"আজ সত্যজিৎ রায়কে স্মরণ করি। দুর্দান্ত এক নির্মাতা ছিলেন কিন্তু ক্লিশে, দীর্ঘ সময় ধরে দেখা যায় না তা। এই মুহুর্তে এতে চোখ লেগে আসে, ঝাপসা ঐ সাদা-কালো আজ বড্ড বেমানান; এমনও নয় যে আমরা ঐ ছবিগুলোকে আজ রঙিন করতে পারবো। আমার মনেহয় সব ছবিকে রঙিন করার প্রয়োজন মনে হলেও হীরক রাজার দেশেকে রঙিন করার প্রয়োজন নেই কেননা আমরা তেমনই এক রাজার অধীনে আছি। সারাদেশটাই আজ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র মন্ত্রগুলো ওপরতলার লোকেরা মাইক্রোফোনে পালাক্রমে বলতে থাকেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সেভাবেই বলতে থাকেন। রে সাহেব (উনি রায় বলার বদলে রে বলতেন), যাহোক তিনি ঠিক আদর্শ বুদ্ধিজীবী কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়, কেননা আদর্শ বুদ্ধিজীবী হলে তিনি রাষ্ট্রের সহায়তায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন না।
এদিকে কিন্তু আমার বন্ধু তারেক মাসুদ ব্যতিক্রম। আমরা সমসাময়িক, এক সাথে আড্ডা দিতাম। আহমদ ছফা আমাকে ও তারেক মাসুদকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি অবশ্য ক্যাথরিনকেও খুব পছন্দ করতেন; কেবল পশ্চিমা লোক বলে মোটেও নয়, তার প্রজ্ঞা এবং আদর্শের জন্য। ক্যাথরিন মানে ক্যাথরিন মাসুদ, প্রয়াত তারেক মাসুদের সহধর্মিণী। যা বলছিলাম আড্ডা দিতে দিতেই ক্যাথরিনের সাথে তারেকের পরিচয়; আড্ডার সাথে সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং এর প্রভাবক ছিলেন আহমদ ছফা। ছফা দুর্দান্ত এক মানুষ ছিলেন, তিনি দুজনের ক্ষমতা এবং পারস্পারিক সহচর্যের যে আবশ্যকতা তা বুঝতে পেরেছিলেন। তারেক মাসুদ খুব বড় নির্মাতা হয়ে উঠেছিলেন তা বলবো না কিন্তু যা করে গেছেন তাতে স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার শক্তিমত্তার। তিনি হয়ে উঠতে পারতেন সত্যজিৎ থেকেও বড় তারকা; অন্তত বাংলাদেশি হিশেবে আমাদের তা বিশ্বাস করা উচিৎ। প্রায় তিন দশক আগে প্রয়াত এক চলচ্চিত্রকারকে শীর্ষে রেখে দুর্দান্ত নির্মান সম্ভব না, আমি অন্ততপক্ষে এটাই বিশ্বাস করি ছফার উত্তরসূরী হিসাবে, লোকেও তাই।
একটা কথা মনে পরে গেলো তারেকের কথা মনে করতেই; আমার আরেক বন্ধুর নাম ছিলো তারেক। সে একাদিক্রমে অক্সফোর্ডের 'শ্রেষ্ঠ টিচার' হয়েছিলো কয়েকবার, সে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলতো একসময়। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারলো এই প্রিমিয়ার লিগ আসলে আধুনিক দাসত্বের কারবার এবং অক্সফোর্ডের ঐ শিক্ষা ব্যবস্থার আদিমতম রূপ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে ইংরেজ আধিপত্যের মাঝেও কিছুকাল বর্তমান ছিলো তখন সে দেশে ফিরে আসে। আমাদের এ দেশটা ছিলো সুফি-দরবেশদের; সেই চেতনাকে সামনে রেখে সে সঙ্গীত চর্চা শুরু করে। খেয়াল করবেন সুফিদের সময়ে কিন্তু সঙ্গীতের অনুসঙ্গ তথা যন্ত্রপাতি বেশি ছিলো না তাই তার শুরুর দিককার গানে কিন্তু আমরা কোন যন্ত্রপাতি পাই না। আপনারা সবাই তাকে চেনেন আমার তাকে নতুন করে চিনিয়ে দেবার প্রয়োজন নাই।
যে কথা বলছিলাম, সত্যজিৎ রায় অনেকদিন বেঁচে ছিলেন; অসুস্থ অবস্থায় পুরস্কার নিয়েছেন ইন্টারভিউ দিয়েছেন। দুর্দান্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণের যথেষ্ট পারঙ্গমতা থাকা জহির রায়হান কিন্তু বেশিদিন বাঁচেন নি আসলে আমরা বাঁচতে দেই নি। দেশটা স্বাধীন হয়েছে তারও সাতচল্লিশ দিন পরে দেশের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা নিখোঁজ হয়ে গেলো। পরিবারের লোকজন একধরনের তথ্য দিলেন, আমরা ছাত্র থাকা অবস্থায় অন্য কথা শুনেছি; আমি সেদিকে যেতে চাই না। সত্যজিৎ রায় বড় মানুষ। হুমায়ুন আজাদ পথের পাঁচালী নিয়ে যে কথাটা বলেছিলেন তা আমি শতভাগ সমর্থন করি যদিও তার বেশিরভাগ কথাই পছন্দ করপবার মতন নয়। তবে এটাও ঠিক ঐ নির্মান না হলে কতজন পথের পাঁচালীর নাম জানতো তাও গবেষণার বিষয়।"
— যে কথা খান সাহেব এখনও বলেননি। 🙂