ঢাকার গরম বিকেলে, যানজটের চক্রব্যূহে ফেঁসে থাকা রিজওয়ানের মাথায় ঘুরছে অস্তিত্বের নানা প্রশ্ন। মেট্রোপলিসের নিঃশব্দ কলরবে সে হাঁটছে এক কাপ কফির সন্ধানে। পথে পথে নানা বিজ্ঞাপনের ঝলমলে আলো আর আছে ইঁদুর দৌড়, সব কিছুই যেন তাকে আরও বেশি নিঃসঙ্গ করে তুলছে।
একটা ক্যাফের সামনে এসে থামলেন রিজওয়ান। ভেতরে ঢুকে একটা টেবিলে বসলেন। চারপাশে আধুনিক আর্কিটেকচার আর আভিজাত্যের ছোঁয়া, কিন্তু তার মনে কিছুতেই প্রশান্তি আসছে না। অর্ডার করলেন ব্ল্যাক কফি, যেন সেই তেতো স্বাদে জীবনকে একটু স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন।
রিজওয়ানের বয়স ৩০ পেরিয়েছে। ভালো চাকরি, ভালো বাসা, সবই আছে। কিন্তু এক ধরনের শূন্যতা তাকে ভেতর থেকে গিলে খাচ্ছে। প্রতিদিনের এই যান্ত্রিক জীবন, সফলতার দৌড়ে পেছনে পড়ে যাওয়ার ভয়, সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে সে । নীটশের দর্শনের মতো, যেন ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে তার জীবনে, আর এখন তিনি নিজেই নিজের পথ খুঁজছেন, নিজের সত্য খুঁজছেন।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তার দৃষ্টি আটকালো পাশের টেবিলে বসা এক মেয়ের দিকে। মেয়েটির চোখে একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা। রিজওয়ানের মনে হলো, এই চোখে তাকালে নিজের শূন্যতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। মেয়েটি একা বসে বই পড়ছে, বইটির নাম "দ্য স্ট্রেঞ্জার" - আলবার্ট কাম্যুর উপন্যাস।
মেয়েটির নাম তানিয়া। রিজওয়ান কৌতূহলী হয়ে উঠে গিয়ে অনুমতি নিয়ে তানিয়ার টেবিলে বসলেন। কথায় কথায় জানলেন, তানিয়া একজন শিল্পী, জীবন ও শিল্পের মধ্যে অদ্ভুত এক ভারসাম্য খুঁজছেন। রিজওয়ান তার নিজের গল্প শোনালেন, তাদের জীবনের অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়ে দুজনেই বিস্মিত হলেন।
তানিয়া বললেন, “কাম্যুর 'দ্য স্ট্রেঞ্জার' পড়ে মনে হয়, আমরা সবাই একেকজন 'মারসো'। সমাজের নিয়ম, আবেগ আর মূল্যবোধের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে আমরা অনেক সময় নিজেদের হারিয়ে ফেলি।”
রিজওয়ান একটু থেমে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু আমরা কি সত্যিই সেই নিয়ম মেনে চলতে পারি?”
তানিয়া হেসে বললেন, “মারসোর মতো আমরাও কখনও কখনও আমাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পাই না। কিন্তু সেই অর্থহীনতার মধ্যেই হয়তো জীবনের রূপ ও রস লুকিয়ে আছে।”
কফির কাপ শেষ হতে হতে রিজওয়ান আর তানিয়ার মধ্যে একটা ভালো ফ্রেন্ডশীপ গড়ে উঠলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, নিয়মিত একে অপরের সাথে সময় কাটাবেন, নিজেদের অস্তিত্বের সংকটগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন।
সময়ের সাথে সাথে, রিজওয়ান ও তানিয়ার সম্পর্ক আরও গভীর হতে লাগলো। তারা একসাথে নানা জায়গায় ঘুরতে যেতেন, কখনও রেস্টুরেন্টে বসে বিকাল কাটাতেন, কখনও কোনো ব্যস্ত পার্কে বসে কথা বলতো। তাদের প্রতিটি কথোপকথনে জীবনের নানা প্রশ্ন উঠে আসতো। তানিয়া তার আঁকা ছবিগুলো দেখাতো, যেখানে মানুষের অস্তিত্বের সংকট আর জীবনের অর্থ খোঁজার প্রতিফলন দেখা যেতো। রিজওয়ান তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা আর পড়াশোনার কথা বলতো।
একদিন সন্ধ্যায় তারা নীলক্ষেতে এক বইয়ের দোকানে গেলেন। রিজওয়ান একটি বই তুলে নিলেন—কাফকার "দ্য ট্রায়াল"। তানিয়া হাসি দিয়ে বললেন, “কাফকা, আমাদের আধুনিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমরা যেন তার গল্পের যোসেফ কে’র মতো, এক অদৃশ্য আদালতে বিচারাধীন।”
রিজওয়ান বললেন, “ঠিক তাই। এই অব্যক্ত অনিশ্চয়তা, জীবনের অর্থহীনতার মধ্যেই আমরা নিজের পথ খুঁজে চলেছি। কিন্তু তানিয়া, তুমি কি কখনো মনে করো, আমরা কি সত্যিই কোনো অর্থ খুঁজে পাবো?”
তানিয়া গভীর চোখে তাকিয়ে বললেন, “হয়তো পাবো, হয়তো পাবো না। কিন্তু এই খোঁজার মধ্যেই তো জীবনের আসল সৌন্দর্য।”
তাদের সম্পর্কের গভীরতা দিন দিন বাড়ছিল। তারা একে অপরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু রিজওয়ানের মনে একটা প্রশ্ন ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিল—এই সম্পর্কের শেষ কোথায়? একদিন বিকেলে, তারা ধানমন্ডি লেকে বসে এই প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
রিজওয়ান বললেন, “তানিয়া, আমাদের এই সম্পর্কের শেষ কোথায়? আমরা কি শুধু একে অপরের মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজছি, নাকি এই অর্থহীনতার মধ্যে কিছু স্থায়ী খুঁজে পাবো?”
তানিয়া মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “আমাদের সম্পর্কের কোনো শেষ নেই রিজওয়ান। এটা এক ধোঁয়ার মতো, যা আকাশে মিলিয়ে যায়, কিন্তু তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। আমরা একে অপরের সাথে থাকবো, যতদিন না আমরা নিজেদের জীবনের অর্থ খুঁজে পাই।”
কিছু মাস পরে, তানিয়া একদিন রিজওয়ানকে জানালো সে বিদেশে একটা এক্সিবিশনে অংশ নিতে যাচ্ছে। রিজওয়ান প্রথমে চমকে গেল, কিন্তু তারপর বুঝতে পারলো, এই দূরত্ব তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। তারা প্রতিজ্ঞা করলো, দূরত্বের মাঝেও তারা নিজেদের অস্তিত্বের সংকটগুলো নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
বিদেশে যাওয়ার আগের দিন, তারা শেষবারের মতো দেখা করলো। রিজওয়ান তার হাত ধরে বললেন, “তানিয়া, এই সময়গুলো আমাদের জীবনের অংশ হয়ে থাকবে। তুমি যেখানেই থাকো, আমি জানি আমরা একে অপরের মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবো।”
তানিয়ার বিদেশে যাওয়ার পর, রিজওয়ান নিজেকে আরও গভীরভাবে কাজে নিমজ্জিত করলেন। সে তার চাকরিতে আরও বেশি মনোযোগ দিলেন, তানিয়ার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো।
একদিন, রিজওয়ান অফিসে নতুন এক সহকর্মীর সাথে পরিচিত হলেন। মেয়েটির নাম মায়া। মায়া একজন উদ্যমী, মেধাবী এবং হাসিখুশি মেয়ে। প্রথমে রিজওয়ান তেমন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মায়ার সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। তাদের মধ্যে একটা সুন্দর কেমিস্ট্রি তৈরি হলো।
মায়া জীবনের প্রতি খুবই অপ্টিমিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তার হাসি, তার কথাবার্তা, সবকিছুই রিজওয়ানের জীবনে এক নতুন রঙ আনলো। তাদের একসাথে অফিসের কাজ, লাঞ্চ ব্রেক, এবং কখনও কখনও সন্ধ্যায় একসাথে সময় কাটানো, রিজওয়ানকে তানিয়ার অনুপস্থিতি ভুলিয়ে দিলো।
তানিয়া বিদেশে নিজের কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। তার প্রদর্শনী সফলতার সাথে শেষ হলো, কিন্তু তার জীবনে একটা শূন্যতা অনুভব করতে লাগলেন। রিজওয়ানের সাথে যোগাযোগ রাখা কমে গিয়েছিল, আর সে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছিলেন।
তানিয়া একদিন এক ফটোগ্রাফার, রাহাতের সাথে পরিচিত হলেন। রাহাত খুবই মেধাবী এবং সৃজনশীল মানুষ। তারা একসাথে অনেক প্রকল্পে কাজ করলেন, এবং তাদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠলো। রাহাতের সাথে তানিয়ার এক অদ্ভুত মিল ছিল—তারা দুজনেই জীবনের অর্থ খোঁজার যাত্রায় ছিলেন, আর তাদের এই যাত্রা তাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এলো।
রিজওয়ান ও তানিয়ার জীবনের এই পরিবর্তন তাদের মধ্যে একটা নতুন উপলব্ধি নিয়ে এলো। তারা বুঝতে পারলেন, জীবনের অর্থ খোঁজার যাত্রা কখনও থামে না। তাদের সম্পর্ক একসময় তাদের জন্য জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার মাধ্যম ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, তারা নতুন সঙ্গীর মধ্যে সেই অর্থ খুঁজে পেতে শুরু করলেন