পোস্টস

ফিকশন

বলা হলো না

১১ জুন ২০২৪

মাহমুদুল হাসান

মূল লেখক মাহমুদুল হাসান


(লিখাটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, কারো সাথে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেলে আমি দায়ী নই)

হাসপাতালের বেডে শুয়ে যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি, তখন অনেককেই দেখতে মন চাচ্ছে। টের পাচ্ছি আমার পাশে কেউ আছে, কিন্তু তাকে দেখার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দেখতে পারছি না। প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি চোখের পর্দা সরাবার। অসহ্য, বিরক্ত, কষ্ট সবই অনুভূত হচ্ছে।  চোখের পাতি খোলতে চাইলেই কে যেন টেনে ধরে রাখে। মনে হচ্ছে চোখের উপর বৃহদাকার অতি ওজনি এক পাথর রাখা।পৃথিবীটাকে নিষ্ঠুর লাগছে।পাশের বেডের রোগীটা হয়তো মরে গেছে। বেঁচে থাকলে তার গোংরানির শব্দ শুনতে পেতাম। হয়তো তার লাশটাও মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরকারি হাসপাতালে নিয়মের জুরি নেই। একটা মৃত মানুষকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতেও অনেক ঝামেলা। আমিও ভাবছি একটু পর আমাকেও হয়তো ঐ মর্গেই নিয়ে যাবে। এসব নিয়ে কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট হলো আমি আমার আপন কাউকে দেখতে পারছি না। মনের ভেতর অসীম কথার ডায়েরি লিখা থাকলেও মুখ ফোটে একটি অক্ষরও উচ্চারণ করতে পারছি না। গলায় এসে আটকে যাচ্ছে।  এমন অনেক কথা আছে যেগুলো অবশ্যই তাকে বলা দরকার।  কিন্তু কিভাবে বলব? আমার কথা তো আর কেউ শুনতে পায় না। ব্যাথিত মনে আশা পোষণ করলাম সে যদি আসত! আমার পাশে বসলে আমার কথা না শুনলেও কিছুটা হয়তো আন্দাজ করতে পারত।আর আন্দাজ করতে পারবে কি না সেটা নিয়েও আমি দ্বিধায় আছি, একপক্ষীয় ভালোবাসার জোরে এত বড় কাজটা হবে কি?
সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এমন সময় বুঝতে পারলাম একটা রানিং স্ট্রেচারে করে কাউকে উত্তর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  বুঝতে পারলাম আরেকটা মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাচ্ছে।  আমার কোনো কিছু মনে নেই এমন চিন্তা মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক তা মেনে নিচ্ছে না। শরীর দূর্বল হলে এমনটাই হয়, নিজের উপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।স্নায়ুতন্ত্রগুলো আমার মস্তিষ্কে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে তোর কথা বলার দরকার,  কাউকে কাছে ডেকে নে। আমিও জোরপূর্বক চেষ্টা চালাচ্ছি স্নায়ুর বিরুদ্ধে কাজ করার, এম্বুলেন্সের সাইরেন শুনে মনে মনে বাজাচ্ছি।আর স্মৃতির ফিতাটাকে ঘুরানোর চেষ্টা করছি। 
তবুও রাতভর ফোনালাপ, খোশগল্পে যান্ত্রিক ছবির মাধ্যমে আদান প্রদানকৃত সাময়িক দুপক্ষীয় সোনালী ভালবাসা গুলো যেন এখন আমার শত্রু হয়ে দাড়িয়েছে। মৃত্যূ যন্ত্রণা ভূলাতে কি মস্তিষ্ক এসব শুরু করেছে??দুপক্ষীয় ভালবাসাটা সাময়িক না হলে কেমন হতে পারত এটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করে দেখা যাক।এটা নিয়ে মাথায় এখন কিছু আসছে না।একটা ধরে নিই, হয়তো সে আজ আমার কাছে থাকতো আর আমার মনস্কথা বুঝতে পারত। কিন্তু এখনতো বুঝার কথা, আমার দিক থেকে ভালবাসা তো কমেনি!!

সরকারি হাসপাতাল হলেও আমার বেডের পাশে টবে রাখা একটা গোলাপ গাছ আছে। হয়তো রোগীদের মন চাঙা করার জন্য এমন ব্যবস্থা।গাছটা আমি দেখি নি, অনুভব করতে পেরেছি।  দুদিন যাবৎ গোলাপ ফুলের তীব্র গন্ধ নাকে লাগছে।  তাই অনুমান করে নিয়েছি।আজ থেকে গন্ধ আসছে না। হয়তো ফুলটা ঝরে গেছে। আবার এমনটাও মনে হচ্ছে এখানে কোনো গোলাপ গাছ নেই। হয়তো কেউ ফুল এনে আমার বেডের পাশে রেখেছিল।এমন হলে কাজটা কে করবে? রুনু? কোনো পুরুষ এ কাজ করবে না।আর নারীদের মধ্যে কে করতে পারে তাও বলতে পারছি না। তবে অধিক সময় ধরে প্রকট গন্ধ থাকায় অসহ্য লাগছিল। আজ কিছুটা সস্তি লাগছে।  নিশ্বাসের সাথে হাসপাতালের উদ্ভট প্রকৃতি থেকেও কিছুটা অক্সিজেন যাচ্ছে। তবে গোলাপ রহস্য ধোয়াশার মধ্যেই রয়ে গেল।

আমার শারিরীক অবস্থার অবনতি হওয়ার আমাকে নিবিড় পরিচর্যা কক্ষে পাঠানো হবে। যেতে মন চাচ্ছে না। আবারও তানি এসে উঁকি দেওয়া শুরু করলো মনের আনাচে কানাচে। তাকে দেখার ইচ্ছেটাও প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠলো। আমিও চারপাশ থেকে অনুভূতি পাওয়ার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছি।শরীরের কয়েক জায়গায় সুই ফোটানো হচ্ছে,  টের পাচ্ছি কিন্তু কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। নিশ্বাস নেওয়ার শক্তিটাও হারিয়ে ফেললাম। ভেন্টিলেটর লাগানো হলো আমাকে জোরপূর্বক নিশ্বাস নেওয়ার জন্য। মনের মধ্যে জমে থাকা না বলা অজস্র কথা ভেতরে ছুটোছুটি করছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো কথা বলতে চেয়েও বলতে না পারা। পাশে মিট মিট করে শব্দ হচ্ছে। হয়তো মনিটরের হার্টবিটের গ্রাফটি এখনো উঠা নানা করছে।গোলাপের অসহ্য গন্ধটার কথা মনে পরছে। হঠাৎ করে মন চাচ্ছে ঐ গন্ধটা,আবার নাকে লাগুক।  আফসোস হচ্ছে, যন্ত্রণাও হচ্ছে। মরে গেলেই তো হয়। এতসবের দরকার কি? মানুষ পৃথিবী থেকে যেতে চায় না, কাউকে যেতে দেয় ও না। তবে এসব করে লাভ নেই। মরতে তো হবেই।
এমন সময় কিছু একটার গন্ধ নাকে লাগল। অনেক কষ্টে বুঝতে পারলাম এটা ঐ গোলাপের গন্ধ।  আর কিছু ই বুঝতে পারলাম না। মাথায় কেমন জানি একটা শব্দ হলো। ইহজগতিক সব ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেললাম। একটু পর দেহটা মর্গেই নেওয়া হবে। 
লাশটার পাশে বসে একজন আর্তনাদ করছে।  সে এই হাসপাতালেরই ডাক্তার। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিথর হয়ে মেঝেতে বসে পরল সে। নির্লিপ্ত ভাবে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লাশটার দিকে।সেও কিছু বলতে চায় কিন্তু শোনার মানুষটি আর দুনিয়ায় নেই। আগের মতোই মুখে হাত বুলিয়ে আদর  করতে মন চাচ্ছে তার। তারও মনে পরছে জেগে থাকা রাতগুলোর কথা। সাময়িক দুপক্ষীয় ভালবাসার কথাগুলোও মনে পরছে তার। তবে তারা কেউ জানত না তাদের ভালবাসাটা সাময়িক ছিল না। এক অপ্রতিরোধ্য অভিমানের দেয়ালে দুজন দুদিক হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে লালন করে রেখেছিল তাদের ভালবাসা। কি নিষ্ঠুর অভিমান! একে অপরকে বুঝতে দেয়নি কিছু৷ দুদিকে একই চিন্তাধারা,  ভালবাসাটা একপক্ষীয়! 
ভালবাসার নামে লাগানো গোলাপ গাছটার প্রকট গন্ধযুক্ত ফুলটি নিয়ে ঐ মরদেহটার পাশেই পরে রইল সে।পড়ন্ত বিকেলে কারোরই বলা হলো না কিছুই।