পোস্টস

সত্তাশ্রয়ী

আকসাকাল (সাদা দাড়িওয়ালা): প্রাচীন তুর্কি গুপ্তসংঘের রোমাঞ্চকর আদ্যোপান্ত!

১০ জুন ২০২৪

মো. মিজানুর রহমান

দিগন্ত বিস্তৃত স্তেপ তৃণভূমি। পাশেই নীল আকাশের পানে হাত বাড়ানো পাহাড়ের চূড়ায় বরফ জমতে শুরু করেছে। শুভ্র পাহাড়ের দেশ থেকে হু হু করে মৃদুমন্দো বাতাসের তোড়ে ভেসে আসছে শীত। গাছপালা তেমন নেই, যা আছে তা বন্য ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম আর ঘাসে মোড়ানো। উঁচু-নীচু ভূমির কোথাও সরু পাহাড়ি নদীর কাছে ঢালু, কোথাও বা সমতল। মাঝেমাঝে দেখা মিলছে ছোট্ট-গোলগাল টিলা। এদের গা বেয়ে শীতের আমেজ দ্রুতই প্রকট হয়ে উঠছে এখানে। এখানকার শীত ভয়ংকর-হীম। গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতেও পাহাড়গুলোর বরফ গলে না। 

বসতি বদলের এটিই উপযুক্ত সময়। যাযাবর তুর্কি গোত্রগুলোর প্রতি বছরের নিয়ম। গ্রীষ্মে ককেশাস, শীতে ওটোকান ও আরাল ভ্যালি। বসতি প্রধান আধোডুবো রক্তিম সূর্যটার পানে তাকান। গভীর ভাবনা ভেসে বেড়ায় তার মনে, আঁকিবুঁকি কাটে নানান উৎকণ্ঠা! কেননা, রাষ্ট্রহীন তুর্কি বে-রা জানে, নিয়তির উপরে ভর করে আর বেশিদিন টিকা যাবে না। শীঘ্রই খুঁজতে হবে স্থায়ী ভূমি। যেখানে তাদের সন্তানরা ফুলে-ফলে বড় হবে। তুর্কিদের পূর্বপুরুষরা নীল আসমানকে তাঁবু করে সাম্রাজ্য গড়েছিল, রাষ্ট্রের নাম রেখেছিল গোকতুর্ক। পৃথিবী এফোঁড়ওফোঁড় করে গড়ে তোলা গোকতুর্ক রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে কালের বিবর্ণ গহ্বরে। 

পূর্ব থেকে দুঃসাহসী মঙ্গোল বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, চাইনিজদের চোরাগোপ্তা হামলা, পশ্চিমের ভূখণ্ডে রোমান ও কাজার চাপ দুই ধাপে কব্জা করেছে রাষ্ট্রের ভূখণ্ড। কিছুকাল পূর্বেও তুর্কিদের পূর্বপুরুষ অঘুজ খান পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। শাসন করেছেন এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত৷ সেসময় কেউ টুঁ শব্দটি করে নি। এতসব জাতি দ্বন্দ্বও ছিল না। ছিল না গোত্রসংঘাত ও আন্তকোন্দলের রোষানলও। কিন্তু এখন? এখন সময় পাল্টেছে। কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা নেই। জোর যার মুল্লুক তার। শক্তি যার বিচার তার। অঘুজদের ভবিষ্যত ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। 



তাঁবুঘেরা অঘুজ বসতিগুলো ২৪টি গোত্রে বিভক্ত। কায়ি গোত্র অঘুজ তুর্কিদেরই একটি অংশ। অন্য গোত্রদের মতো তাদের জীবনধারা, গোত্র পরিচালনাও হাজার বছরের পুরোনো। তারা অদম্য সাহসী, বীরত্বের সাথে সাম্রাজ্যের জন্য লড়েছে। টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্ব। যদিও তারাও আজ রাষ্ট্রহীন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কখনো ককেশাসে, কখনো আনাতোলিয়ায়, কখনো-বা ওটোকানের পাহাড়ঘেঁষে হাজার বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্থায়ী বসতি গড়তে পারে নি। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা সামন্ততান্ত্রিক। সমাজ পরিচালনায় তাদের নিজেদেরও রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি। তাই তাদের সাথেও খুব একটা বনিবনা হয়ে উঠে না। 

কায়িরা আসমানী একক খোদায় বিশ্বাসী। অন্য গোত্রগুলোও কায়িদের মতোই একক খোদায় ঈমান এনেছে। কিন্তু, সামানদের স্রষ্টা অনেক। সমাজব্যবস্থাও বেশ বৈষম্যমূলক। তাই একক খোদায় বিশ্বাসীরা আলাদা সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। শীতের ঝাঁপটায় ভাগ্যকে আলিঙ্গন করে ওটোকান পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে। ওখানে শীত কম, জংলা ডোবা আছে, সরু নদী আছে, পশুদের জন্য পর্যাপ্ত সবুজ ঘাস আছে। আর আছে অতর্কিত আক্রমণ করে সুরক্ষা দেবে এমন সারি সারি পাহাড়, যারা অদূরে প্রাচীরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

যাযাবর তুর্কিদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পশুরপাল। পশুর চামড়া ও লোম পোশাক-আশাক ও কালিন (কারুকার্য খচিত কাঁথা) বুনতে সহায়ক। সামন্ত বাজারের ব্যবসায়ীদের নিকট এগুলো চড়া মূল্যে বিক্রয় করা যায়। বিনিময়ে মিলে মোটা অঙ্কের স্বর্ণমুদ্রা। যুদ্ধ-বিগ্রহে বসতিতে খাদ্যাভাব দেখা দিলে ভেড়ার মাংস খাবারের যোগান দেয়। দোহন করা দুগ্ধ মেটায় উষ্ণ পানীয়ের তেষ্টা। 



দেদে-করকুত অঘুজ গোত্রগুলোর উপদেষ্টা, কায়ি গোত্রের প্রধান। গোত্রের ভালো-মন্দ দেখাশোনা করাই তাঁর কাজ। আরো বে-রা আছে, তাঁরাও বসতি প্রধানকে গোত্র পরিচালনায় সহায়তা করে। কিন্তু, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও সহজ কথা নয়। একেকটি সিদ্ধান্ত বসতিকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। বরণ করতে হতে পারে চিরস্থায়ী ধ্বংস কিংবা আজীবনের দাসত্ব। শত্রুদের নিকট যত বেশি দাসী, তত বেশি সন্তান, তত বেশি সৈন্যবল। বাকিদেরকে বিক্রি করে দেবে। পাশেই রোমান সাম্রাজ্য, অর্ধ পৃথিবীর মালিক, তাদের দাসের বাজারও বেশ চড়া। তাই, এমন রক্ত কঠিন সিদ্ধান্তে ভাবনাচিন্তা করেই আগায় দেদে-করকুত। কেননা, এবারের বসতি স্থানান্তর সত্যিই হবে বেশ ভয়ংকর। 

জবুথবু শীতের হিমেল আবহাওয়া, সাথে পূর্ব দিক থেকে চীনা ও মঙ্গোলরা করতে পারে হামলা। পশ্চিমের পাহাড় পেরিয়ে জন্তুর মতো লাল চুলের সিথিয়ানরাও অপেক্ষায় গুনছে প্রহর। এরাও যেকোনো সময় করতে পারে চোরাগোপ্তা হামলা। এলোমেলো বসতিতে হামলা করলে ছিনিয়ে নেবে পশুগুলো। একত্রে পেয়ে যাবে নারী ও শিশুদের। দেদে-করকুত গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। একটা সুন্দর সিদ্ধান্তে পৌঁছা খুবই জরুরী। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। 



ইনালসার ইয়াভকুই হারানো রাজ্যের বর্তমান নবম ছায়া শাসক। বুকভরা বেদনা নিয়ে তিনি দেদে-করকুতের কাছে এসেছেন। বসতির অন্য বে-দেরও ডেকে পাঠিয়েছেন, বসেছেন আলোচনায়৷ তাদের দুঃখ এক, দুশ্চিন্তা এক, কোনোকিছুই পিছু ছাড়ছে না। সাম্রাজ্যের অন্য গোত্রগুলোর অবস্থাও নাজেহাল। পশু চুরি, শস্য আত্মসাৎ, স্বর্ণমুদ্রার অসম বণ্টন ও কৃষিজমির ভোগদখল নিয়ে ঝগড়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ধ্যানমগ্ন আলোচনা একসময় ক্ষান্ত হলো। সিদ্ধান্ত এলো, আশেপাশের সাম্রাজ্যগুলো ঘুরে দেখা হোক। কোন শক্তিকে পুঁজি করে তাঁরা সাম্রাজ্য গড়লো? কীভাবেই বা টিকে থাকলো- এসবের বৃত্তান্ত। 

ওটোকান পাহাড়ের নীচে বসতি স্থানান্তর শেষ। এবার খোঁজ-খবর নেবার পালা। দেদে-করকুত বিভিন্ন দিকে ঘোড়সওয়ার পাঠালেন। একে একে তারা খবরাখবর নিয়ে ফিরলো। রোমান ও পারস্যরা এতদিন যুদ্ধে মেতেছিল। এরমধ্যেই সম্রাট খসরু খুন হয়েছে। ক্ষমতা নিয়ে সহোদরদের মধ্যে দেখা দিয়েছে রেষারেষি। এই সুযোগে রোমানরা আনাতোলিয়া ও দাগিস্থান দখলে নিয়েছে। তাদের সহযোগিতা করেছে কাজাররা। কায়িদের সাথে কাজারদের বহুদিনের বিরোধ। তাদের পার্শবর্তী সিরিয়া সীমান্তেও চলছে আরব উত্তেজনা। 

আরবদের সম্পর্কে বার্তা সংগ্রাহক খুব বেশি জানতে পারে নি। এমন রাষ্ট্রের নাম আগে শোনেও নি। তবে, যতদূর জানা যায়, তারা নাকি বিনা রক্তপাতেই রাজ্য জয় করেছে৷ আশেপাশের বেশকিছু রাজ্যে চিঠিও পাঠিয়েছে। এরমধ্যে অনেকেই আনুগত্য স্বীকার করেছে৷ দেদে-করকুত আশার আলো পেলেন৷ কারণ, তাদের পূর্বপুরুষ অঘুজ খানও বিনা রক্তপাতে, চিঠি পাঠিয়ে বহু রাজ্য জয় করেছিলেন। এছাড়াও, আরবদের মহানায়ক নিজেকে খোদা-তায়ালার প্রেরিত পয়গম্বর দাবি করছেন। তিনি যা কিছুই করছেন, সবকিছুই নাকি সাজাচ্ছেন তার উপর নাজিলকৃত পবিত্র গ্রন্থের আলোকে। 



দেদে-করকুতের মনের বাসনা, তিনি আরবিস্থান যাবেন। দেখা করবেন একক খোদার প্রেরিত পয়গম্বরের সাথে। গ্রহণ করবেন তালিম। বসতির বে-দের নিয়ে পুনরায় আলোচনায়। এবার কায়ি বসতি নয়, পুরো অঘুজ তুর্কিদের সাফির (প্রতিনিধি) হয়ে সেখানে যাবেন তিনি। একসময় মদিনার উদ্দেশ্যে রওনাও করলেন, সফর মাসব্যাপী দীর্ঘ হলো। আনাতোলিয়া, পারস্য, রোম ও সিরিয়া হয়ে তিনি মদিনার ইয়াসরিবে এসে পৌঁছালেন। নবীজি (সা.)-এর কয়েকজন সাহাবীর সঙ্গে দেখা করলেন। মেলে ধরলেন অঘুজ প্রতিনিধিত্বের পতাকা। সম্মানজনক আথিতেয়তা পেলেন। জানলেন, আরবদের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস, অন্ধকার ও আলোর যুগের পরম বাস্তবতা। একক খোদার ইশারায় একজন এতিম শিশুর নবী জীবনের গল্প। যিনি কাফের-মুশরিকদের অত্যাচারে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন মদিনায়। 

মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি দেখিয়েছেন সেখানে। পৌঁছে দিয়েছেন সত্যের বাণী। দলমত গঠন করেছেন। অতঃপর, বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করলেন। দেদে-করকুত কয়েকদিন সেখানে অবস্থান শেষে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নবীজি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সাক্ষাতে উপস্থিত হলেন তিনি। মুগ্ধ হলেন নবীজির পবিত্র চেহারা মোবারকের দর্শনে। নিজেদের অতীত ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানালেন। জানলেন ভবিষ্যৎ করণীয়। এবং ফিরে আসার পূর্বে নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন- কখনো কী কুস্তন্তুনিয়া বিজয় হবে? এ প্রশ্নের জবাবে শুনলেন হাদিসে বর্ণিত সেই কিংবদন্তী বাণী- “নিশ্চয় একদিন কুস্তন্তুনিয়া বিজয় হবে। কতোইনা উত্তম সেই বাহিনীর অধিনায়ক, সেই বাহিনীও কতোই না উৎকৃষ্ট বাহিনী।” 

ভবিষ্যৎ সোনালী দিনের অফুরন্ত স্বপ্ন নিয়ে, ধন্যচিত্তে দেদে-করকুত বসতির পানে পা বাড়ালেন। বসতিতে ফিরেই অঘুজ গোত্র প্রধানদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন। খুলে বললেন বিস্তারিত। জানালেন ইতিহাস পরিবর্তনে সুমহান সুসংবাদ। ইসলাম ধর্মের কথা জানালেন। পৌঁছে দিলেন নবীজি (সা.) এর খবর। এসময়ই চারজন বে গ্রহণ করলেন সত্য ধর্ম ইসলাম। একীভূত হলেন শান্তির সুশীতল ছায়াতলে। সাহস ও উজ্জীবিত হৃদয়ে আলোকিত দেদে-করকুত বসতি পুনর্গঠনে নবরূপে মনোনিবেশ করলেন। সচেষ্ট হলেন গোত্র সংঘাত ও চলমান সকল অসন্তোষ নিরসনে। 



বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের দিকে অধিকতর মনযোগী হলেন। বুঝতে পারলেন, তাদেরকে জ্ঞানী ও সাহসী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে উৎকৃষ্ট জাতি গঠন করা যাবে। তৈরি করা যাবে দক্ষ, চৌকস ও দূরদর্শী ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। যারা রাজ্যের ভেতরকার সমস্যা সমাধানে কাজ করবে। সর্বদা নজর রাখবে শত্রুপক্ষের গতিবিধির উপর। পাশাপাশি তিনি হেকিম তৈরি করলেন, অস্ত্র তৈরির কারখানা, কারিগর ও রসদও মজুদ করলেন। বাজার গড়তে মনযোগী হলেন। বিয়ের ব্যাপারে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মতামতকে প্রাধান্য দিলেন। পরিবার প্রথা শক্তপোক্ত করলেন। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া অলঙ্ঘনীয় অঘুজরীতির প্রতি সম্মান রেখে বিনির্মাণ করলেন নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সমতাভিত্তিক সমাজ। 

বসতির ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনার পাশাপাশি বাচ্চাদের শিক্ষণীয় গল্পও শোনাতেন তিনি। কুপাজ (দুই তারের বেহালা সদৃশ বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে বর্ণনা করতেন পূর্ব পুরুষদের ঘটনাবহুল কাহিনী। অবতীর্ণ হলেন কূটনৈতিকের ভূমিকায়। এভাবে একসময় গোত্রের সব সমস্যার একক সমাধানস্থল হয়ে উঠলেন তিনি। আরবিদের মতো সাদা দাড়ি বড় করলেন। বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ মানুষ হলেন। বসতির মানুষজন তাকে আকসাকাল বা সাদা দাড়িওয়ালা ডাকা শুরু করলেন। একসময় অন্য গোত্রের বয়োবৃদ্ধ বুদ্ধিমান বে-দের নিয়ে তিনি গড়ে তুললেন তুর্কিদের প্রথম গুপ্তসংঘ, বরু বদুন। 

নেতৃত্ব প্রদানে বলিষ্ঠ এমন অঘুজ গোত্রগুলোর ৫০জন সামর্থ্যবান যোদ্ধার সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় এর প্রাথমিক ভিত্তি। তাদের উপাধি হয় জাতির নেকড়ে। এভাবে সাদা দাড়িওয়ালারা রাজ্যের সামর্থ্যবান পুরুষদের চিহ্নিত করে। তৈরি করে রাজ্যের ভেতর রহস্যময় ছায়া-রাজ্য। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করতো। সুফি ও দরবেশদের আশ্রয় দিতো। গুপ্তচর তৈরি করতো, নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে বের করে আনতো অন্য রাজ্যের খবর। নিখুঁত বুদ্ধিমত্তা, চৌকশ গুপ্তচর, চুলচেরা হিসাব দিয়ে তারা যেকোন পরিস্থিতি কন্ট্রোলে নিয়ে আসতো, যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতো। আর তাই স্বয়ং সুলতানরাও হয়ে থাকতো তাদের মুখাপেক্ষী। 



পাঁচটি অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত এ গুপ্তসংঘের লক্ষ্য- 

• আসমানের খোদা, একক খোদার কাছে আত্মসমর্পণ।
• দেশপ্রেম ও স্বদেশের ভালোবাসাকে হৃদয়ে ধারণ।
• সাম্রাজ্যের রীতিনীতিতে সর্বদা আনুগত্য প্রদর্শন।
• সততা ও ন্যায়নিষ্ঠ আচরণকে সর্বোত্তম মূল্যায়ন৷
• জ্ঞান ও শৃঙ্খলাভিত্তিক মজবুত সমাজ বিনির্মাণ। 

এছাড়াও, তাদের প্রতীক ছিল তিনটি আড়াআড়ি নতুন চাঁদ। বিদ্যমান ছিল সুসংগঠিত চারটি গ্রুপও। এরা হলো- 

প্রথম গ্রুপ – সাহসী যোদ্ধা
যুদ্ধের ময়দানে লড়াকু সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো তারা। দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতো৷ কখন পিছু হটতে হবে, কখন আক্রমণাত্মক মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে, এসব ভালোমতোই জানতো তারা। 

দ্বিতীয় গ্রুপ – গুপ্তচর
এ কাজের জন্য গোত্রের ভেতর থেকে ছোট্ট শিশুদের নির্বাচন করা হতো৷ খুব ছোট থেকেই তাদেরকে তালিম দেওয়া হতো। বিভিন্ন দূরদর্শী গোপন কাজে তুখোড় হিসেবে গড়ে তোলা হতো। অতঃপর, তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে মিশে যেতো। প্রাসাদে, গীর্জায়, সৈন্যদলে এমনকি শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতেও তাদের ছিল নিরব উপস্থিতি। অন্য গুপ্তচরদের গুপ্তচরবৃত্তি রুখে দিতেও তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। 

তৃতীয় গ্রুপ – কূটনৈতিক
তারা শত্রুপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, বন্দী বিনিময়, আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে যোদ্ধাদের অবহিতকরণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। সুলতানের প্রতিনিধির সঙ্গে গোপন বৈঠকেও তারা ছিল অগ্রগণ্য৷ 

চতুর্থ গ্রুপ – দরবেশ
মানুষকে বিনয়ী, সদালাপী, নীতি-নৈতিকতা, উন্নত চরিত্র গঠন, সৎ-সাহসের শিক্ষা দিতো তারা। গোত্রে গোত্রে আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা ও নৈতিকতার চর্চা করতো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, শায়েখ ইবনুল আরাবি, এদেব আলী, আহি এভরান, জালালুদ্দিন রুমি ও শায়েখ সদরুদ্দিন কুনেভি প্রমুখ। 



অঘুজ গোত্রগুলোর সৎ, সাহসী বে-রা সকলেই প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। সুলেমান শাহ, তার ছেলে আর্তুগ্রুল, নাতি উসমান গাজীও ছিলেন একেকজন আকাসাকাল। তাদের দৃঢ় সংকল্প- মিশন কিজিল এলমা! যার অর্থ লাল আপেল। প্রাচীন তুর্কি ভাষায় কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ঐতিহাসিক অভিযানকে নির্দেশ করে এটি৷ অঘুজদের ২৪টি গোত্র ছাড়াও অন্যান্য তুর্কিদের ভেতরেও ছিল আকসাকালদের সরব উপস্থিতি। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন মহান সংগঠক, স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্নে বিভোর সাদা দাড়িওয়ালা। 

সাদা দাড়িওয়ালারা সত্য ও ন্যায়ের আলোকঝাণ্ডা উঁচিয়ে তরুণ তুর্কিদের যুদ্ধের ময়দানে পথ দেখিয়েছেন। সচেষ্ট রেখেছেন নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে। তাই তুর্কিদের অতীতের সোনালী ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে বর্তমানে নির্মিত হয়েছে দিরিলিস আর্তুগ্রুল ও কুরুলুস উসমানের মতো রোমাঞ্চকর ড্রামা-সিরিজ। এসব সিরিজ দুঃসাহসী অঘুজ অধ্যায়ের পাতায় পাতায় পরিভ্রমণ করায়। নিয়ে যায় ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রাণবন্ত দিনগুলোর পানে। অনুভব করায় ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের। সন্ধান দেয় পুরনো শেকড়ের। যখনই ‘কিজিল এলমা’ শব্দটি প্রতিধ্বনিত হয়, তখনই এক রহস্যময় পরিবেশ নিয়ে আবির্ভূত হয় আকসাকাল বা সাদা দাড়িওয়ালারা। পুরো দৃশ্যপট পাল্টে যায়, চিন্তার জগতে ভর করে অজানা আতংক, ইঙ্গিত দেয় সুন্দর কিছু ঘটার, নতুন কোনো সিদ্ধান্তের। এসময় উত্তেজনা বিরাজ করে চরম আকারে। 

তুর্কিদের দূরদর্শিতা, সাহসিকতা, রণকৌশল, যুদ্ধ জয়, রাজ্য জয়, শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যকে রক্ষা, নাইট ও মঙ্গোলদের অত্যাচারী আগ্রাসন যোদ্ধার মতো প্রতিহতকরণ, রাজ্যকে পুনরায় সুসংগঠিতকরণ- এর সবটুকুই এই সাদা দাড়িওয়ালাদের অবদান। তাদের প্রতিষ্ঠাতা দেদে-করকুত (রাঃ)। ইতিহাস বিশ্লেষক রশিদুদ্দিন হামদানির (১৩১৮) মতে, তিনি ছিলেন একজন সাহাবী। তাই সম্মানস্বরূপ রাদ্বিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু বলা উত্তম। তিনি দার্শনিক ছিলেন, গায়ক ছিলেন, কবি ছিলেন। জীবদ্দশায় ১২টি মহাকাব্যও রচনা করে গেছেন। গান ও রচনার অনন্য সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে তার ‘কিতাবে দেদে-করকুত’। তিনি প্রায় ৩০০ বছর বেঁচে ছিলেন। ধারণা করা হয়, নবীজি (সা.) এর উফাতের ১০০ বছর পর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি। 



একদিন শান্তির ধর্ম ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কয়েকজন সঙ্গীসহ তিনি গমন করেন লেজগিইল প্যাগানিজদের অঞ্চলে৷ এসময় প্যাগানিজরা রাগের মাথায় উনাকে হত্যা করে। কয়েকবছর পূর্বে দাগিস্থানের পার্শবর্তী এক অদ্ভুতুড়ে গুহায় ‘ইমাম করকুত’ নামাঙ্কিত একটি রহস্যময় কবর খুঁজে পাওয়া যায়। সংরক্ষণের অভাবে একসময় হারিয়েও যায় সেটি! যদিও তার রচিত কিতাবে দেদে-করকুত ১৮১৫ সালে আবিষ্কৃত হয় জার্মানির ‘রয়্যাল লাইব্রেরি অফ ড্রেসডেনের’ পরিত্যক্ত একটি কক্ষে। 

এটি আবিষ্কারের পর পুরো পৃথিবীর সাহিত্যপাড়ায় সৃষ্টি হয় তুমুল আলোড়ন। মহাকবি দেদে-করকুত পরিণত হন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। বিশ্ব ইতিহাসের রোমাঞ্চকর ডায়েরিতে স্থান পায় তার হারিয়ে যাওয়া কর্ম-কাহিনী। বর্তমানে মহাকাব্যটি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকায় সংরক্ষিত আছে। তার প্রতিষ্ঠিত গুপ্তসংঘ ইসলামি স্বর্ণযুগেও পথ দেখিয়েছে দুঃসাহসী তুর্কি গোত্রগুলোকে। তুরস্কের পথে প্রান্তরে হয়তো আজও শোনা যায়, বাতাসে ভেসে বেড়ায় সেই অমলিন কোডওয়ার্ড- 

হে মুসাফির!
কোথায় যাচ্ছো?
–কিজিল এলমা-র দিকে। 

মনজিল কী?
–শাহাদাত। 

ভুসলত কী?
–স্বদেশ। 

স্বদেশ কোথায়?
–সমগ্র বিশ্ব। 

সমগ্র বিশ্ব তোমার স্বদেশ হোক, মনজিল তোমার পূর্ণ হোক, যে দিকে চলছো, সেদিকেই চলতে থাকো অবিরাম-অবিরত।



This is a Bengali article about the history of Aqsaqal. 
References:
1. দি অটোমান সেঞ্চুরিস: দ্য রাইজ এন্ড ফল অব দ্য তার্কিশ এম্পায়ার – লর্ড কিনরস
2. জামি আল তাওয়ারিখ: দ্যা হিষ্ট্রি অব সেলজুক তুর্কস – রাশীদুদ্দিন হামদানী
3. History of White Beards in Dirilis Ertugrul – HistoricalTV
4. Turkish Secret Organization | White Beards in Dirilis Ertugrul – Dirilis Wk.