প্রকৃতি হতে প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদটি হয়তো বৃষ্টি।এটি যে কিভাবে আমাদের স্মৃতি, আবেগ, আর ভালোবাসার সাথে জড়িয়ে আছে, সেটি বলা দায়!
চারদিন হলো টানা বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় বর্ষায় যত জল জমে না, তার চেয়ে ঢেড় বেশি জমেছে। যাচ্ছে-তাই অবস্থা!!
আমি অর্ণব। সেন্ট্রাল বোস কলোনি, ৩১ নম্বর স্ট্রিটে থাকি।এই বছর দুই হলো এখানে শিফট পোস্টিং। আমার বিল্ডিংটি ৫ তলার।আমি থাকছি ৩ নম্বরে।পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন এক বয়স্ক দম্পতি। ভালো মন্দ সব মিলে এখানে তারাই আমার সব।
কর্পোরেটেড জব, ছুটির দিনেও একরাশ কাজ আর গাদি গাদি ফাইল পত্তর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। বুঝতে পারি, ❝পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর, সে তিলে তিলে মারবে❞।
কিন্তু সব ছাপিয়ে কানে এসে থোমকে দাঁড়ায় একটি শব্দ,
''বৃষ্টির''।
আজ রবিবার, সরকারি ছুটি হলেও, একগাল হাসি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম অফিসের দিকে। হাসিই নাকি হাজারো ঘায়ের প্রলেপ, তাই হাসি।প্রচুর হাসি।মাঝে মাঝে ভয় হয়, অপ্রস্তুত স্থানে আবার না হেসে ফেলি।গভীর চিন্তার বিষয় বটে!
আরে, শুভ্র যে। মেট্রোরেলের কামরায় দেখা হয়ে গেল ওর সাথে।শুভ্র আমার ওয়ার্কমেট।অবশ্যি কলেজটাও একসাথেই পার করেছি।
কি ভাই,!অল গুড তো?— শুভ্র জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ রে ভাই, একেবারে ফার্স্টক্লাস।
তা বলছি মাসিমা শুনেছিলাম অসুস্থ, এখন কেমন আছেন রে?— আমার দিক থেকে প্রশ্ন হলো।
তুই তো জানিসই মা বেশিরভাগই অসুস্থ থাকেন।তবে এখন আগের থেকে বেশ ভালোই বলা যায়।
দুদিন বাদে তো তুই প্রমোশন পাচ্ছিস, এখন এতো গোমড়া মুখ করে বসে আছিস যে?— শুভ্রর প্রশ্নে ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো।
বলাই, হয়নি দেখেছিস। তুই তো জানিস ভাই, এতো কাজেত চাপ, তার উপর দায়িত্বের আবদারে কাঁধ কুঁজো হওয়ার উপক্রম।
চাপ বলে যে সে চাপ! পুরো হাঁড় ভাঙা জব।এর থেকে ঠেলাগাড়ি দিলেও শান্তি পেতাম!
শুভ্রও খেপে আছে, বেশ বুঝলাম।
নিজের আনমনেই ওকে বলতে লাগলাম;—
ভাই, দেখতে দেখতে ২০ বছর পেরিয়ে গেল।এখন আর জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাই না রে।
শুভ্র হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই চুপ থেকে আমাকে বলতে দিয়েছিল।
আমি বলতে লাগলাম,,
ভাই মনে পড়ে, ছোট্ট বেলার কথা, এক জোড়া নতুন জুতো কিনতে পারবো বলে, পুরনো জোড়া ছিড়ে ফেলতাম। আর এখন দেখ, ভাবি আর কয়েকদিন চলে গেলেই হলো।
কোন চুপিসারে দায়িত্ব এসে জীবনের দরজায় কড়া নেড়েছিল, তা বুঝে ওঠার আগেই, জড়িয়ে পড়েছি তার মায়াবী আবদারে।
শুভ্র কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।অবশেষে চাপা আর্তচিৎকার শোনা গেল তারও কন্ঠে।
ছেলেদের জীবনটা এমন কেন বলতো, ভাই.!?
জীবন সবার একই, শুধু সাজানোর সামগ্রী ভিন্ন ভিন্ন।আমরা হয়তো এভাবেই সুন্দর, ❝জীবনে হাসির পর্দা টেনে, বহুদূর ছুটে চলা❞।
ভাই মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আমার পরে মা অনুর কি হবে! নিজেকে খুব আগলে রাখি তাদের জন্য।
প্রমোশন টা পেলে তাদের জন্য কিছু করতে পারবো।
কতোদিন হলো বাড়ি যাইনি, তাদের দেখি না।—
আমার কথাগুলো একটি দীর্ঘশ্বাসে মিলিয়ে গেল।
এই ঘটনার ১ হপ্তা পেরিয়ে গেছে।সবাই হয়তো তেমনিই আছে।
এক বৃষ্টি ভেজা সকালে শুভ্রকে তার বারান্দায় খবরের কাগজ হাতে দেখা গেল।চোখ দুটো খুব বড় বড় করে খোলা, চশমা ফ্লোরে ছিটকে পড়ে কাঁচ এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মুখে একরাশ প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি।
০১/০৬/২০১৮, দৈনিক সমাচার, ৩১ নম্বর স্ট্রিটের ২০ মিনিট আগে, সড়ক দূর্ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু।
আইকার্ড হতে নাম জানা গিয়েছে ''অর্ণব অধিকারী''।
কিছু প্রশ্নের হয়তো উত্তর হয়না।হয়না কিছু মানুষের সাথে দেখা, নিয়তির নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রে।সে বিলীন হয়ে যায় একরাশ মিথ্যের আশায়, মৃত্যুর অবকাশে।