চলে যাওয়া দিনগুলোকে যদি পারতাম বন্দি করে রাখতে, তাহলে হয়তো তাই করতাম। ফ্রেমে যেমন বন্দি করে রাখা যায় ছবি, ঠিক তেমন করে বেঁধে রাখতাম আমার হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলো। আজকাল পরিচিত সেই কন্ঠটা আমাকে বড্ড ডাকে, সেই ডাকার ধরণটাও আবার বড় অদ্ভুত রকমের। মাঝ রাত্তিরে ঘুমুতে যাই, দু’চোখ ছাপিয়ে ঘুমও আসে। মনে মনে ভাবি এই বুঝি জ্ঞানশূণ্য সাগরে ডুবে গেলাম, কিন্তু না, তা আর হয় না, চোখের পাতায় ঘোর অমবস্যার যে আঁধার- তাতে আচমকা ভেসে উঠে সুশি’র মুখটা।
সেদিন রাতে আমি ঘুমন্ত না জাগ্রত ছিলাম সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আর এক-পা বাড়ালে হয়তো দেখতে আর হতো না আমাকে। আমি বটতলার শ্মশান ঘাটের যাত্রী হয়ে যেতাম। নিঝুম রাতে ঘুম সাগরে হত”ছাড়ি সুশি এসে আমাকে খুব করে ডেকে হাত ধরে ছাদের উপরে নিয়ে এসে যে কান্ডটা ঘটালো তাতে লোক মুখের রহস্য কাহিনীর চরিত্র হয়ে গেলাম আমি।
অদৃশ্য ‘সুশি’ হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে ছাদের উপর দু’হাত তুলে ডেকে বললো- কান্ত ভালবাসা কত লম্বা হতে পারে তা জানো তুমি? আমার পুরোনো ধাচের সেই রসহীন উত্তর- জানবো কী করে? কখনো মাপিনি তো।
ঝাঝাঁলো কণ্ঠে সুশি বলে উঠলো- মাপনি বেশ করেছ; এবার ছাদের উপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়; যতদূরে গিয়ে পড়বে আমি বুঝে নেব ততখানি লম্বা তোমার ভালোবাসা।
কথা শুনে আমি ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলাম ভালবাসার দুরত্ব দেখাতে। সেদিন মরেই যেতাম; কিন্তু পেছন থেকে রন্তু এসে ধরে ফেললো আমায়, তাই বেঁচে গেলাম। দেখাতে পারলাম না আসলে কতখানি ভালবাসতাম সুশিকে।
আজ মাসের পাঁচ তারিখ। শৈবাল আর্ট গ্যালারিতে আমার ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে ; পুরো হলরুম জুড়ে মানুষের সমাগম। আমি গ্যালারির একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, রন্তু এসে বললো- কান্ত’দা একজন তোমার ছবি কিনতে এসেছে। আমি কিছু একটা ভাবছিলাম,একটু আনমনা ছিলাম তাই নিষেধ করতে ভুলে গেলাম যে, বলে দাও ছবি বিক্রি হবে না। নিচে থেকে পুনরায় ডাক আসবার আগেই নিচে গেলাম; যিনি নিতে এসেছেন তাকে তাড়িয়ে দেব এই ভেবেই।
‘জলরঙ্গে আকাঁ পেইন্টিংটার নাম “উদোম” যিনি কিনতে এসেছেন তাকে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। তার বয়স হয়তো বাইশ ছাড়িয়ে যায়নি। মনে হয় নতুন শাড়ি পড়া শিখেছে; আঁচল টানতে জানে না। চোখে চশমা নেই কিন্তু দেখে আন্দাজ করা গেল চোখে লসিক করা। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পরিচিত একটা সুগন্ধির আভাস পেলাম।
—তিনি বিস্ময় মাখা চোখে বললেন আপনিই কি ছবিটা এঁকেছেন?
—আমি বললাম হ্যাঁ। ‘তার চোখ আর ঠোট উল্টানো দেখে বোঝা গেল তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। বললেন -ভেবেছিলাম বয়স্ক গোছের লোক হবে কিন্তু এখন উল্টো দেখছি। যাই হোক কত দাম চাইছেন ?
—সতের হাজার-পাঁচশো-তের টাকা।
—আমি সতের হাজার টাকা দিচ্ছি;
—না ,হবে না, টাকা পুরোটাই দিতে হবে।
—কিছু কম রাখুন।
—আমি পারছিনা।
মেয়েটা কোন দীর্ঘশ্বাস ফেললো না। ব্যাগের ভেতর টাকা খুঁজলো। তারপর টাকাটা আমার সামনে মেলে ধরে বললো; এই নিন পুরোটাই আছে। গুনে দেখলাম আট টাকা বেশি আছে; ফেরত দিতে চাইলাম কিন্তু পকেটে ভাংতি নেই;
—রেখে দিন পড়ে নিয়ে নেব;
—পড়ে আমাকে পাবেন কোথায়?
—পেয়ে যাবো। “পৃথিবীটা খুব বড় নয়, চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়; বাকী থাকে শুধু মনের ইচ্ছেটা; ইচ্ছেটা যদি থাকে তো পুনরায় দেখা হয়”। আমি বললাম সহজ ভাবে বলুন; কাব্যিকতা পছন্দ করি না। মেয়েটা হাসলো অদ্ভুত দাঁতগুলো, খুব সাদা।
গ্যালারির বাইরে শত লোকের ভীড়ে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম কিন্তু বার বার মেয়েটির রেখে যাওয়া কথাটা মুছে দিতে পারলাম না মন থেকে “পৃথীবিটা খুব বড় নয় চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়; বাকী থাকে শুধু মনের ইচ্ছেটা; ইচ্ছেটা যদি থাকে তো পুনরায় দেখা হয়।”
এই কথাটা আমাকে কেউ একজন এর আগে বলেছিলো। কে বলেছিল? কেন বলেছিল, মনে করেও করতে পারছিনা।
দুই
ভরদুপুরে ক্যামেরা কাঁধে বাসায় ফিরছি। রাস্তাায় হন্যে হয়ে কিছুক্ষণ হেঁটেছিও। একটাও অটো কিংবা সি.এন.জি. কোনটাই পাইনি। সাউথ হিলসের কাছে আসতেই ফুলের দোকানটার পাশেই একটা সি.এন.জি পেয়ে গেলাম। কাছে ঘেষতেই ড্রাইভার বলে উঠলো- বাবু রিজার্ভ আছে যাওয়া যাবে না। আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম- ক’জন নিয়ে যাবেন; ড্রাইভার জানাল- মানুষ একজন, আর কিছু ফুল। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে তো যাওয়াই যায়।
এক তোড়া ফুল নিয়ে চোখে পড়ার মতন একটা মেয়ে সি.এন.জি তে উঠে বসলো। রোদের তাপে মাথা তখন আমার আই-টাই করছে। সাত-চৌদ্দ না ভেবে গিয়ে সরাসরি বললাম- যদি কিছু মনে না করেন, আমি কি; সি.এন.জি তে আপনার সাথে কিছুটা সময় যেতে পারি? এ রোদের দুপুরে সব খাঁ-খাঁ করছে বাড়ি যেতে হবে তারাতারি। মেয়েটি চোখ কঠিন করে বলল, না যেতে পারেন না; দেখছেন না আমি রিজার্ভ নিয়েছি।
‘মুখের উপর না বলাতে আমার একটু খারাপ লাগল’ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। সি.এন.জি স্ট্রাট নিয়ে চলে গেল। কিছু মেয়েরা যে বড্ড বাজে রকমের মেজাজী হয় সেটা জানা ছিলো না; আজ জানলাম। রোদমাখা পথে পা রাখলাম। সকাল থেকে মেঘালয়ের পাহাড় ধরে দু’টো প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছি।
পকেট থেকে দেশলাইটা হাতে নিলাম, সিগারেট বের করতে যাবো অমনি সি.এন.জি র আওয়াজ। আরেকটা সি.এন.জি এলো বোধহয়। “এই যে আসুন” পেছন তাকাতেই দেখি সেই মেয়ে। কী ভাগ্য আমার! সিগারেট পকেটে ফেলেই উঠে গেলাম।
—আমাকে না নিয়েই চলে গিয়েছিলেন আবার যে এলেন;
—একটু যেতেই মনে হলো এই দুপুরে আপনার কষ্ট হচ্ছে, তাই নিতে এলাম; তবে কথা বলা চলবে না কিন্তু।
আমি চুপচাপ বসে গেলাম। সি.এন.জি চলছে মাঝারী স্পিডে পাহাড়ী পথে। একটু সময় পার হতেই ড্রাইভারের কাছে দেশলাই চাইলাম। এইবার মেয়েটা মুখ খুললো -না জনাব এখন সিগারেট খাওয়া চলবে না।
কি আর করা; থাকলাম ভজু হয়ে। কিন্তু সিগারেট যে আমায় খেতেই হবে ও নেশা বড্ড বাজে। পাহাড় দেখতে দেখতে চোখ সবুজ হয়ে গেছে তবুও ভালোলাগা এখনো ফুরিয়ে যায়নি তাই একটানা তাকিয়ে ছিলাম সবুজ পাহাড় গুলোর দিকে। আধঘন্টা কেটে যেতেই আমি লজ্জাকে চুপসে যওয়া টিস্যুর মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে সিগারেট জালিয়ে নিলাম।
—আপনি তো বড্ড বাজে লোক, না বলা পরও কাজটা করলেন। আপনি নামুন তো। আমি হাসলাম; মেয়েটা ততক্ষনে রেগে গেছে, মুখটা ভবানির মতো লাগছে।
—এই দুপুরে নেমে গেলে আমি রোদে পোড়া নিগ্রো হয়ে যাবো। মেয়েটা ভ্র-কুচকালো তারপর বললো; হলে হবেন। দু’মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটার ভাব বদলালো। সিগারেট আধ খাওয়ায় হয়নি ততক্ষনে; আমি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এবার সব শান্ত হয়ে এল।
দু’পাশে পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই। দুরের মাঠে আজকাল রাখালও দেখা যায় না। গরু আপনা-আপনি চড়ছে। ছেলেরা ঘুড্ডি আর উড়ায় না। এ পথে কোম্পানি বসে গেছে, পাহাড়ের সাদামাটি কেটে তৈজসপত্র বানায়। আমি সাদামাটির পাহাড়ের দিকে খানিকাটা সময় তাকিয়ে ছিলাম; তাকিয়ে থাকা মনে মাঝে মাঝে কল্পনার এ্যনিমেশন শুরু হয়ে যায়। আনমনা থেকে সৎবিত ফিরে পেলাম যখন দেখলাম সি.এন.জি থেমে আছে। মেয়েটা বসে থেকে ঘেমে গিয়ে নেমে গেল, সাথে পা ফেললাম আমিও। গ্যাস নেবে বলেই থেমেছে সি.এন.জি। শাড়ির আঁচল ভাজ করতে করতে মেয়েটা বলল—রোদ আজ কড়কড়ে। আমি একটু এগিয়ে বললাম-তাই তো মনে হচ্ছে।
—রোদের ছেলে কে জানেন? কাব্যিক প্রশ্ন!! অমন রাগী মেয়ে আবার কবিতা জানে নাকি ?—মুখ ঝাঁকিয়ে বললাম জানি না তো।
—রোদের ছেলে হলো পড়ন্ত বিকেল, রোদ না হলে সবকিছুই বিষন্নতা এসে ভর করে। মানুষের জীবনে রোদ হলো তার জমানো ভালোবাসা।
—হুম বুঝলাম; আপনি কাব্যিক করে বলেন বলে ভালো লাগলো; নয়তো এগুলো হলো আতলামি। মেয়েটা এবার দাঁত কড়মর করে বললো তাই! তবে আপনি হলেন একটা ট্যা-ট্যা টাইপের লোক; এতগুলো কথার মাঝে বানিয়ে একটা মিথ্যেও বললেন আমার সাথে।
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে বুঝলেন যে একটা মিথ্যে ছিল? মেয়েটি চুপ। একদম চুপ।
আর কোন কথা হলো না। সি, এন জি ততক্ষণে ষ্টার্ট নিয়েছে। বাড়ি ফিরবার পথে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম এত বড় উপকার করলেন; আপনার নামটা তো জানা হলো না। মেয়েটি যেতে যেতে বললো— হাজার লোকের ভীড়ে ক’জনকেই আর মনে রাখতে পারি বলুন; তাছাড়া আমাকে মনে না থাকলে কোন দোষ হবে না তাতে।
—দোষ হবে না জানি. কিন্তু উপকারটা ফেরত দিতাম আরকি।
তিন
সুশির সাথে দ্বিতীয় বার দেখার তারিখটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না তবে এটুকু মনে আছে; গারো বাজারের শিবতলার পথে এক ভিখেরীর থালায় পয়সা দেব বলে পকেট হাতরাচ্ছিলাম; আচমকা ও পেছন থেকে ভিক্ষে থালায় পয়সা দিয়ে বলেছিলো; দরাজ দিলের একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে; দরাজ দিল না হলে ভিক্ষের পয়সাও পকেটে থাকে না।
রিকসা করে যাচ্ছিল সেদিন; তাই আর ধরতে পারিনি। মেয়েটির নাম সুষ্মিতা-সুশি সেটা প্রজেক্ট ম্যানেজারের কাছেই প্রথম জানতে পাই। নীল লেকের ফটোসেশনের মিশনেই তৃতীয়বারের মতো ওর সাথে দেখা হয় আমার। সেদিন একটা বালুচরি শাড়ী পড়ে এসেছিলো; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে বা”চাদের ডাটা এন্ট্রি করছিলো। আমি সামনে গিয়ে হ্যালো বলার পর ও বললো; আমি কি আপনাকে চিনি?
আমি হাসি চাপা রাখতে পারছিলাম না, তাই বললাম আপনার নাম তো সুশি; তাই না। মেয়েটি কপট রাগ দেখিয়ে বলল—হ্যা, তো; বলুন এখন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? নাকি আপনি আমার ডাটা নিতে এসেছেন ? কিছু করতে হবে না, আপাতত পরিচিত হতে চাই। সুশি ভেবে নিয়ে বললো, আমি আর আপনি মানুষ এটাই বড় পরিচয়। আমি হেসে বললাম- কেন পরিচয় দিতে অসুবিধে আছে? আবার সেই চুপ। নিশ্চুপ।
আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম কাজে তাই আর কথা বলা হলোনা সেদিন। নীল লেকের ফটোসেশনে সুশিরও ছবি তোলা হয়েছিলো। সেই ছবিটা দেখে আমি জলরঙে একটা ছবিও এঁকেছিলাম। দুপুরের পরে সাদা মাটির উপর বসে ডাটা এন্ট্রির টেবিল ছেড়ে সুশি হাওয়া লাগাচ্ছিল গায়ে। আমি ঠিক তারই পাশে ক্যামেরা রেখে ডাইরি লিখছিলাম। এরই মাঝে আমার ধোয়া ছাড়বার নেশা পেয়ে বসলো তাই ডাইরি রেখে উঠে গিয়েছিলাম; এসে দেখি ডাইরি নেই। খুঁজেও পেলাম না। সুশিও নেই যে ওকে জিজ্ঞেস করবো। শেষে টিম ম্যানেজমেন্ট অফিসারকে জিঞ্জাসা করলাম- সুশি কোথায়? উনি ভ্র-বাকা করে বললো সুশি নিচে পানি আনতে গেছে।
বিকেলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আবারো। সন্ধ্যের দিকে তখনও আঁধারটা পুরো আসেনি; তবে আসবে আসবে করছে। সবাই হিলস ছেড়ে বাড়ির উদ্দ্যেশে হাটছি তখন। পিছনে দেখা গেল সুশিকে; আমি পাশে গিয়ে বললাম আমার ডাইরিটা দেখেছেন? ও চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো হ্যাঁ। মনে মনে আমার একটু রাগ উঠে গেল; না বলে কেন এমনটা করলো। আচ্ছা মেয়েতো, ঝাড়ি দিতে হবে। ডাইরি বিষয়টা আমার কাছে অতি গোপনীয় একটা জিনিস। আমি ওর সাইড ছেড়ে দিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ও পিছু ফিরে এসে বললো- বাতাসে ডাইরি পড়ে গিয়েছিলো, তাই আমি নিয়ে গিয়েছিলাম; ভয় নেই, পড়িনি। কথাটা যে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না সেটা ততক্ষণে আমার চোখ দেখে ও বুঝে গিয়েছিল। কোম্পানীর মিনিবাসে করে সবাই যে যার আস্তানায় ফিরছিলো। গারো বাজারে নামবার সময় সুশি বলে উঠলো লেখায় এতো বানান ভুল করেন কেন?
চার
গারো বাজারের অন্ধগলির পাশেই একটা বাঈজীখানা যে আছে তা আমি জানতাম; কিš‘ কখনো সেখানে যাইনি। প্রয়োজনও পড়েনি; নীল লেকের প্রজেক্ট শেষ হবার আগের দিন সুশি আমায় বললো আপনি কখনো নর্তকীর উদোম নৃত্য দেখেছেন? আমি বললাম না তো।
—তাহলে গনিকাবৃত্তির উপর অমন একটা লেখা কী করে লিখলেন ?
—কোথায় পেলেন লেখাটা?
—যেখানে ছাপাতে দিয়েছিলেন, সেখানেই।
—আসলে আন্দাজে লিখেছি।
—মিথ্যে বলতে ভয় করে আপনার। আমি জানি পুরুষরা এরকমই হয়।
—অনেক পুরুষ নিয়ে গবেষনা করেছেন মনে হচ্ছে।
—অনেক না হোক আপনাকে নিয়ে কিছুটা করতে গিয়ে বুঝতে পারছি।
আমি আকাশ থেকে পড়বার ভাব ধরলাম না; কিন্তু চোখ বড় করে বলালাম; হঠাৎ আমাকে নিয়ে।
—হ্যাঁ।
—গল্পে তো লিখি বিষ খেয়ে মরে যাচ্ছি; কিন্তু তা লিখতে গিয়ে কী আমাকে বিষ খেতে হয়।
—বুঝলাম, কিন্তু বিষের স্বাদ যে কেমন; সেটা না জানলে কী লিখতে পারতেন?
—তা পারতাম না; তবে গনিকা বৃত্তির ব্যাপারটা আন্দাজে লোকমুখে শুনে লিখেছি।
—তাই!
—হ্যাঁ।
আমি নতুন প্রজেক্ট নেবার আগে সিডিউল দেখতে গিয়ে বারবার করে দেখছিলাম, সুশি কি আমাদের প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত হয় কিনা। সুশির জন্য কেমন একটা টান যেন আমার মনে অনুভব করতে পারলাম। সুশি কাজে না এলে আজকাল ছবি তোলার কোন মুডই আমার মাঝে থাকে না। আর মুড থাকলেও দেখা যায় অকারনেই এক শট তিন-চারবার করে দেয়া লাগছে।
কদ্দিন নিউমারলজি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম আমার লাইফে কি কোন প্রেম-ট্রেম আছে কিনা। কিন্তু আমি ভালো গননা করতে পারি না বলে পুরোটা বুঝে উঠতে পারি না। তবে যেটুকু বুঝি আছে কিছু একটা। আমার সর্বশেষ প্রজেক্টের কাজ একটু বেশি ছিল ছবি প্রিন্ট করাতে ছ’বার সাউথ হিলসে যেতে হলো যে কারনে চেহারা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেল। ছবির কাজ একাই সব করতে হচ্ছিল। সুশিও মাঝে মাঝে আমায় সময় দিতো; রাস্তায় আসবার কিংবা যাবার পথে, কিন্তু কোন পার্ক কিংবা রেস্তেরায় নয়; আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম সুশি আমাকে একটু একটু করে চিনে নিচ্ছে; কিন্তু সেটা ও বুঝতে দিতে চায় না।
নতুন প্রজেক্টে সুশি আর আমি দুজনেই থাকলাম কিন্তু প্রজেক্ট একটু প্রত্যান্ত অঞ্চলে পড়ে গেল। যাবার কিংবা আসবার সমস্যা না থাকলেও ওখান থেকে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে গেলে রাত অর্ধেক হয়ে যাবার সম্ভবনা আছে তাই কর্তৃপক্ষ ওখানের একটা গ্রামে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। শুরু হলো আমাদের নতুন প্রজেক্ট।
আমাদের প্রজেক্ট শুরু হয়েছিলো শীতের মাঝামাঝি। সেইসব দিনগুলোতে মেঘালয়ের পাহাড় ভেদ করে চাঁদ উঠতো চারপাশে, তার ঘোলাটে আবরনে পুরো পাহাড় জুড়ে রহস্যময়তা বিরাজ করতো; আমরা সবাই চারপাশে গোল হয়ে আড্ডা দিতাম অনেক রাত অবদি; এ তল্লাটে পাওয়া যেত খুব কম; আমার তৃষ্ণার্ত মন তাই মাঝে মাঝে সুশির খোলা গলায় গাওয়া গানের নদীতে ডুব দিতো।
সুশি ভালো গান গাইতে পারতো। জানিনা কেন যে জীবনের লক্ষ্যে গানটাকে সঙ্গী না করে এই ঘুরে বেড়ানো আর শিশুদের নিয়ে মহা-গ্যাঞ্জাম মূলক কাজের পিছু ছুঁটছে। একদিন এই নিয়ে বলেই ফেললাম আপনি এতো ভালো গাইতে পারেন, গান-টান গেয়েই তো জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন এখানে শুধু শুধু পড়ে আছেন কেন?
—কেন যে পড়ে আছি সেটা জানিনে, তবে ভাল লাগে এই ছোট ছোট বা”চাদের সাথে থাকতে ওদের মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে তাই হয়তো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম এটা আসলে কথার কথা বলা হলো হয়তো।
প্রজেক্টের মাঝামাঝি পাতাঝরা দিন যা”িছল তখন; সেই সব দিনগুলিতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাবনার নদীতে খেয়া বাইতাম; আমি বুঝে উঠতে পারলাম না আসলে আমিই কি ভালোবেসে ফেলালাম সুশিকে না সুশিই ভালোবেসে ফেললো আমাকে। দিন শেষে, কাজ শেষে হবার পর প্রতিদিন আড্ডা বসতো। সেই প্রতিদিনকার আড্ডাটা প্রানবন্ত হয়ে উঠলো দিনের পর দিন। তিন মাসের প্রজেক্ট, এর মাঝে কারো বাড়ি যাওয়া হবে না। তাই আমরা সবাই সবার মাঝেই ডুবে থাকলাম। মনে হচ্ছিল যেন এটা একটা পরিবার। সুশি এসেছে ঢাকা থেকে, আমি এসেছি শিলিগুড়ি থেকে; দুজনার দুই দেশ হলেও কথা আর আচরণে পার্থক্য করা যায় না। আমাদের মধ্যে চিন্তার চিন্তক বৈঠক যেন সমান-সমান।
আমরা মাঝ রাতে তারা গোনা কিংবা কানামাছি খেলার আয়োজন করাতাম। আমাদের মাঝে রবীন্দ্র, ভলেটেয়ার কিংবা সত্যজিৎ ও শার্লক-হোমস নিয়ে জোর তর্ক হতো। আমরা নিজেদের জীবন-যাত্রা নিয়ে মুখে যতই উদাসীনতা দেখাতাম আসলে মনে মনে সবাই তৈরি হচ্ছিলাম ভবিষ্যতের জন্য।
আমাদের রোজকার খবর ছিলো- দূর পাহাড়ের গায়ে সকালে বৃষ্টি হবে, নিচে পানি নেই; দুপুরে খাওয়া মিলবে না। রাতে শুধু খিচুরি খেতে হবে কিংবা আজ নিচের বাজার থেকে রান্নার সরঞ্জাম কিনতে হবে, এই সব খবর সুশি প্রতিদিন কাজে যাবার আগে লিখে আমার দরজার সামনে রেখে যেতো। আমার লাইসেন্স নেই তাই বুঝে শুনে বাইক চালাতে হবে, সেই সাথে নিচে গারো পল্লীতে ঢোকা যাবে না, এই জাতীয় কথা নিয়ে রোজ শাষাতো আমায়।
টিম লিডার পারুল আপা; কিংবা প্রজেক্ট ম্যানেজার বিভাস বাবু আমার কাজের প্রশংসা করলে সুশি’র সেটা ভালো লাগতো না, ক্ষেপে গিয়ে বলতো ছবি তোলার জন্য চাই সফট হাত; এই রকম কঠিন হাতে ভালো ছবি হয়না। ছবি তোলার জন্য চাই প্রকৃতির মতো মন; যেখানে দুঃখরাও করবে স্বপ্ন বুনন। আমি একদিন বললাম- তোমার হাত খুব সফট্ তাই না? আমরা তখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছি ও বলল ছুঁয়েই দেখ না সফট্ কি না? আমি বললাম নাহ্ আর একদিন ছোঁব।
আমাদের বেশি কষ্ট হতো নিচে পানি আনতে যেতে। আমার স্নান করা নিয়ে ওর আপত্তি ছিলো; ঝরনার জলে স্নান করলে ঠান্ডা লেগে যাবে। বিভাস বাবু বলতো- “গেলে যাবে তাতে তোমার কি সুশি” “ও বলতো- আমার কিছু না হলেও আপনার প্রজেক্ট থেমে থাকবে তো বিভাস বাবু” আবার ক্ষেপানোর জন্য বলতো থেমে গেলে যাক না, আর ভালো লাগেনা কি বল? সুশি বলতো- তাই বলেন তো আমি কমিটির কাছে জানাই আমাদের ভালো লাগছে না এই প্রজেক্ট। এই সব কথা প্রায়ই চলতো। আমার আপত্তি ছিল ওর চুল বাঁধায়; খোলা চুলে তোমাকে ভুতনি’র মতো দেখায়; ও বলতো -দেখালে দেখাক তোমার তাতে কী?
“তুমি এত ফরসা হইলা ক্যান” এই কথা বলে সুশি’কে রোজ ক্ষেপাতো বাবুর্চি মিরাস আলী; মিরাস আলী না থাকলে বোধহয় এই প্রজেক্টে আমাদের চেহারা কাঠপাতা হয়ে যেত।
একদিন সুশি; হাতে করে পায়েস নিয়ে হাজির বললো- নিজে রেধেছে; খেতে গিয়ে,দেখি মিষ্টিহীন। পায়েস নিয়ে সে,কি হাসা-হাসি; আমি সে-সময় খুব গানের পাগল ছিলাম একদিন কান লাগানো ইয়ারফোন সহ এম.পি.থ্রি প্লেয়ার ছুঁড়ে একদিন নিচে ফেলেছিলো । হেমন্তের প্রথম দিন ও একটা কবিতা আবৃত্তি করছিলো। খুব সম্ভবত প্রেমের কবিতা। আমি মিস করেছিলাম। সেদিন কানে এম.পি.থ্রি প্লেয়ার ছিলো। সেদিন থেকে একটা আফসোস আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিল; ওর নিজের লেখা ওই একটাই কবিতা ছিল যে। আমি ওই কবিতা শত চেষ্টা করেও ওর মুখ থেকে আর শুনতে পাইনি; পরে জেনেছিলাম ও আমাকে শোনাতেই সেদিন আবৃত্তি করেছিল।
নবান্ন উৎসবের দিন ও এসে বললো কান্ত আজ তো তোমার ছুটি; স্যার বলেছে তুমি আজ আমাদের সাথে ঘুরতে যাবে; আমি বললাম, না আজ আমি তোমার সাথে একা ঘুরবো; যাবে আমার সাথে?
-লোকে দেখলে বলবে কী?
-লোকের কথায় কী যায় আসে? আমরা দু-জন কলিগ। তাছাড়া তোমার-আমার ব্যাপারটা সবাই জানে। সুশি বললো, জানলেই কি! এটা তো সিনেমার পর্দা না; এটা গ্রাম বাংলার গেয়ো মাঠ-ঘাট এখানে এসব কেউ দেখতে চায় না। সুশি একা যাবে না আমি জানতাম; তাই বিকেলে ওকে বললাম ঠিক আছে আজ তাহলে চড়ুই ভাতি হোক। দিনগুলো এভাবেই শেষ হয়ে গেল। আর শেষ হয়ে এল আমাদের প্রজেক্ট।
পাঁচ
প্রজেক্টের শেষ দিন। বিকেল এই গ্রাম আর সবুজ পাহাড় ছেড়ে বাড়ি ফিরবো। আমাদের চোখ গুলো কতদিন পর সেই পুরোনো মানুষদেরকে দেখবে সে আনন্দের পিনগুলো নাচছিলো ভেতরে ভেতরে। ব্যাগ গুছিয়ে সবুজরঙা একটা পাঞ্জাবী পড়ে আমি ঘর থেকে বের হলাম। বিভাষ বাবু আমাকে পেমেন্ট দেবার চেক দেবে বলে সেই সকাল থেকে ডাকছেন। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টায় আজ আমাদের প্রজেক্টের শেষ কাজ হবে। আমি চেক নিয়ে ঘরে আর ফিরলাম না। পারুল আপা আমার ক্যামেরা নিয়ে গেছে সেই ভোর বেলা, তার খোঁজে সামনে এগিয়ে গেলাম।
মেঘ নেই আজ; রোদও নেই। উঁচু পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে সুশি ক্যামেরা হাতে দাড়িয়ে। কাছে যেতেই ও বলে উঠলো-কান্ত তুমি আমাকে একটা আকাশ কিনে দেবে? আমি সেখানে তোমার তোলা সমস্ত ছবি দিয়ে একটা গ্যালারী বানাবো। আমি হেসে বললাম- দেব, তবে আকাশ কেনার টাকাটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে।
আমাদের কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। আমাদের পুরো টিমের অর্ধেক এই পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ কেউ ছবি তুলে নি”েছন কেউ বা সাদামাটি , কিংবা বুনো ফুল ব্যাগে ভরছেন। সবাই কিছুটা মগ্ন হঠাৎ গুলির শব্দে সবাই সচকিত হলাম; বর্ডার থেকে গুলি আসছে; বর্ডার ছয়শো গজেরও কম দুরত্বে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম গুলির আওয়াজ ক্রমশই বাড়ছে। সবার ভেতরে তখন এক-রকমের উত্তেজনা দেখা গেল। আমরা নিচে নামবার জন্য পা বাঁড়ালাম। পাহাড়ের চারপাশে তখন নীরবতা নেই বললেই চলে; আমরা সবাই পা চালিয়ে নিচে নামতে লাগলাম; অচেনা জংলী ফুল আমাদের পা ছুঁয়ে যাচ্ছিল; সবার মাঝে একটা উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে; আমরা সবাই সেই উত্তেজনা নিয়ে গতি বাড়াচ্ছি ক্রমশই।
টিমের যারা এখানে আছে তারা এই মুহুর্তে কে কার আগে নিচে নামবে তারই প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে। এই মুহুর্তেই একদল লোক হাতে অস্ত্র উচিয়ে ধেয়ে আসতে লাগলো; দেখে মনে হলো ওরা চোরা-কারবারি বর্ডার ক্রস করবার সময় হয়তো ধরা খেয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে গেলাম; ওরা গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আমি সুশির হাত ধরে দৌড়ে দিলাম; আচমকা পেছন থেকে ক’জন ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর; আমি তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেলাম বুনো গাছের উপর। পিছু ফিরে দেখি সুশি নেই!
নেই! পাশে নেই ! চোখ যতদূর যায়। শুধু একমুহুর্ত ওর আর্তচিৎকার শুনলাম; আমার পেছনে যে বড় খাদটা ছিল সেখানটায় গিয়ে দেখি; প্রায় ষাট গজ পাহাড়ের নিচে পড়ে আছে সুশি। আমার চোখে পৃথিবী আঁধার হয়ে আসতে লাগলো। আমি খুব সম্ভবত বুনো গাছের পাশেই ঢলে পড়েছিলাম।
আমার চোখ যখন আবার জেগে উঠলো চেয়ে দেখি ওরা ততক্ষণে সুশি’র লাশ নিয়ে চলে গেছে। নোনা জলের তান্ডবে বার বার মনে হলো; আলো ছাড়ব; মায়া ছাড়ব, পৃথিবীও ছাড়বো। চোখ মেলবার পর থেকে মুখে কথা ফোটেনি বেশ ক’মাস। বহুদিন সবুজের বনে যাইনি। ক্যামেরা আর কাঁধে তুলিনি অনেকদিন। নিরব পথ পেলেই সুশি এসে দাঁড়ায়, পথ চলতে পারি না।
ওর বিদায়ের পর থেকে আজকের এই দুপুর পর্যন্ত আমি পাথরে গড়া ভাস্কর্য হয়েই ছিলাম; খানিক আগে সেই কথার পুনরাবৃত্তি। যে কথাটা সুশি আমায় বলেছিল , সে কথাটাই আজ অন্য কারো মুখে শুনে ভেতরটা নাড়া দিয়ে গেল। কিছুটা উন্মাদনা আমার মাঝে প্রকাশ পেল। আকাশ মাঝে ভেসে উঠলো সুশি’র কন্ঠ; সেই যে, শেষ দিনের আগের দিন ওর সাথে বাইরে বের হতে না পেরে মন খারাপ করেছিলাম। তখন ও বলেছিল- দেখো আমি যদি কোথাও হারিয়ে যাই; তোমার বিষন্নতা মুছে দিতে এমন একজনকে পাঠাবো; যে তোমাকে ভালোবাসবে আমারই মতো; শুধু তুমি তাকে চিনে নিও।
গ্যালারির একপাশে বসে ছিলাম এতক্ষণ। আবার কেউ একজন ছবি কিনতে এসেছে। সুশি’র জগৎ থেকে ফিরে এলাম। দৌড়ে গেটে এলাম। রন্তু ওই মেয়েটি কোথায়? “দাদা চলে গেছে তো”!
আমি পিছু ছুঁটলাম গেট পেরিয়ে একদম বাইরে। পথে নামলাম কাঠ রোদ্দেুর আমার সারা গায়; ওকে খুঁজে পেতেই হবে; আমার চোখ আজ রোদের ছেলের গায়ে আঁক কষবে বিষন্নতা তাড়াতে, কিন্তু ওকে পাবো তো?
সমাপ্ত