Posts

নন ফিকশন

পাঠাগার আন্দোলন, সমস্যা ও সম্ভাবনা।

June 11, 2024

ওয়ালিউর রহমান

100
View

”জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।” এই উক্তিটি আমরা অনেকবার দেখেছি।এটির মাধ্যমে বইপাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।যারা সমাজকে নিয়ে ভাবেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে নিজে পাঠচর্চা করেন, পাশাপাশি  মানুষের জন্য পাঠাগার গড়ে তোলেন; সমাজে আলো ছড়িয়ে দিতে তাদের এই চেষ্টা চলছে দেশব্যপী।
এক একটি পাঠাগার যেন এক একটি আলোর মশাল।যে মশালের আলো দূর করছে সমাজে ছড়িয়ে থাকা অজ্ঞতার গাঢ় অন্ধকার; তৈরি করছে মানবিক বোধসম্পন্ন পরিশীলিত আলোকিত মানুষ।

বইপাঠে মানুষের চিন্তার জগতের প্রসার ঘটে,মনজগতে সৃষ্টি হয় পৃথিবীকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ।মানুষের অন্তরের সুপ্ত চেতনাকে জাগ্রত করে বই, তাড়িত করে ভিতর থেকে নতুন কিছু করার।একটি জাতি এগিয়ে যায় জ্ঞানী ব্যক্তিদের হাত ধরে,ফলে দেশ অর্জন করে সমৃদ্ধি। আমরা সকলেই অবগত কুরআনের প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দটি হল 'ইকরা'-'পাঠকর'।তাছাড়া জ্ঞান অর্জন সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা.) বর্ণনা করেন, “প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ” —ইবনে মাজাহ।

মূর্খতা আর অসহিষ্ণু মনোভাব  নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে থাকা একটি দেশ কখনো উন্নতির পানে অগ্রসর হতে পারে না।নিজেদের ভিতরকার দ্বন্দ্ব আর অজ্ঞতার আধাঁরে সে দেশ হারিয়ে যায়।তাই একটি দেশ বা জাতিকে  এমন ধ্বংস থেকে বাঁচাতে প্রয়োজন সমাজে  অসংখ্য চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করা;দরকার বইয়ের পাঠক তৈরি করা।একজন ব্যক্তি যখন বইপাঠে আকৃষ্ট হবে তখন সে অন্য দশজনের থেকে সমাজকে ভিন্ন চোখে দেখবে,বুঝতে পারবে সমাজের নানান ত্রুটি ও অসংগতি।আমার মানতে কষ্ট হয়,কিভাবে একজন মানুষ পৃথিবীতে জ্ঞানতৃষ্ণা না মিটিয়েই  এক জীবন কাটিয়ে  পৃথিবী ছাড়ার অপেক্ষায় থাকতে পারে!

আমাদের পর্বপুরুষদের মধ্যে এমন কিছু  মনিষী ছিলেন যারা এ জাতিকে দিয়ে গেছেন স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা,দেখিয়ে গেছেন আলোর পথ।অসংখ্য সফল কাহিনি  আর সংগ্রামের ইতিহাস রেখে গেছেন বইয়ের পাতায় পাতায়;কিন্তু আফসোস আমরা সেগুলো পড়ি না! জানার চেষ্টাও করি না।

বইপাঠের এত এত ভাল দিক রয়েছে যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না;কিন্তু এত এত ভাল দিক থাকা স্বত্বেও বই নিয়ে কাজ হয় খুব কমই।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, পড়ালেখা বলতে কেবল স্কুল-কলেজ আর ইউনিভার্সিটির বইপড়া;এর বাইরে পড়ালেখা নেই। শিক্ষিতশ্রেণীও অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরে পড়াশোনা তেমন করতে চান না।উপলব্ধির চক্ষুকে সবসময় চেতনায় রাখতে বইপড়া জরুরি, কিন্তু এ কাজটি আমরা এড়িয়ে যাই  নানান ব্যস্ততার অজুহাতে।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়শীল একটি দেশ,অভাব যেখানে নিত্যসঙ্গী,সেখানে বইপড়া অনেকের কাছে বিলাসিতা। যারা নিজ উদ্যোগে  বই কিনে পড়েন, বন্ধুমহল ও পরিবার থেকে  তাদেরও নানান কথা শুনতে হয়।নিকট স্বজনেরা তো প্রায়ই বলে যে,এত বই পড়ে কি হবে?আমার উত্তর হয় খুবই সাবলীল নিজের মনের আনন্দ আর চিন্তার স্বাধীনতা পেতে আমি বই পড়ি।শুধু তাই নয় নিজেকে চিনতে আর সমাজকে সুন্দর করতে বই  একজন মানুষকে পথনির্দেশা দেয়।বই মানুষের সবচে ভালো বন্ধু।

পাঠাগার আন্দোলন  সফল করা বা পাঠকদের বই পড়ানোটা এখন বেশ চ্যালেঞ্জিং, অনেক আশা নিয়ে অনেকে  পাঠাগার কার্যক্রম শুধু করেন, কিন্তু পরে হতাশ হয়ে সেই আশা আর স্বপ্নের মধ্যে নিজেই ঝিমিয়ে পড়েন; একমাত্র কারণ পাঠক রেসপন্স না পাওয়া।আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে  হয় টাকা দিয়ে হলেও পাঠককে বই পড়াই;কারণ একবার বই পড়ার নেশায় ধরলে পাঠক নিজেই বইয়ের কাছে ফিরে আসবে।মানসম্মত বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারলে পাঠক তৈরির চেষ্টা সফল হবে।

বইপ্রেমী হিসেবে বেশকিছু পাঠাগার ভ্রমনের সুযোগ হয়েছে আমার। নতুন নতুন পাঠাগারে ভ্রমণ আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা । নতুন কিছু শেখা ও জানা-ই আমার উদ্দেশ্য।পাঠাগার ভ্রমণে 
সবশেষে বেশি যে সমস্যাটি নজরে এসেছে,তা হলো- পাঠকের অভাব।পাঠক হলো পাঠাগারের 'প্রাণ'; পাঠক না থাকলে পাঠাগার অচল। অনেক সচেতন তরুণ বই পাঠের গুরুত্ব অনুধাবন করে সীমাহীন পরিশ্রমে  নিজ এলাকায় পাঠাগার গড়ে তোলেন; কিন্তু পাঠকের অভাবে সেই পাঠাগার নিরব অস্তিত্বে কোনোরকম বেঁচে থাকে।
পেটের ক্ষুধার মতো মস্তিষ্কেরও যে ক্ষুধা রয়েছে, তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।
অভাবের তাড়নায় আমরা মস্তিষ্কের যে ক্ষুধা সে ক্ষুধাকে উপেক্ষা করছি না—তো!

চট্রগ্রামের বাঁশখালিতে খোঁজ পেয়েছিলাম নান্দনিক পরিপাটি এক পাঠাগারের।সাপ্তাহিক অফিস ছুটির দিনে সেই পাঠাগারে যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা,সেখানে পৌঁছে আনন্দে মন নেচে ওঠেছিল;গ্রামীণ আবহে এমন স্মার্ট পাঠাগার সমগ্র বাংলাদেশে হয়তো এখন পর্যন্ত দ্বিতীয়টি গড়ে ওঠেনি।কিন্তু কষ্ট আর বেদনা জেগেছিল একটা বিষয়ে, এত সুন্দর একটি পাঠাগারে যেতে  আগন্তুক হিসেবে যখন পথ জানতে সেখানকার  তরুণ বৃদ্ধ যাকেই জিজ্ঞেস করেছি কেউ সঠিকভাবে পাঠাগার সম্পর্কে বলতে পারেননি।এখানে প্রয়োজন ব্যপক প্রচারের।

একবার গিয়েছিলাম নোয়াখালীর বসুরহারে বিশাল এক পাঠাগার,প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাদের অর্থের অভাব নেই; আছে নানামুখী পরিকল্পনা,কিন্ত পাঠক নেই।টেবিলে জমে আছে ধূলোকণা অর্থাৎ পাঠকের অনুপস্থিতি এখানেও। 
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় 'পাঠশালা রাঙ্গুনিয়া' গিয়ে  মন শীতল হয়েছিল সেখানে পাঠশালা কেন্দিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখে। পাঠক বাড়াতে তাদের কার্যক্রম অতুলনীয়। বাশঁখালীর অন্য আরেকটি পাঠাগার "উপকূলীয় পাঠাগার "তারাও পাঠাগারের মূল উদ্দেশ্যকে বাস্তবনের জন্য নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
নতুন পাঠাগারের উদ্যোক্তাদের কাছে আমার অনুরোধ সফল পাঠাগারগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করুন;তাহলে আপনার পাঠাগারটিও সমাজে আলো ছড়াতে সহায়তা করবে।

এত এত নিরাশার মাঝেও আমাদের সামনে আশার অনেক দিক আছে। শহরে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে একের পর এক গণপাঠাগার গড়ে উঠছে 
তরুণদের হাত ধরে।নিজ ইচ্ছে ও অর্থায়নে সচেতন বইপ্রেমী তরুণেরা এসব পাঠাগার গড়ে তুলছে;কারণ তারা অনুধাবন করতে পেরেছে যে সমাজ ও রাষ্টে সকল সমস্যার মূল হল _অজ্ঞতা তাই মানুষেকে আগে শিখতে হবে;হবে জানতে।
তরুণদের স্বপ্ন আলোকিত মানুষে ভরে উঠুক সমাজ, দেশ,রাষ্ট্র;কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যপক কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা নিয়োগ করতে হবে।কারণ,বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মানুষ বই পড়তে চায় না; মোবাইলে আসক্তি মানুষের সিংহভাগ সময় দখলে নিয়েছে।তাই,যে এলাকায় পাঠাগার সে এলাকায় পাঠাগার নিয়ে ব্যপক প্রচার চালানো দরকার,দরকার সামাজিক কর্মকান্ডে পাঠাগারকে যুক্ত করা।তাছাড়া, পাঠাগারে ভালো লেখকের বই, মনোরম পরিবেশ,সুবিধাজনক যায়গায় সেটির অবস্থান খুবই জরুরি।বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে পাঠাগারকে সম্পৃক্ত করা,স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের পাঠাগারে আহবান করা গেলে পাঠাগারে প্রাণ ফিরবে বলে আমার বিশ্বাস।

একজন পাগলকে মানসিক হাসপাতালে না পাঠিয়ে তাকে সুন্দর পোষাক পরিয়ে ছেড়ে দিলে লাভ হবে না; সে সেই পোষাক খুলে ফেলবে ;কারণ তার বোধশক্তি কাজ করে না। তাই সমাজের সবশ্রেণীর মানুষকে বইপাঠে উৎসাহিত করতে হবে।"জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান", তাই যে ব্যক্তি যত শিক্ষিত সেই ব্যক্তি তত মার্জিত।মানুষ মূলত স্বভাবে আদিম;কিন্তু যে সেই আদিমতাকে শিক্ষা ও জ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে জীবনকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে পারে সেই প্রকৃত মানুষ। 


পরিশেষে,জাতিকে এগিয়ে নিতে এবং সুন্দর মানবিক ও উন্নত বিশ্ব পেতে এমন সভ্য সুশৃঙ্খল ও মার্জিত মনের মানুষ গড়ে তুলতে পাঠাগারের ভূমিকা  অনস্বীকার্য।

Comments

    Please login to post comment. Login