পোস্টস

গল্প

তাশরিফ ও একাকী একটি রাত

১১ জুন ২০২৪

আসিফ রিফাত

মোবাইলের রিংটোনের শব্দে তাশরিফের ধ্যানমগ্নতা কেটে গেলো। মোবাইল রেখে দেখে, রাত ২ টা বেজে গেছে। কল দিয়েছিলো জারিফ।জারিফ ও তাশরীফ গভীর রাতের বন্ধু।ওরা সাধারণত গভীর রাত হলেই বাইরে বেরিয়ে পড়ে। আমাবস্যা কি পূর্ণিমা,ঝড়-বৃষ্টি যাই থাকুক ওরা বের হবেই।আজ এই সেপ্টেম্বরের তীব্র ভ্যাপসা গরমে দুজন বেরিয়ে পড়লো, উদ্দেশ্য সামনের আনারুলের দোকান থেকে সিগারেট কিনে ভাগাড়ের সামনের প্রকান্ড ফুলগাছের নিচে বসা।ওরা ওখানেই বসে রাতে আড্ডা দেয়।

 

ইদানীং ওদের আড্ডার  নতুন সঙ্গী যুক্ত হলো। ভূত এফএমের নানান গল্প শুনে ওদের মাথায় ঢুকেছে যেকোনো মূল্যে হোক, ভূত দেখবে। তবে পরী হলে আরও ভালো। সেই চিন্তা থেকে, ওরা গত ১০-১৫ দিন গ্রামের মসজিদের সামনে বসে থাকা থেকে শুরু করে, সকল  ঝোপঝাড়,বাগান,সামান্য জঙ্গলে পরিবেশ বা গোরস্থান সবকিছুই ঘুরে বেড়াচ্ছে। গতকাল ২ জন শশ্মানেও গেছিলো, কিন্তু সেখানেও কোনো কিছুর দেখা পায়নি।

 

যদিও ভূত দেখতে না পেয়ে ওরা খুব যে হতাশ তা কিন্তু বলা যাবেনা, ওর বুক যে ধুড়পুড় করে সেটা বুঝতে পারা যায়। রাতে যখন জারিফ চলে যায় এবং তাশরিফ বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করে, পথের মধ্যে একটা গোরস্থান পড়ে। গোরস্থানের কাছাকাছি এসে তাশরিফ ওর মোবাইলে গান চালিয়ে দেয় যাতে সম্পুর্ন মনোযোগ গানের দিকে থাকে। এবং ও সোজা হেটে চলে, পাছে এই ভয় থেকে যায় কোনদিন রাতে গোরস্তানে খারাপ কিছু দেখবে। কিন্ত মনের এই ভয় ভুলেও জারিফের কাছে বলেনা,পাছে জারিফ ওকে ভীতু মনে করে।

 

আজ ফুলগাছের নিচে যেয়ে দেখে প্রকান্ড ফুলগাছের নিচে একটুও বসার জায়গা নেই। পুরোটা জায়গা ভেজা আর কাঁচা মাছের গন্ধ।তার মানে সেলিমেরা আজ রাতে মাছ ধরেছে। দুজন বেশ বিরক্ত হয়েই চলে এলো। উদ্দেশ্য নদীর কূলের রাস্তায় বসা। তার সাথেই একটা বাগান আছে, যার দক্ষিণ পাশে কয়েকটা প্রাচীন ভেঙে পড়া কবরে চাদের সামান্য আলো এসে পড়ছে। তাকিয়ে দেখলে মড়ার হাড্ডি দেখা যায়, যেগুলো এখন শেয়াল কুকুরের নিত্যদিনের সঙ্গী। ওরাও এখন হাড্ডিগুলোতে অবহেলায় কামড় দেয়। একটু সামনে তাকাতেই চোখে পড়ে নতুন ২টা কবর।দেখে মনে হচ্ছে সদ্য দাফন কাজ সম্পন্ন করে গেছে। দু'জন বেশ অবাক হলো। একই গ্রামে বসবাস, কিন্তু দুই-দুইজন মানুষের মৃত্যুর খবর ওরা জানতেই পারলোনা। অবশ্য ওদের এই ভবঘুরে জীবনে স্বাভাবিকতার প্রবেশ ঘটে সামান্যই। তখন জারিফ তাশরিফ কে ডেকে বলে দেখছো দুইটা নতুন কবর, মনে হচ্ছে আজই মারা গেছে।

 

আজ আকাশে হাল্কা মেঘ। মাঝে মাঝে মেঘের ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে নদীর পানিতে পড়ছে। ওরা যেখানে বসেছে রাস্তার এক ধারে নদী অন্য ধারে গোরস্থান। ওরা অবশ্য এটাকে অপদার রাস্তা বলে। দুজনে বসে নানানরকম গল্প করছে। হঠাৎ তারা খেয়াল করলো, দূর থেকে কেউ একজন হেটে আসছে। দেখে দুজন রীতিমতো টাশকি খেলো! সাধারণত এত রাতে এদিকে আসবার মতো কেউ নেই। ওরা অন্তত এতদিনে কাউকে পায়নি। আগন্তুককে দেখে দুজন রাস্তার ধারে একটা বড় গাছের আড়ালে যেয়ে বসলো, এই ভয়ে যদি দেখে ফেলে পরেরদিন সকালে ওদের বাবার কাছে নালিশ যাবে। গাছের আড়ালে চুপচাপ বসে আছে আর সময় গুনছে কখন লোকটা ওদেরকে অতিক্রম করে সামনের দিকে চলে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে! সামনের দিকে আছে খেয়াঘাট, আরেকপাশে আছে নদী, যেখানে ওরা বসে আছে। অপর পাশে গোরস্থান, আর যে পথটা আছে সেদিক থেকেই লোকটা এসেছে।

 

এই হিসাব করতেই ওদের চিন্তায় ছেদ পড়লো। ওরা হাল্কা ঘামতেও শুরু করলো। তাহলে লোকটা যাবে কোথায়! ওদের ধারণাই সত্যি হলো!লোকটা গোরস্থানে ঢুকছে। ওদের চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, ভেবে কোনো কুল কিনারা করতে পারছেনা, আর যাইহোক এত রাতে কেউ কবর যিয়ারত করতে আসবেনা। যদি আসেও, একা আসার কথা না। ওরা সামনে তাকিয়ে দেখছে মানে লোকটার কর্মকান্ডের দিকে গভীর নজর রাখছে।

 

তাশরিফ খেয়াল করলো, নতুন দুইটা কবরের মাঝামাঝি লোকটা বসে হাত দিয়ে কিছু একটা করছে। তাশরিফ হাত দিয়ে জারিফকে ইশারায় ডাকার চেষ্টা করলো, কিন্তু কয়েকবার হাত দিয়েও জারিফকে না পেয়ে অগত্যা পাশে তাকিয়ে দেখে, ওর পাশে একজন অবিকল ওরই মতো দেখতে যার চেহারা শাদা হয়ে আছে, কিন্তু মুখ দিয়ে তাজা রক্ত ঝরছে। তাশরিফ চিৎকার করে উঠতে যাবে, তখনই ওর ঘুম ভেঙে গেলো এবং নিজেকে আবিষ্কার করলো ভেজা স্যাতসেতে ছাদে।