পোস্টস

গল্প

এখানে খাসি বানানো হয়

১১ জুন ২০২৪

হাবীব কাইউম

সাব্বির সাহেবের হাতে আজ পুরোটা দিন। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ, পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছেন। শেষ সপ্তাহে আনতে যাওয়ার চিন্তা আছে। অভ্যাসবশত তিনি বাজারে এসেছেন—যদিও বাজার করার কোনো দরকার অথবা ইচ্ছা নেই। মাহমুদা যথেষ্ট পরিমাণ তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে। তাকে শুধু ভাত রান্না করতে হয়। হাতে যেহেতু অফুরন্ত সময়, সে জন্য বাজারে এসেছেন ঘুরতে। উপশহরের বাজার। চাকুরের জীবনে নয়টা-পাঁচটার ওফিশ সামলাতে গিয়ে খোলার দিনগুলোতে বাড়ি ফেরার সময় সবজি কিনে আনতে হয়। মাছ-মাংস কেনার জন্য শুক্রুবার নির্ধারিত থাকলেও সে দিনের ব্যস্ততা থাকে আরো বেশি। জামা-কাপড় ধোয়া, ঘর-দোর পরিষ্কার করা, জুমার নামাজ, কাছের আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, কখনো বা বাচ্চাদের জামা-কাপড় কেনা কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে বের হওয়া।
ভালো করে সেভাবে বাজারটা ঘুরে দেখাই হয় না। আজ তিনি বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে দেখার নিয়ত করে বের হয়েছেন। একেবারে শেষ মাথা থেকে তিনি শুরু করতে চান। শুরুতে মহসিন রেস্টুরেন্ট, এর সাথে সেলুন। সেলুনের পরের দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে কয়েকবার চোখ গেলো তার। ‘এখানে খাসি বানানো হয়।’ নিচে একটা মোবাইল নম্বর দেয়া। এই বাজারে তো খাসির আড়ৎ নেই। তাহলে খাসি বানানোর দোকান এখানে কেন? তিনি দোকানের সামনে এসে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলেন। পর্দা দিয়ে দোকানটা দু ভাগ করা। এক ভাগে রোগীর একটা খাট দেখা যাচ্ছে। অন্য পাশে তিনটা চেয়ার। ভেতরে কেউ নেই। তাকে উঁকি দিতে দেখে চায়ের টং দোকান থেকে কেউ একজন আওয়াজ দিয়ে উঠলো, ‘ভাইয়ের কী কাম আছে?’
তিনি চুপ করে রইলেন।
লোকটা চা রেখে অথবা লম্বা চুমুকে কাপের বাকি চাটুকু শেষ করে চলে এলো। তবে সিগারেটটা তার হাতে রয়ে গেছে। ‘কাম করাইতে আইছেন?’
‘কাম’ দিয়ে যে লোকটা কী বোঝাতে চাচ্ছে, সাব্বির সাহেব এখনো সেটা ঠাওর করতে পারলেন না। তিনি সরল স্বীকারোক্তি দিলেন, ‘আমি আশলে আপনার কথা অথবা আপনার এখানে কাজটা কী, সেটাই বুঝতে পারিনি।’
লোকটা বিরক্ত হলো, হয়তো অতটা নয়। বুঝিয়ে দিলো তাকে, ‘হ্যানে খাছি বানাই, বিচি ফালানের কাম করি। অহনে বুঝছেন?’ বলেই সে তার সিগারেটে টান লাগালো।
তিনি বুঝতে পেরেছেন। তার এখন চলে যাওয়া উচিত। লোকটাও হয়তো সেটা আশা করছে। কিন্তু তিনি নড়াচড়া না করে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করলেন, ‘এখানে তো ছাগল পালতে সে রকম কাউকে দেখি না।’ মনে মনে বললেন, জায়গাই বা কোথায় দু-চার কাঠার বাড়িতে? ছোট বেলায়, তার মনে পড়ে গেলো, গ্রামের বাড়িতে উন্নত জাতের একটা পাঠা ছিলো ময়নার মা’র। তার বাড়িতে ছাগীর মালিকেরা লাইন লাগাতো। প্রতি ছাগীর জন্য তিনি এক টাকা কি দুই টাকা নিতেন। আর খাসি বানানোর কাজটা হাজমরাই সারতো।
‘অহন ছাগলের থিকা মাইনছে বিচি ফালায় বেছি।’
তিনি গলা খাকারি দিলেন। বলে কী এই লোক? তাহলে দেশে এত ধর্ষণ করে কারা?
লোকটা তাকে সাহায্য করলো। বললো, ‘ভাইয়ে মনে কয় তাজ্জব হয়া গ্যালেন! হুনেন, আপনেরা ইউরুপ-আম্রিকারে দেইখ্যা পড়াল্যাখা কইরা ট্যাকা কামাইতে চান, পোলাপাইনের বয়ছ বাইড়া যায়। আবার ইসলামও মানতে চান। মাগার তাগোরে বিয়া করান না। ল্যাখাপড়া কইরা তাগো কাম কইরা খাইবার মন চায় না। তারা চাক্রি করবার চায়। আপনারা কন নিজের পায়ে খাড়া হওন। এই খাড়া হইতে হইতে বয়ছ যায় গা, আছল জিনিছ আর খাড়া হয় না। তাইলে আর এগুলা রাইখা কী কারবার? হের লাইগা পোলাপাইনে অহন খাছি হয়।’
‘কোনো সমস্যা হয় না?’
‘ছাগলের ছমছ্যা না হইলে মাইনছের হইবো ক্যা রে? পাছের ফার্মেসিতে মিলন ডাক্তার আছে। হ্যায় ছিলাই-ওছুধ যা লাগে দিয়া দেয়।’
সাব্বির সাহেব ‘ঠিক আছে ভাই সাহেব’ বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চাইলেন। লোকটা তখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার স্মৃতিপটে চলে এলো নিজের খৎনার দৃশ্য। তার চাচা তাকে ঠেসে ধরেছেন আর হাজাম গল্প করার ছলে কখন যেন ‘কাম’ সেরে ফেলেছে।
বাজার ঘোরার ইচ্ছাটা তার চলে গেলো। তিনি হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনলেন। অন্য শুক্রুবারের মতোই বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাতে হবে। পত্রিকার দাম মেটাতে মেটাতে একটা বড় খবরের দিকে তার নজর চলে গেলো। ‘বিশ্ববিদ্যালয় পাশ প্রতি তিনজনের একজন বেকার।’