরত থাকাও এখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অপসংস্কৃতি চর্চার বিরুদ্ধে সংস্কৃতিক কর্মীদের সজাগ থাকতে হবে। দেশের ইতিহাসে বারবার সংস্কৃৃতিক কর্মীরা এ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন, আগামীতেও করতে হবে। তারা বলেন, সংস্কৃতিক কর্মীরা যখন এগিয়ে যান, তখন সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। সংস্কৃতিক কর্মীরা মানুষের দৃষ্টি খুলে দেন। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটাতে না পারলে দেশ এগোবে না। এটা সরকার, শিক্ষক, মা-বাবাসহ সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। আজও দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে অনেকেই নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরে। স্বাধীন দেশে এটা হতে পারে না। এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজে সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে ছড়িয়েছে, তা অকল্পনীয়। তাতে নৈতিকতার চরম ক্ষয় হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকের অবমাননা ঘটছে। দুর্নীতি হচ্ছে, বখাটেপনা ছড়াচ্ছে সমাজে। সংস্কৃতি কর্মীদের কাজ হবে সমাজের এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।


 

এ অপসংস্কৃতি নির্মূল করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানবিক করার সংগ্রাম করতে হবে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে অসাম্প্র্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে মানুষের মুক্তির পথে সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে জেগে উঠতে হবে। মানুষের মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে। স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে সমুন্নত রাখতে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে রূপ দিতে সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে মানুষের জাগরণে আন্দোলনের বিকল্প নেই।


 

 স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও তাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সমাজ বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার অনুকূল নয়। আর নয় বলেই এখানে যে কোনো স্তর থেকে যে কোনো শিক্ষার্থী যে কোনো অন্ধবিশ্বাসে দীক্ষিত হতে পারে। জ্ঞানের দিক থেকে এটি স্থবির এবং যেহেতু স্থবিরতা প্রাণজ বস্তুকে পচন ও ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, তাই এ সমাজের অবস্থাও সে রকমই হচ্ছে। দালানকোঠা নির্মাণকেই গুরুত্ব দিচ্ছি; আরাম, ভোগ-বিলাস ও বিনোদন গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রাণের বিকাশ, জ্ঞানের আনন্দ মোটেও পাত্তা পাচ্ছে না। এটা সংস্কৃতির সংকট- যা শিশুকাল থেকেই শিক্ষার মাধ্যমে পাওয়ার কথা। শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে, যেমন সব বিষয়ের থাকে। শিক্ষার সংস্কৃতির নিহিত চাহিদা হলো মুক্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ, প্রকাশের স্বাধীনতা।