পোস্টস

গল্প

মরিয়ম

১১ জুন ২০২৪

অর্কিড

ঘরের চালে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, সময়টা ২০০৪, ২৮ ডিসেম্বর। এই ঘন কুয়াশচ্ছন্ন রাতে বাঘও কাপে। নাই, ঘরে বিদ্যুৎ না আছে দোয়াতে কেরোসিন ওদিকে মরিয়মের পেটে উঠেছে তীব্র ব্যথা। 

“কিয়ের বাচ্চা অওয়েনের সময় অইছে? আঙ্গর কি বাচ্চা-কাচ্চা হয়নাই নাহি? ভাব ধরছে, বিয়ানির টাইম ওইলে একলাই বাচ্চা বাইর ওবো, অত ভাব দেহাইও না।”

মরিয়মের শাশুরি পান সুপারি ছেচে আর বলে। শর্তার শব্দ যেনো মরিয়ম কে আরো পাগল করে দিচ্ছে। আজকে আট দিন হলো পেটে ব্যথা উঠেছে, কেউ দাইকেও খবর দেয়না, ডাক্তারও আনেনা। মরিয়ম গরীব ঘরের মেয়ে, বাবা অনেক আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন, সেই থেকে মরিয়ম তার খালার কাছে বড় হয়েছে, মায়ে কাজ করত বাসাবাড়িতে আর মরিয়মের স্কুলে পড়ার খরচ দিতো কিন্তু কি দুর্ভাগা কপাল মেয়েটার, তার আপন খালাও তাকে খাবার দিতো না ঠিকমতো, বই পুড়ে ভাত তরকারি রান্না করতো। খালার ছেলের বউ বানেছা বেগম রান্না করত, মরিয়মের সামনেই ভাত তরকারি বেড়ে টিনের টাঙ এ তালা মেরে রেখে দিতো। এইভাবে পড়ালেখায় ভালো থাকা সত্ত্বেও মেয়েটার পড়া আর হলো না। এমন এক সময় ফরিদ মিঞা, মুয়াজ্জিন বাড়ির সেজো ছেলে মরিয়মের সাথে টাঙ্কি মারতে চায়, গায়ের রং শ্যামলা হলেও মরিয়মের চুল ছিল যেমন ঘন তেমন লম্বা, মাটি ছুঁই ছুঁই, মরিয়মের ভাই শামছু বলে, “তোর চুল হইলো গিয়া দেও চুল, পুকুরে নামিশ না, দেও টাইনা ধরবো।” 

শামছু পূর্ণিমার রাতে, দোয়াতের আলো ছাড়া ওই দূরে গ্রামের প্রান্তে সুপারি গাছের শিকড়ের মাটি এনে তেলের সাথে মিশিয়ে মরিয়মের মাথায় দিয়েছিল, সেই থেকে মরিয়মের চুল আর কমে না, বাড়তেই থাকে, শামছু আবার বোনের চুলের যত্ন নিতো,সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতো চুল গুলো  তারে কাপড়ের মতো শুকা দিয়ে, বেণী করতো। 

যাইহোক, ফরিদ মিঞা মরিয়মের চুলের প্রতিই আকৃষ্ট হয়ে তার পিছন পিছন ঘুরতো, মূলত ফরিদ মিঞার মরিয়মকে বিয়ে করার কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না, খেয়ে ছেড়ে দিতো এই আর কি তার আশা, কিন্তু শামছু ছিল চালাক ঘুঘু, কেউ তার বোনকে ব্যবহার করে ছেড়ে দিবে তা হয় না। শামছু গ্রামের লোকজন আর মুরুব্বীদের হাতে পায়ে ধরে মরিয়মকে বিয়ে দেয় ফরিদের কাছে। কিন্তু ফরিদের মা, বড় ভাই বোনরা কেউই মরিয়ম কে মানেনা, বাড়ি উঠতে দেয়না, ফরিদের নাই কোন ব্যবসা বাণিজ্য, নিজেই খায় ভাইয়ের ঘাড়ে, বউ পালবে কি দিয়ে? 

তারা থাকতে শুরু করলো গাছের তলে, ঘর নাই, চাল নাই চুলা নাই, ফরিদ গিয়ে মায়ের কাছে খেয়ে আসে বউয়ের খোজ রাখেনা। এইভাবে এক মাস চললো। মরিয়ম আর পারেনা, গেলো গ্রামের মুরুব্বী কারী সাহেবের কাছে। 

“আমি আর পারছি না, দাদা, আমাকে বাঁচান।” 

“ফরিদের ভাইরে ডাক দে,” হুকুম পড়ার সাথে সাথে ফরিদের ভাই ফারুক আর দেরি করতে পারেনাই। এইযে শালিশ বসল, মরিয়ম সব ঘটনা খুলে বলল, ফারুক এমন চেহারা করল যেনো সে নবজাতক বাচ্চা, এসবের কিছু তার জানাই ছিল না, চোখে পানি কুলায় না। মরিয়মের কান্না বাদ গেলো, সবাই লাগলো ফারুককে চুপ করাতে। কারী সাহেব ব্যাপার টা বুঝতে পেরে গর্জে উঠলো। 

“গরীব ঘরের মেয়ে বলে, তুমরা এইভাবে কষ্ট দিতাছো? আল্লারে ভয় করে না তুমগোর?” 

ফারুকের নাটক দেখে কে, এদিকে কাজের লোক সাড়া পাড়া খুঁজে ফরিদকে পায়ে এক কেরোমবোর্ডের দোকানে আড্ডা দিতে। ধরে নিয়ে আয় শালারে। 

উপস্থিত সবাই। কথা নাই বার্তা নাই, ফারুক কারী সাহেবের লাঠি নিয়ে ইচ্ছারকম পিটানি দিলো ফরিদকে, অঙ্গাচাঙ্গা করে বারি দিতেই থাকলো, বারির দামুর দমুর শব্দ সাড়া এলাকা কাঁপিয়ে ফেলেছে, আর লোকজন জড়ো হচ্ছিল, মরিয়মের কি আর সহ্য হয়? ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ফরিদের সামনে, ফরিদও কাপুরুষের মতো মরিয়মের আঁচলের পিছে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে, ওদিকে মরিয়মের শরীরে কি আর ফারুক আঘাত করতে পারে? থামলো। 

“আজ, এই মুহূর্ত থেকে মরিয়ম তোমাদের বাসায় স্বমর্যাদায় বউ হিসেবে থাকবে, আমার যেনো, আর দ্বিতীয়বার এই বিষয় নিয়ে শালিশ বসাইতে না হয়, ফারুক।” 

“হ্যাঁ, বুঝেছি।” বলেই ফারুক মরিয়মের মুখের দিকে না তাকিয়ে বলল, “চলো, ফরিদ কে নিয়ে আসো আমার সাথে।” 

এই যে শুরু হলো আরেক জ্বালা। ঘোঁয়াল ঘরে এক কোণে থাকতে হয়, সারাদিন খাটনি করেও রাতেও শান্তি নাই। মুয়াজ্জিন বাড়ির বউ, করো সামনে যেতে পারবে না, রাতের বেলায় শীত নাই, গরম নাই, প্রত্যেকদিন রাতের বেলায় চাঁদদিঘী থেকে এক নয় দুই নয়, দশ বালতি পানি আনায়, ঘরের ডুযা লেপায়, কাপড় কাচায়, বাড়ির সবার পড়ে যদি ভাত থাকে তাহলে খায় নাহলে, যে খাবারে বিড়াল শুকেছে সেই খাবার খেতে হয়। দিন যায় বছরের মতো, ফরিদ বুঝে না সংসার, সারাদিন টোই টোই করে ঘুরে, অমুক বাড়ির মেয়ে উঠে আসে বাড়িতে, একেক দিন একেক মেয়ে, তো মরিয়মকে দেখে তারা চলে যায়। সেটা আবার ফরিদের মা, বোন আর ভাবি ওর কানে দেয়, ফরিদ গিয়ে মরিয়মকে ইচ্ছামত মারে যেনো সে মানুষ না পুতুল। 

এত কষ্ট করার পর, আজ আঠাশ ডিসেম্বর সে বাচ্চা প্রসব করতে যাচ্ছে, তাও কত কথা। ঘটনা শুনে, মরিয়মের মা আসে দূর টাঙ্গাইল থেকে। এসে দাই আনলো, সিরিয়াস অবস্থা, মেয়েটা মরেই কিনা, ষোলো বছর বয়স মাত্র, তেমন শক্তি নাই তার। মুখটা ব্যথায় কালো হয়ে গেছে। দাই বলল, “ও ফরিদের মাও, ডাক্তার খবর দেও, নয়লে তো আমও যাবে, কলাও যাবে।” 

ফরিদের মা যা বলল তা দাই নিজেও ভাবে নাই। “আহ্ মরণ! আমর পোলাড় টেহা গাবাইছে নাহি? অঙ্গোর তো বিয়াইতে ডাক্তার নাগে নাই।”

ব্যাস! মরিয়মের মা আর দেরি করলো না, ভ্যানে করে ডাক্তার নিয়ে আসলো। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিলো আর, একমিনিট, “ওয়া, ওয়া” করতে লাগলো এক ধবধবে ফর্সা মেয়ে। মরিয়মের হুশ নাই। ফরিদ গিয়ে মেয়ের কানে আযান দিলো। ফরিদের খালা পায়ে সমস্যা, হাঁটতে পারে না, নাম দিলো জান্নাত। 

প্রথম সন্তান মেয়ে হয়ছে বলে কতো কথাই যে শুনতে হলো, “বাল দিয়ে বাল বিয়াছে মাগি” 

~~~