আমি কবরের মতো দেখতে একটা গর্তে ঢুকে পড়েছি। না, এটা আসলে একটা কবরই। তবে মাপ ঠিক নেই। নাকি আমি লম্বায় কম আর পাশে বেশি বলে এমন লাগছে! ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। তবে কষ্ট হলেও কবর ছাড়া এখন আর আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, থাকার কোনো ঠিকানা নেই। এখন থেকে কবরেই থাকতে হবে আমাকে। কিন্তু যেই আমি শুতে গেছি, পাশ থেকে কে যেন ব্যথায় ককিয়ে চিৎকার করে ওঠে- ‘আমার নাম হারিছ, আমি হারিছ না... সত্যি কইতাছি স্যার, আল্লার কিরে... আমার নাম হারিছ, আমি হারিছ না’। চিৎকার করতে করতে লোকটা পা দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে গুটিয়ে নেয়। মুহূর্তেই কেমন যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে একটা পুঁটলি মতন হয়ে এক পাশে কোনায় সরে যায়। আমিও তড়াক করে উঠে বসে গেছি। কবরে আগে থেকেই একজন শুয়ে আছে। মরা ছাড়া কবরে আসে কেমনে! আর এই ব্যাটা এসব কী বলে! নাম হারিছ, কিন্তু সে হারিছ না। নাম দিয়েই তো পরিচয়। নাম যা, সে তো তাই। যার যেই নাম, সেই তো সে। কথার আগা মাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ব্যাটার মাথা আউলাই গেছে, নাকি আমার মাথা! বুঝতে পারছি না। বেশিক্ষণ অন্ধকারে থাকলে মাথা আউলানো বড়ো কোনো ঘটনা না। সেটা পরেও বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে আগে লোকটার ভয় ভাঙাতে হবে এবং কথা বলতে হবে। বোঝাতে হবে আমিও কেউকেটা কেউ না, আমাকে স্যার-টার ডাকার কোনো কারণ নেই। ব্যাটায় যদি আমাকে কবরের ফেরেস্তা ভেবে বসে, সে ভুলও ভাঙানো দরকার। তার মতো আমিও এখন পরিচয় সংকটে আছি। আর কথা বলতে গেলেই যে পরিচয় লাগবে, এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়মও কেউ করেনি। সংসারে কখন কার কোন পরিচয় মুছে যায়, তার কোনো ঠিক-বেঠিক নেই। পাখিদের কে কাকে কী নামে ডাকে, অথবা রাতকে চাঁদ কী নামে ডাকে, আমরা জানি না। প্রণয়ে আপন হলে, পরিচয় মুছে গিয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে ডাকনাম। সে ডাকনাম যেকোনো শব্দই হতে পারে।
এখন এসব ভাবনাও আমার আউলা মাথারই পরিচয়। আমি কুঁকড়ে থাকা লোকটার গায়ে হাত রাখি। ‘হাত দিয়েন না স্যার, সিলাই খুইলা যাইবো। আমার বুক খুইলা যাইবো, মাথার খুলিডাও খুইলা যাইতে পারে স্যার। তাড়াহুড়ায় সিলাইডাও ভালো মতন কইরা দেয় নাই, স্যার’ -লোকটা আমাকে চমকে দিয়ে আবারও চিৎকার করে ওঠে। ‘আমার নামডাও এখন আর আমার নাই স্যার, শইলডাও যদি খুইলা যায় তাইলে আমারে আর কেউ চিনবার পারবো না, স্যার’ লোকটা এবার এসব বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমার মুখে অনেকক্ষণ আর কোনো কথা উজায় না। তাকিয়ে দেখি, আসলেই লোকটার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় অযত্নের বেশ কিছু সেলাই। শুনেছি সেলাইয়ের এখন অনেক আধুনিক পদ্ধতি আছে। সুই-সুতা দিয়ে এখন আর সেলাই করা লাগে না। আঠা না কী দিয়ে যেন শুধু পেস্টিং করে দেয় অথবা সেলাই দিলেও চামড়ার মতো কী এক সুতা দিয়ে দেয়। সেলাইয়ের জায়গা শুকালে সেই সুতাও চামড়ার সাথে মিলেমিশে যায়। কিন্তু না, এই লোককে সেই প্রাচীন পদ্ধতিতেই সেলাই দেয়া হয়েছে। বড়ো বড়ো করে কোনোমতে আটকে দেয়া সেলাই। দেখেই বুঝা যায়, একদম দায়সারা কাজ।
বুকের ভেতর প্রশ্নের ঝড় আটকে বসে থাকা আর নিজের দমের গলায় নিজে উঠে বসে থাকা, আমার কাছে সমান কষ্টের বলে মনে হতো। তবে সেটা অনেক অনেক বছর আগের কথা। আমি যেহেতু কবরে ঢুকে পড়েছি, তাই এসব মামুলি কষ্ট এখন আর আমাকে স্পর্শ করে না। এরপর আমরা দুজন কতক্ষণ চুপচাপ ছিলাম, আমাদের কেউ তা মনে করতে পারি না। আমরা বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে ছিলাম কি-না তাও মনে করতে পারি না। এসব এখানে প্রাসঙ্গিকও নয়। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। এখানে অপেক্ষা শব্দটাই জুতসই ধরে নেয়া যায়। আমরা দুজনই নীরবতা ভাঙার অপেক্ষায় ছিলাম। কথা বলার অপেক্ষায় ছিলাম। অন্ধকারের কালো রঙ ছাড়া কবরের আর নিজস্ব কোনো রঙ নেই, পরিবেশ বা আয়োজন নেই। তবু সে অন্ধকারে আমরা একজন আরেকজনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। লোকটার সেলাই করা জায়গা থেকে থকথকে তরল গড়িয়ে পড়ছিল। জায়গায় জায়গায় মাংস ফুলে উঠেছিল আর সারা শরীরে ছিল মোটা মোটা কালশিটে দাগ। ‘কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম ভালোবেসেছি’ -মান্না দে ও লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গানের মতো নীরবতা ভেঙে কে প্রথম কথা বলেছি, অনেক চেষ্টা করেও আমাদের কেউ তা মনে করতে পারি না। আমরা দুজনই দুজনের কাছে এসেছিলাম, কথা বলেছিলাম। লোকটার নাম যেহেতু হারিছ, সে হারিছ না হলেও আমি তাকে হারিছ বলেই সম্বোধন করি। আমাকে তার সম্বোধন করার প্রয়োজন হলেও সে আমার নাম জানতে চায়নি। সারাক্ষণ সে আমাকে স্যার বলেই ডেকেছে। দেখে হোক বা ভুলে হোক, বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক, আমাকে যেহেতু একটা সম্মানের জায়গা সে দিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে আমাকে নামাতে তার মন হয়তো সায় দেয়নি। এটা কোনো ব্যাপার না বলে আমিও এসব নিয়ে আর ঘাঁটাইনি।
দেশের কোনো এক উপজেলা সদরের একটা বেকারির কর্মচারী হারিছ। বেকারি থেকে বের হয় রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। বের হওয়ার সময় তার গায়ে লেগে থাকে বেকারির ময়দা মাখানোর গন্ধ, ইষ্টের গন্ধ অথবা বিস্কুটের গন্ধ। হাতে থাকে কিছু ভাঙাচোরা নতুন-পুরাতন বিস্কুট। এটাই তার রোজকার বেকারি থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার চিত্র। প্রতি রাতেই রাস্তার কিছ কুকুর তার গায়ের গন্ধে এসে জড়ো হয়। এদের খালি মুখে ফেরত দিতে মন চায় না বলে রাস্তার এক পাশে বসে কুকুরগুলোকে সে নতুন পুরাতন ভাঙা বিস্কুট খাওয়ায়। দশ মিনিটের বেশি সময় এখানে খরচ হয় না তার। খাওয়ানোর সময় হারিছ প্রতিদিন কুকুরগুলোর সাথে কথা বলে, ভালো-মন্দের খোঁজখবর নেয়, এদের সংখ্যা গোনে। কমতি থাকলে অন্যদের কাছে সে কুকুরটার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। উত্তরও বুঝে নেয় নিজের মতো করে। খাবার শেষে কুকুরগুলো স্কর্ট করতে করতে তাকে এগিয়ে দেয়।
সে রাত্রের চিত্রটাও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
স্বাভাবিকভাবে রাস্তায় অন্যান্য রাতের মতোই লোকজন ছিল না। হারিছ বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কুকুরগুলোও খাওয়া শেষে তার সঙ্গী হয়েছিল। বাড়ি আর বেকারির মাঝামঝি দূরত্বে রাস্তার আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। দূরের বাড়িগুলোকে জোনাকির মতো জ্বলতে দেখা যায় শুধু। চাঁদের মখু চেপে বসে আছে মেঘ অথবা চাঁদটা মেঘের ভিতরে নতুন বাড়ি বানায়। তবু আবছা আলোয়, রাস্তাটাকে অলসভাবে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। গাছগুলো নিজ নিজ জায়গায় অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়াতে হয় হারিছকেও। পেছন দিক থেকে একটা ভ্যান অনেকটা নিঃশব্দে অথবা যে শব্দে আসে তাতে হারিছের ধ্যানমগ্ন হাঁটা তাকে বেখেয়াল রাখে, ভ্যানটা হারিছের পথ আটকে দাঁড়ায়। একজন গাড়িতে থেকেই নাম জিজ্ঞেস করে। হতবিহ্বল হারিছের নিজের নাম বলতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হয়ে যায়। কিন্তু নাম শুনেই ভ্যানে থাকা বিশেষ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। বুটের শব্দে শুয়ে থাকা রাস্তার আলস্য ভাঙিয়ে হারিছকে বৃত্তাকারে ঘিরে ধরে এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে ওঠে- ‘ও তুই-ই হারিছ’। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্য একজন উচ্চ কণ্ঠে আদেশের সুরে বলে- ‘হ্যান্ডস আপ’। বিমূঢ় হারিছের মুখের কথা মুছে যায়, চিন্তা শ্লথ হয়ে আসে, বাকশক্তি রহিত হয়। কিন্তু তার হয়ে কথা বলে ওঠে তার সঙ্গের কুকুরগুলো। এরা সচকিত হয়, তাদের স্বরে চিৎকার করে, প্রতিবাদ জানায়। বিশেষ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সেসব আমলে নেয় না। তারা দাগি আসামির মতো, দণ্ডপ্রাপ্ত খুনির মতো, বিরাট কোনো নৃশংস বাহিনীর নেতার মতো হারিছকে ভ্যানে তুলে নেয়।
এরপর, পরপর আমাদের খুব পরিচিত ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। হারিছকে রিমান্ডে নেয়া হয়, জিজ্ঞাসাবাদ চলে।
─ হোয়াটস ইয়্যুর নেম?
─ আমি জানি না স্যার।
─ ওই ব্যাটা তোর নাম কী?
─ হারিছ।
─ হুম, এইবার লাইনে আইছো। তোর গডফাদার কে?
─ আমি কইতারি না স্যার।
─ শালা, তোর বাপ কে, বাপ?
─ আমার বাপ নাই স্যার, মইরা গেছে।
─ মইরা গেছে! নাকি মাইরা ফেলছোস? আচ্ছা, তোর বাহিনীর সদস্য কয়জন বল।
─ মোট আটটা স্যার। আইজ একটা কম আছিলো।
গুনে রাখা কুকুরগুলোর সংখ্যা বলে হারিছ। কিন্তু ইনভেস্টিগেটর আর ধৈর্য রাখতে পারেন না। হারিছ তার সাথে খেলা খেলছে, এটা তার জন্য চরম অপমানের। তিনি কথা আদায়ের প্রয়োজনীয় সব পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেন। যন্ত্রণাকাতর হারিছ কাতরাতে কাতরাতে বলতে থাকে- ‘আমার নাম হারিছ, আমি হারিছ না... সত্যি কইতাছি স্যার, আল্লার কিরে... আমার নাম হারিছ, আমি হারিছ না’। বারবার একই কথায় অফিসার আবারও বিরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি এবার প্রশ্ন করার পরিবর্তে, উত্তরের উপর হারিছের স্বীকারোক্তি আদায়ের ব্যাপারে মনোযোগ দেন। নিজের কথায় হারিছের সম্মতি নিতে শুরু করেন।
─ তোর নাম হারিছ?
─ হ স্যার, আমার নাম হারিছ।
─ সত্যি কথা বল হারিছ।
─ সত্যি কইতাছি স্যার।
─ তুই গ্যাংস্টার হারিছ।
─ হ স্যার, আমি গাঙপাড়ের হারিছ।
─ তার মানে তুই হারিছ।
─ হ স্যার, আমি হারিছ।
না... না স্যার... কথার মারপ্যাঁচে ‘হ’ বলার পর নেতিয়ে পড়া হারিছের অস্ফুট ‘না’ শব্দ আর কর্তব্যরত অফিসারের কানে প্রবেশ করে না। তারপর তিনি মাথা তুলতে অক্ষম হয়ে পড়া হারিছকে দিয়ে সব স্বীকার করিয়ে নেন। স্বীকার করিয়ে নেন ঘরের ভিতর মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা গোপন অস্ত্রের কথাও।
তারপর সশস্ত্র বাহিনী, তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বের হয়। পথের মধ্যে হারিছ বাহিনীর সদস্যরা হারিছকে ছিনিয়ে নিতে আক্রমণ শুরু করে। গোলাগুলি হয়। দুপক্ষের গোলাগুলিতে মারা যায় হারিছ। পোস্টমর্টেম হয়। ডোম অবজ্ঞা নিয়ে সেলাই করে হারিছের মরদেহ। সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয় হারিছের লাশ।
হারিছের এই ঘটনায় প্রেস ব্রিফিং হয়। নৈমিত্তিক ঘটনার মতো অথবা চলতি বাঁধাধরা কথার মতোই উপরের কথাগুলো তুলে ধরা হয়। তবে অন্যান্য প্রেস ব্রিফিংয়ের সাথে এই প্রেস ব্রিফিংয়ে উত্থাপিত তথ্য অথবা বর্ণিত ঘটনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো অবকাশ থাকে না। যা যা ঘটে, ঠিক তাই তাই বলা হয়।
প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে, প্রেস ব্রিফিংয়ের তথ্যানুসারে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সে সংবাদের সাথে, কিছু কিছু পত্রিকা হারিছের মায়ের প্রতিক্রিয়া ছাপে। সেখান থেকে হারিছের মায়ের একটি কথা নিয়ে কদিন খুব মাতামাতি হয়- ‘রাশটোও যুদি এমুন কইরা মানুষ মারে গো বাজান, আমার পোলার লগে তার তো কুনু তফাত ফাই না।’
হারিছের মায়ের এই কথাটি দিয়েই এই গল্পের সমাপ্তি টানা যেত, তবে মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় আমাদের পরিচয় সংকট। সে সংকট মীমাংসার খাতিরে গল্পটা আরও এগিয়ে যাওয়ার দাবি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
নিশ্চুপ দুপুরে শান্ত দিঘির জলের উপর হেলে থাকা আম, জাম অথবা কড়ই গাছের ডালে ধ্যানে বসা সাদা বক অথবা মাছরাঙার মতো ধ্যানী হয় সশস্ত্র বাহিনী। তারা হারিছ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, তারা এলাকার মানষুকে নিশ্চিন্ত করতে চায়, তারা পৃথিবীতে শান্তি নামাতে চায়। তারা নামতা গুনে গুনে হারিছ বাহিনীকে আটক করে, গ্রেফতার করে। কথিত নৈমিত্তিক ঘটনার জন্ম দিয়ে পৃথিবীতে শান্তির ধারাপাত রচনা করতে শুরু করে। কিন্তু একদিন হঠাৎ তাদের কলম কেঁপে ওঠে, বন্দুকের নল কেঁপে ওঠে, ট্রিগার ধরে থাকা আঙুল কেঁপে ওঠে। হয়তো কেঁপে ওঠে বুকের ভেতরটাও, সেটা তাদের চেহারা দেখে ঠিক ঠাওর করা যায় না।
আটককতৃ হারিছ বাহিনীর এক সদস্য স্বীকারোক্তিমলূক জবানবন্দি দেয়। ওইদিন রাতের আক্রমণটা তাদের ভুল ছিল বলে স্বীকার করে সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদেরকে কাঠহীন এক কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পায়- মেঘের জামা গায়ে ঘুমিয়ে যাওয়া চাঁদের আবছা জোছনা মেখে হেঁটে যায় এক নিরীহ সাধারণ বেকারির শ্রমিক। আর তাকে স্কর্ট করে এগিয়ে নিয়ে যায় তার কৃতজ্ঞ কুকুর বাহিনী। তার গায়ে লেগে থাকে আটা-ময়দার গন্ধ, ইষ্টের গন্ধ। তার গায়ে লেগে থাকে নতুন-পুরাতন বিস্কুটের গন্ধ। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা শুনতে পায়, একজন বারবার বলে যায়- ‘আমার নাম হারিছ, আমি হারিছ না... আমার নাম হারিছ, আমি হারিছ না।’
রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরী ‘মরিয়া প্রমাণ করেছিল, সে মরে নাই’। আর আমার পাশে কবরে শুয়ে থাকা হারিছ মরিয়া প্রমাণ করে- ‘তার নাম হারিছ, সে হারিছ না’।
হারিছের বলা কথাগুলো যখন ইথারে ভেসে ভেসে পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে থাকে, তখন আবার সেই বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী কাঠগড়া থেকে নেমে রাতের গোপন আঁধারে আরও এক হারিছকে তাদের মতো করে দণ্ডিত করে। এবার আর কোনো প্রেস ব্রিফিং হয় না। কোনো দৈনিক আর হারিছের মায়ের প্রতিক্রিয়া ছাপে না। তারা আরও একবার লেখার সুযোগ পায় না- ‘রাশটোও যুদি এমুন কইরা মানুষ মারে গো বাজান, আমার পোলার লগে তার তো কুনু তফাত ফাই না।’
এতক্ষণ যে আলোতে হারিছকে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার চোখ থেকে সে আলোটুকুও মুছে যায়। আমি কবরের মধ্যে শুয়ে পড়তে পড়তে নামে মাত্র হারিছকে অথবা নিরীহ সাধারণ বেকারির কর্মচারী হারিছকে, কুকুর বাহিনীর হারিছকে, যার মা নেই, বাবা নেই, যার কেউ নেই, তাকে অথবা হারিছ বাহিনীর প্রধান হারিছকে বলি- ‘প্লিজ! তোমার কবরে আমাকে একটু থাকার জায়গা দাও। আমার নাম বিচার, ট্রিগার ধরা আঙুলে আমি আর থাকতে পারি না’।
অবশ্য, কবরটা মাপে ঠিক ছিল না।