পোস্টস

প্রবন্ধ

বিজ্ঞাপনের একাল সেকাল

১১ জুন ২০২৪

ড. মো. আব্দুল হামিদ

মূল লেখক ড. মো. আব্দুল হামিদ

কখনো ভেবেছেন, বন্ধুদের আড্ডা কেন দ্রুত জমে ওঠে? দিনের পর দিন এমনকি মাসের পর মাস তারা আড্ডা দেয় অথচ বোরিং লাগে না। তাদের কথা কখনো শেষ হয় না। এর পেছনে সত্যিই কোনো সিক্রেট আছে কি? আচ্ছা, আমি কেন আপনাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে লেখাটি শুরু করলাম? সেটা না করে এ ব্যাপারে আমার ভাবনাটা সরাসরি শেয়ার করতে পারতাম। আপনি যদি মন্তব্য না লিখেন তবে এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে পৌঁছা প্রায় অসম্ভব। তার পরও কেন প্রশ্ন করছি? 

 

কারণ সব প্রশ্নের জবাব অন্য পক্ষের কাছে পৌঁছা জরুরি নয়। বরং ভাবনার দুয়ারটা খুলে দেয়া কিংবা চিন্তাটা উসকে দেয়া বেশি কার্যকর। এক্ষেত্রে আমার লেখার বড় সমালোচনা হলো— সমস্যা সামনে আনি, বিস্তারিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরি কিন্তু কোনো সমাধান বাতলে দিই না। এমনকি ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের বহু পাঠক বলেছেন, সেখানে যে ইস্যুগুলো উত্থাপন করেছেন সেগুলোর জবাব নিয়ে আরেকটা বই লিখুন! আমি তাদের কী বলি সেটা পরে বলছি। আপাতত পরের প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করুন।

 

মনে করুন, পাঁচজন একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। সেখানে পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে শুধু একজন কথা বলবে আর বাকিরা শ্রোতা হয়ে বসে থাকবে। মনের মধ্যে ওই কথায় সম্পূরক বা বিপরীত যত কথাই আসুক তা বলার সুযোগ নেই। তাহলে সেই আড্ডা কতটা প্রাণবন্ত হবে? পরবর্তী সময়ে সেই আড্ডায় আবারো বসার সুযোগ পেলেও কি আপনি যাবেন? খুব সম্ভবত না। হুমায়ূন আহমেদ খুব সহজেই আড্ডার মধ্যমণি হয়ে উঠতেন। কীভাবে সেটা সম্ভব হতো? তিনি কি অনেক জ্ঞানের কথা বলতেন? 

 

না, বরং জুৎসই একটা ইস্যু সামনে এনে নিজে চুপ হয়ে যেতেন। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে বোঝাতেন যে তিনি ওই আসরের সবচেয়ে মনোযোগী শ্রোতা। মাঝেমধ্যে হাসতেন বা ইশারায় কিছু বোঝাতেন। খুব প্রাসঙ্গিক দুএকটা শব্দ বা বাক্য বলেই অন্যদের সুযোগ দিতেন। ফলে সে আসরে বসা সবাই নিজের কথা শোনাতে পেরে তৃপ্ত হতেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে পরের আসরে হাজির হতেন। কারণ তারা নিজেদের কথা বলতে পারতেন। 

 

আসলে সবাই বলতে চায়। একই টক শো টিভির চেয়ে ইউটিউবে দেখতে বেশি আরাম লাগে। কারণ ভিডিও দেখার পাশাপাশি নিজে কমেন্ট করা যায়। বলতে পারেন, সেগুলো আসলে কেউ কি পড়ে? সত্যি কথা বললে, সেগুলো কেউ পড়া কিন্তু জরুরি নয়। যেমন নিবন্ধের শুরুতে করা প্রশ্নের জবাবে আপনি কী বলতে চান… তা আমি শোনার চেয়ে বরং আপনার ইমোশন রিলিজ করতে সহযোগিতা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ!

 

কয়েক বছর আগে সদ্য কারামুক্ত এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। প্রায় ২০ বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। তার বড় অংশ কেটেছে (মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর) কনডেম সেলে! একবার ভাবুন, তিনি কি সেখানে নির্বাক ছিলেন? না, বরং যতক্ষণ জেগে থাকতেন, খুব সম্ভবত তিনি সবসময় নিজের সঙ্গে কথা বলতেন। যে মানুষ প্রতিটা দিন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, তিনিও বলতে চান। যতক্ষণ সুযোগ আছে ততক্ষণ বলতে চান। কিন্তু ঠিক কয়জন তাদের কথা শুনতে চায়? যখন কেউ শুনতে চায় না তখন মানুষ একা একা কথা বলে। লোকে ভাবে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! 

 

আজকের দিনে মার্কেটারদের জন্য এটা খুব বড় চ্যালেঞ্জ। আপনি যাদের যে বিষয়ে বলতে চান তা যত সুন্দরভাবেই উপস্থাপন করা হোক না কেন, তাদের মনোযোগী হওয়ার সুযোগ কম। প্রতিনিয়ত এত এত বিষয় তাদের মনোযোগে ভাগ বসাচ্ছে যে আপনার কথায় কান দিতে পারছে না। তাহলে সেটা বলবেন কেমন করে? এক্ষেত্রে গল্প একটি বড় অবলম্বন হতে পারে। গল্পের শক্তি কতটা প্রবল তা বোঝার জন্য ঈশপ, নাসির উদ্দিন হোজ্জা কিংবা গোপাল ভাঁড়ের দৃষ্টান্ত দেখুন। সেগুলো শত-সহস্র বছর কীভাবে মানুষের মুখে মুখে টিকে আছে! কেউ সেগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে উপস্থাপন করে না, বিজ্ঞাপন দিতে হয় না, এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠান সেগুলোকে প্রমোটও করে না। তার পরও এমন প্রভাব বিস্তারের রহস্য কী? 

 

এটা উপলব্ধি করতে ভাবুন—স্কুলে স্যারদের ভয়ে কিংবা ভালো রেজাল্টের আশায় যত যা মুখস্থ করেছিলেন তার কয়টা এখনো মনে আছে? অথচ তখন শোনা গল্পগুলো কি ভুলে গেছেন? বিস্ময়কর ব্যাপার তাই না? যা মনে রাখার জন্য এত চেষ্টা, এমনকি প্রার্থনা করতেন—সেগুলো ভুলে গেছেন। যে গল্পগুলো কখনো আলাদাভাবে মনে রাখার চেষ্টাই করেননি সেগুলো দিব্যি মনে আছে! এভাবেই স্থান-কাল-পাত্র অতিক্রম করে ঈশপের গল্প গোটা দুনিয়ায় টিকে আছে। অর্থাৎ কোনো গল্প যদি হৃদয়কে স্পর্শ করে তবে শ্রোতা নিজেই গল্পের এজেন্টে পরিণত হন। অন্যদের কাছে সেটা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন!

 

কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে যত বাদ্যযন্ত্র থাকে সেগুলো যদি বিক্ষিপ্তভাবে বাজে তবে সেখানে টেকা মুশকিল হয়। কিন্তু তারা যখন ব্যাকরণ মেনে সেগুলো বাজায় তখন তা হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী। ঠিক তেমনিভাবে গল্পগুলোও নানা বাক্যের সমষ্টি যাতে থাকে হৃদয়কে স্পর্শ করার মতো উপাদান। তাই সেগুলো সহজেই মনে থাকে। এমনকি নিজের মতো করে সেগুলো রিপ্রোডিউস করা যায়। মার্কেটিং কমিউনিকেশনের সফলতার জন্য এটা খুব জরুরি। প্রথমত, টার্গেট অডিয়েন্সকে কানেক্ট করা। তারপর সেগুলো তাদের নিজেদের মতো করে অন্যদের কাছে উপস্থাপনের সুযোগ করে দেয়া। সব কথাই আপনি বলবেন, সেটা ভালো নয়। বরং তাদের বলতে দিন, নিজের অনুভূতিকে প্রকাশের উপলক্ষ হোন। 

 

এ পর্যন্ত আপনার দেখা সবচেয়ে সফল বিজ্ঞাপনটির কথা ভাবুন। দেখবেন সেখানে অবশ্যই একটা গল্প আছে। কখনো সেটা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে শিশুশিল্পী দীঘি ময়না পাখির বিজ্ঞাপন করার পর বহু চেষ্টা করেও সেই ছায়া থেকে সে বেরোতে পারছে না। লোকে তাকে নায়িকা নয় বরং ‘কিউট বেবি’ হিসেবে কল্পনা করতেই ভালোবাসে। ঠিক তেমনিভাবে অসংখ্য প্রমোশনের ভিড়ে আপনার হাতে গোনা যে কয়টি ঘটনা মনে পড়ে সেগুলোর মূল উপাদান ছিল গল্প। তবে এখনকার স্টোরি টেলিং মোটেই সহজ নয়। কারণ চারপাশে প্রতিনিয়ত এত বেশি ‘নয়েজ’ সৃষ্টি হচ্ছে যে কাউকে আলাদাভাবে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ কম। 

 

আরেকটা বড় সমস্যা হলো—গল্পের টিকে থাকা। আমি একটা বিজ্ঞাপন বিটিভিতে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে দেখেছি! সেটা ছিল জীবন বীমা করপোরেশনের। সাদাকালো সেই বিজ্ঞাপনে দেখানো হতো কর্মজীবনে বীমা করার সুফল হিসেবে এক বৃদ্ধ দম্পতি কীভাবে অবসর সময়ে হেসেখেলে জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ এখনকার অতি সফল গল্পেরও জীবন চক্র খুব সংক্ষিপ্ত। একবার ভাবুন, বছর খানেক আগে ‘হাওয়া’ সিনেমা নিয়ে কী উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল! অথচ আজ কয়জন সেটার কথা মনে রেখেছে? তার বিপরীতে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ কিংবা ‘রঙ্গীন রূপবান’ সিনেমাগুলো টানা এক দশকেরও বেশি সময় দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করেছে। ওটিটি প্লাটফর্মে নিত্যদিন প্রভাবশালী গল্প আসছে। কিন্তু ক’দিন আগে আলোড়ন সৃষ্টি করা সিরিজটি হঠাৎ করেই পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছে! 

 

এখন প্রতিযোগিতার ধরন ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। শুধু সমজাতীয় পণ্য ও সেবা অফারকারীদের মধ্যে সেটা সীমাবদ্ধ থাকছে না। আগে বিটিভি যে অখণ্ড মনোযোগ পেত আজ তার প্রতিযোগী শুধু তিন ডজন দেশীয় বা শতাধিক টিভি চ্যানেল নয়। বরং জ্ঞাত-অজ্ঞাত অসংখ্য বিকল্প বিনোদন পণ্য এসে গেছে। ফলে মার্কেট সাইজ ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাই নামে ‘গণমাধ্যম’ থাকলেও নির্মাতারা আর সবার জন্য একই পণ্য তৈরি করছেন না। বরং তারা সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য সেগুলো করছেন। এতে সমজাতীয় চাহিদাসম্পন্ন ভোক্তারা সেটা গ্রহণ করছে। অন্যরা সেটা ফিরেও দেখছে না। এভাবে বাজার বিভাজন একদিকে ব্যয় বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে স্বল্প সময়ে বিনিয়োগ তুলে আনার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। 

 

নতুন পণ্য বাজারে আসার গতি বেড়ে যাওয়ায় ইদানীং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আগের দিনে একজন নির্মাতা দীর্ঘ সময় নিয়ে মনের মতো করে একটা কাজ করতেন। ফলে তাদের নামেই প্রোডাক্ট চলত। কিন্তু এখন একটা কাজ ভালো করার পর দীর্ঘদিন তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। গত এক বছরে সফল কয়েকটি সিনেমা, নাটক, ওয়েব সিরিজ এমনকি বিজ্ঞাপনের কথা ভাবুন। দেখবেন (খুব ব্যতিক্রম ছাড়া) একই পরিচালকের বা নায়কের একাধিক কাজ নেই। অর্থাৎ চমক সৃষ্টিকারী কাজ করার পরও তারা চুপসে যাচ্ছেন। তখন তাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরছে। ভালো সৃষ্টি হচ্ছে পরাহত।

 

তার পরও মানুষ গল্প পছন্দ করে। তাই বিশ্বাসযোগ্য গল্প ও তার সুনিপুণ উপস্থাপনার মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব। তবে সেগুলো ধরে রাখার জন্য সৃজনশীলতার সমন্বিত চেষ্টা জরুরি। আমাদের দেশে এ জাতীয় কাজগুলো এখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অর্থাৎ সেভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি। ফলে একক ব্যক্তির চেষ্টায় মাঝেমধ্যে দুএকটি কাজ আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় না। সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি বড় হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা চর্চার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। অথচ আগামীতে একক ব্যক্তির চেষ্টায় এমন খাতে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন হবে।