মা শব্দটি উচ্চারিত হলেই পৃথিবীর যাবতীয় সুখ তৎক্ষণাৎ এসে ধরা দেয়। —এই একটি মাত্র শব্দ দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। প্রতিটি সন্তান চায় মাকে কাছে পেতে সবসময়ের জন্য যাতে অমোঘ সত্যকে তুড়ি দিয়ে সর্বতভাবে স্বর্গের কথা ভুলে গিয়ে মায়ের কোলে নতুন করে স্বপ্ন আঁকা যায়। শুনেছি, স্বর্গের চেয়েও নাকি মায়ের কোল সর্বোৎকৃষ্ট! —এজন্যই মায়ের কোন বিকল্প হয় না।
আর সবচেয়ে দুঃখী কে জানেন? —ওই হতভাগিনী মা। সন্তান জন্মানোর পূর্ব মুহূর্ত থেকেই দুঃখ ভোগ কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের মতো তাঁর উজ্জল আভা ছড়িয়ে দিয়ে ঠিক যেন বটবৃক্ষ হয়ে নিতান্তই ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন অবিরত। একটু একটু করে বড় করা —এই যে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্তনদুগ্ধ পান করিয়ে আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছেন, যাতে করে কয়েকটা যুগ অনায়াসে পেরিয়ে যাওয়া যায়। তাই আমার মাকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করতে আমার সাহস হয় না। যিনি স্বর্গেরও উর্ধ্বে তাকে হিমালয়ের মত তুচ্ছ পর্বত দিয়ে অনুভব করে মা শব্দটির অপমান করতে চাই না।
সবচেয়ে আশ্চর্যকর তথ্য কি জানেন? —মা শব্দটি মুক্তাক্ষর। মা উচ্চারণ করতে গিয়ে শ্বাসাঘাত হয় না। একজন বোবা সন্তানও এত আবেগ দিয়ে মা শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেন দেখে আপনি চমৎকৃত হবেন। মাঝে মাঝে গৃহপালিত পশুগুলোর গলার আওয়াজ শুনে মনে হয়, ওই বোবা পশুটিও যেন নির্দ্বিধায় মা শব্দটি বলতে পারছে। বিশ্বাস না হলে ট্রাই করে দেখতে পারেন।
আমার সাহিত্য সাধনার প্রথম লেখাটি ছিল মাকে নিয়ে। মাকে নিয়ে তাবড় তাবড় গ্রন্থ পড়ে শেষ করা যায় কিন্তু মাকে বিশ্লেষণ করা যায় না। মনের চৌহদ্দিতে যতসব অগোছালো ভাবনা তাড়না করে ফেরে —সেসব ভাবনাকে বুক পকেট থেকে বের করে আনে মায়ের স্নেহ। কিন্তু জীবন যেখানে স্তব্ধ সেখানে সব ভালোবাসার পরিণতি একই হয়ে থাকে। চলমান জীবনও কখনো কখনো থমকে দাঁড়ায় মানুষের দরবারে। আমি সেই জীবন দেখেছি, নিভৃতে যতসব নিষ্ঠুরতা ওত্ পেতে আছে ভবিষ্যৎকে বিগড়ে দেবে বলে। সেতুহীন খাদ পাড়ি দিতে বিরহীর কয়েকটি প্রজন্ম কেটে যায় অপেক্ষার আস্তরণে। অভিমান করে কেউ কেউ জমে রাখে চোখে সমুদ্রস্রোত —তাই বলে তো সমুদ্র শুকিয়ে যায় না, সমুদ্রের কাছে আবদার করে লাভ নেই জেনে বারবার তার অপরূপ নিষ্ঠুরতা সহ্য করেও বেঁচে থাকার মন্ত্র জপি। দুঃখ তখন হয়ে যায় ঐশ্বর্য্যমন্ডিত। দূরে থাকা ভালো, হৃদ্যতা বাড়ে।
মাকে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। সৃষ্টির প্রথম অভিযানে তিনিই একমাত্র সঙ্গী ছিলেন। চারদিকের সমস্ত নাদধ্বনির মধ্যে একমাত্র কান্না ছিল আমার সঙ্গী। সময় পেরিয়ে গেছে নদীর স্রোতের মতো ধীরে ধীরে স্তনপান শেষে কর্মঠ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছি। পৃথিবীর মানচিত্রের এপার থেকে ওপার অল্প অল্প জানা হয়ে গেছে ভূগোলের প্রকৃতিপুরুষ কাহিনীর সারাংশ খুঁজতে গিয়ে। এগিয়ে গিয়ে দেখেছি, বুনো ঘাসের মতো আমার জীবন জড়িয়ে আছে মাটির সাথে। যত দূরে যাই সৃষ্টির মহানন্দে তত কাছে আসি, মনে হয় যেন, মা ধীরে ধীরে কোলে তুলে নেন অবুঝ শিশু। সকালের সূর্য বন্দনা শেষে যিনি মুখে তুলে দেন অমৃতসুধা —সেই মায়ের চোখে চেয়ে কতবার দেখেছি আমার একান্ত নিজস্ব একটা পৃথিবী যেখানে দ্বিতীয় কোনো প্রভুত্ব নেই, ভালোবাসার অমোঘ স্রোতে ভেসে গেছে —সে জগৎ!
যারা আকাশ দেখলেই হাজার নক্ষত্রের ভিড়ে খুঁজে নেন একটি নিজস্ব নক্ষত্র। যাতে মাথা তুলে তাকিয়ে থেকে অনুভব করেন হাজার দিনের শৈশব স্মৃতি! —সেসব স্মৃতির ফাঁকে লুকিয়ে থাকে হৃদয়ানুভূতির স্পন্দন জাগানো মায়ের ঝলকানি। যাদের মা নেই, তাদের এক বুক আকাশ আছে যেখানে বলাকারূপী শৈশবস্মৃতি জোর দিয়ে উড়ে আসতে চায় টেলিপ্যাথি ভেদ করে কিন্তু কোথায় যেন থমকে যায়?—ক্ষণিকের নক্ষত্র থেকে থেকে যারা হাজার দিনের নক্ষত্র হয়ে যায় তাদের দিকে ফিরে তাকানোর অভ্যাস কারো থাকে না কিন্তু একমাত্র সে অভ্যাস সন্তানের থেকে যায়। তাইতো আকাশ এত বিশাল হৃদয় নিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ অতিক্রম করে হাজার হাজার দিনের গ্রাস করে।
দেয়ালের ওই কর্নারে বাক্সবন্দি হৃদয় নিয়ে যে ছবিটি ঝুলে থাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকি —তাকিয়ে তাকিয়ে বলি একটা আধার পেরিয়ে এলাম। মাঝে মাঝে শ্রীরামপ্রসাদের ওই গানটি কেন জানি মনে পড়ে “মা হওয়া কি মুখের কথা/ (কেবল প্রসব ক'রে হয় না মাতা)/যদি না বুঝে সন্তানের ব্যথা/দশমাস দশদিন, যাতনা পেয়েছেন মাতা/এখন ক্ষুধার বেলা সুধালে না, এল পুত্র গেল কোথা” কিংবা “মাতা বর্তমানে, এ দুঃখ সন্তানে/মা বেঁচে তার কি ফল বলনা” কেন মনে পড়ে? —এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়ে পরক্ষণেই আরেকটি গান মনে পড়ে যায় “কুপুত্র অনেক হয় মা/ কু-মাতা নয় কখনও তো ” ধীরে ধীরে কোথায় যেন সব প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয়। আমাদের সব অভিযোগ প্রাণযোগে পরিণত হয়ে নতুন নতুন সৃষ্টিকল্পের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আবার প্রনয়ের পৃষ্ঠা মেলে ধরে। মা মা বলে ডেকে কোথায় যেন হারিয়ে যাই, হারিয়ে যেতে যেতে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকি যেখানে আমি এবং মা নিভৃত যতনে শ্বাস নিই।
পৃথিবীর হাজার শব্দের ভিড়ে যখন একটি মাত্র শব্দ ‘মা’ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় তখন যাবতীয় শব্দকে তুচ্ছ মনে হয়। এলোপাথাড়ির দিকে চলে যেতে যেতে চোখ মেলে দেখি, মাকে নিয়ে একটি শব্দও লিখতে পারিনি। অনন্ত আকাশকে মেলে ধরা যায় কিন্তু সীমারেখা পরিমাপ করা যায় না। শুয়ে শুয়ে ভাবা যায় একটা ক্ষণিকা প্রকৃতিপুরুষ খেলার ছলে সৃষ্টির মহানুভবতা শুরু করেছিল, সেই থেকে আমি মহাকালের রথে মা শব্দটির সাথে পরিচিত। প্রকৃতির অপার লীলাময় জগতে আমি কোন তুচ্ছ কিছু নই, প্রকৃতির অংশজাত। মাঝে মধ্যে দূরে থেকেও বাতাসের কাছে গিয়ে মায়ের স্পর্শ লক্ষ্য করা যায়। টেলিপ্যাথির জগৎ ঘিরে মা এবং সন্তানের মধ্যে অতিমানসের মতো স্নেহ কাজ করে। হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সংযোগ। রক্তের সাথে রক্তের বহতা। সময়ের সাথে সাথে বিরাট দেহ নিয়ে মহাকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়।
মহাকাল যাকে নাড়ির সাথে যুক্ত করেছে তাকে নাড়ি ছেঁড়া ক্রন্দনের উপহাস দিয়ে বরণ করা যায় না। অদৃষ্টে কত কিছুই ঘটে যায় কিন্তু সন্তানের সঙ্গে মায়ের স্নেহভরা জীবন আজনম বহতা থেকে যায়। পৃথিবীর সব মায়ের কাছে সন্তানের আকুল আবেদন স্নেহমাখা শৈশবস্মৃতি! —যেটা সাথে থাকলে সারাটা জীবন অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়। হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে আমরা আবিষ্কার করেছি, মায়ের চেয়ে বড় কিছু নাই। তবুও কেউ কেউ এই হৃদয়ের কাছে প্রশ্ন রাখে নিভৃতে যতনে? —যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জলাকার পৃথিবীর টইটুম্বুর বালিশে মাথা রাখতে হয়। হৃদয়ের কথা কেউ জানে না, কেউ জানতেও চায় না, তাই অহর্নিশি ভেসে যায় —এই হৃদয়।
মাকে ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলা হয়নি কখনো হৃদয়ের মেঘ সরে আসতে আসতে সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। নির্মল বাতাসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কবে যে নিজেই আকাশ হয়েছি, জানিনা! —এখন সব নক্ষত্রেরা ডেকে ডেকে আমাকে ভীষণ ব্যস্ত করে দেয়। এখন আমি মাটির গান শুনি, মাটির পৃথিবী গড়ে তুলে প্রকৃতির ঘরে ঠাঁই নিই। যেসব গল্পের সমাধি হয় না সেসব গল্পের বাক্সবন্দী হৃদয় নিয়ে বসে আছি মহাসুখে।