পোস্টস

গল্প

নির্বাক পথ

১২ জুন ২০২৪

শ্রাবন দেবনাথ

মূল লেখক শ্রাবন দেবনাথ

কিছু পাওয়া, কিছু না পাওয়া নিয়েই জীবন চলেছে। কোনো দাবি নেই আমার এই জীবনের কাছে। খুশি হই যখন কেউ পাশে থাকে, কিন্তু সেই খুশিটুকুও যেন দীর্ঘস্থায়ী হতে নারাজ। কি আর  করার হয়তো এটিই আমার নিয়তি। করার মধ্যে এখন পড়াশোনা করছি। এছাড়া থাকার মধ্যে আমাদের ১২ বিঘার একখানা জমি রয়েছে। বাবার এখন বয়স হয়েছে। তিনি আর আগের মতো জমির দেখভাল করতে পারেন না। তবু প্রতি মৌসুমে আমাদের ছোট-খাটো আবাদি হয়। এই ধরুন বর্ষায় পাট। বাবা কেন যেন আমাকে তার কাছেই রাখতে চান, কিন্তু মুখে বলছেন "বাবা বাইরে গিয়ে পড়াশোনা কর"। কি করবো! বুঝলেও যে বলতে পারি না' বাবা আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই'। যাই হোক সব কাজ ফাঁকি দিয়ে সরে গেলাম বাবার চোখের আড়ালে। এখন দিনগুলো ঠিক ভালো যায় না। মাঝে মাঝেই কষ্ট হয়। বুকে কোথায় যেন ব্যাথার সঞ্চার হয়। আগের কথাগুলো মনে পড়ে। আগে কত না ভালো ছিলাম। জীবনটা যেমনই ছিল, কিন্তু এই একাকিত্ব তো ছিল না!! এখন বর্ষাকাল চলছে। এর আগেই আমাদের জমিতে বাবা ধান লাগিয়েছেন। কিন্তু, তিনি তো একলা এগুলো তুলতে পারবেন না। আমি জানি, কিন্তু বাবা কি কখনোই আমাকে তা জানতে দিবেন। হয়তো কখনোই না। একদিন রাত ১০ টা কি ১১ টা হবে বাবা কল করেছেন। হ্যাঁ বাবা নমস্কার, কেমন আছেন? বাবা বললেন ভালোই, "বাবা তুই কেমন আছিস? এভাবেই কথাবার্তা চলতে লাগল। কথাবার্তার শেষে বাবা বললেন, বাবা এদিকে একবারটি চলে আয়। এবার ফলন ভালো হয়েছে, দেখে যা। আর অনেকদিন তো হলো বাড়ি আসিস না। একবারটি ঘুরে যা। বাবাকে না করবো এটা আমার স্বভাব বা চরিত্র কোনোটিতেই নেই। আমি জানি বাবা ধানের কাজ একলা করতে পারবেন না। ঠিক আগের মতোই আমি থাকবো তার সাথে। এই ভেবেই তো আমি মহাখুশি। তখন থেকেই যেন শুরু করে ফেলেছি কাউন্টডাউন। ঐ রাতটি যে কিভাবে কেটেছে সেটি শুধু আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তাই জানি। আবেগে যেন ঘুম, ক্লান্তি, খিদে সবই চলে গেছে কোন সুদূরে। সে এক অব্যক্ত অনুভুতি। পরদিন চলে এলেম বাড়িতে। সে কি মুক্ত বাতাস, শিকল ছেঁড়া অনুভুতি। মনে মনে তো দু লাইন ছন্দও বানিয়ে ফেললাম।


 

❝ ধূলি ঘেরা ঐ বদ্ধ কারাগারে

         কেন রয়েছ হয়ে তুমি বন্দি?

       — সে কি এমন বাঁধন যাহা

 ভাঙ্গিতে পারে না ঐ বিদ্রোহীর বাণী॥❞


 

সময়ের স্রোতে ঐ দিনটি চলে এল। আজ আমি একলাই জমি থেকে ধান তুলবো। তা বলে কিছু ধানই বাকি। বাবাকে সাহায্য করতে পেরেই তো আমার আনন্দ, আর কি চাই! আমি ধান তুলতে শুরু করলাম। ধান তোলা প্রায় শেষ, যেই মাথায় নিয়ে রওনা হবো, তখনই হঠাৎ সে কি তুমুল বৃষ্টি! ১২ বিঘার বিশাল জমিতে শুধু একলা আমি। চারিপাশ ধু ধু করছে জনশূন্যতায়। ওই নিস্তব্ধতার মাঝে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কি করবো ভেবে পেলাম না। কিন্তু ধান যে নষ্ট হয়ে যাবে এই ভেবেই জোর পায়ে ছুটলাম। আগাছার ভিড়ে আমার যেন সবকিছুই গুলিয়ে যেত লাগল। চলতে চলতে খোলা শামুকে বিধে কেঁটে গেল পা। ঝর ঝর করে টাটকা রক্তের স্রোেত বয়ে চললো পা থেকে। কিন্তু আমি নির্বাক হয়েই রইলাম। মাথার বোঝা নামিয়ে পায়ের দিকে তাকানোর মতো সাহস আমার হলো না। বোঝা নামালেই জানি আর যে তুলতে পারবো না। তার উপর এই বৃষ্টি, হায় ঈশ্বর!!! আজ কি অসহায় আমি! আজ কাউকে ডাকতেও পারছি না। হয়ে রয়েছি শুধুই নির্বাক। সব কষ্টগুলোকে বাবার স্নেহের চাদরে ঢেকে ছুটে চললাম ঐ রক্তমাখা পা নিয়েই। আমাকে যে কোনোভাবেই ধানগুলো নষ্ট হতে দিলে চলবে না। ভাবনা, বৃষ্টি আর রক্তের স্রোেত এই তিনেমিলে একাকার হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মানুষ ছেড়ে দিলেও প্রকৃতি রেহাই দেয় না আমাদের। কিন্তু মনে হচ্ছে আজ প্রকৃতিও যেন কাঁদছে আমার সাথে। কিন্তু সবকিছুর পরেও যে মুখটি ভাবনার ওপারে ভেসে উঠল, সেটি যে আমার চিরচেনা।