পোস্টস

চিন্তা

রেডিও অনুষ্ঠান: এখনো কেউ শোনে কি?

১২ জুন ২০২৪

সাবরিন সুলতানা

বাংলাদেশ বেতার। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণমাধ্যম। ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র থেকে আজকের বাংলাদেশ বেতার এখনো লক্ষ লক্ষ শ্রোতার হৃদয়ের মণিকোঠায় অবস্থান করছে। ১৪ টি আঞ্চলিক কেন্দ্র আর ৬টি বিশেষায়িত ইউনিট নিয়ে বাংলাদেশ বেতার শিক্ষা, তথ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য, বিনোদনমূলক ইত্যাদি অনুষ্ঠান প্রচার করে যাচ্ছে সগৌরবে। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নিউ মিডিয়া। ফেসবুক, ইউটিউব, ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারকেই বেতারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে "নিউ মিডিয়ায় বাংলাদেশ বেতার"।

মোবাইল ফোন আসক্তি বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু-কিশোর, তরুণ - যুবক সকলেই কোনো না কোনোভাবে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে যেমন শিক্ষা, তথ্য বিনোদন পাওয়া যায়; তেমনি এর কিছু অপকারিতার দিকও রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক অপরাধমূলক কার্যক্রম, নৈতিক অবক্ষয়, সমাজে অশ্লীলতার প্রসার এগুলো মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘটেই চলেছে। আমাদের দেশের শিশু থেকে বয়স্ক সকলেই মোবাইল ফোনের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে যে, এই আসক্তি তাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এর ফলে যেমন নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তেমনি দেখা দিচ্ছে মানসিক বিকৃতি। আকাশ সংস্কৃতির এই চরম অভিঘাতের মুহূর্তে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই সুস্থ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে বাংলাদেশ বেতার।

 

একসময় রেডিও ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। পরবর্তীতে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট আসায় ধীরে ধীরে রেডিওর শ্রোতার সংখ্যা কমতে শুরু করে। কিন্তু সারা বাংলাদেশে প্রতিটি ঘরে খুঁজলে এমন কোনো ঘর হয়তো পাওয়া যাবে না যেখানে এখনো অন্তত একটি পুরনো কিংবা নষ্ট রেডিও নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো এমন হাজারো শ্রোতা আছে, রেডিওর প্রভাতী ঘোষণা শুনেই যাদের ঘুম ভাঙে। বাংলাদেশ বেতার তার শ্রোতা হারিয়েছে ঠিকই কিন্তু নিত্যনতুন উদ্ভাবনী পদক্ষেপের মাধ্যমে বেতার পুনরায় শ্রোতাদেরকে বেতারমুখী করতে বেশ ভালোভাবেই সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ বেতার এখন সারাদেশে ১৪ টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে এএম এবং এফএম অনুষ্ঠান প্রচার করে। একটা সময় ছিলো যখন নির্দিষ্ট বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুধুমাত্র নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ডিভাইস দিয়ে শুনতে হতো। এই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ বেতার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে বেশ কয়েক বছর আগে। এরপর করোনার মহামারি চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ বেতার একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে, যার মাধ্যমে বেতারের কয়েকটি কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছিলো। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ বেতার আনুষ্ঠানিকভাবে নিউ মিডিয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ বেতারের সকল কেন্দ্রের সকল চ্যানেলের অনুষ্ঠান ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে শোনা যায়। বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন কেন্দ্রের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই এখন ফেসবুক ও ইউটিউবে লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছে এবং কিছু কিছু অনুষ্ঠান ধারণকৃতভাবে আপলোড করা হচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট এলাকায় বসে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের যেকোনো কেন্দ্রের যেকোনো চ্যানেলের অনুষ্ঠান এখন দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে শোনা যাচ্ছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে দেশের কিশোর কিশোরী জনগোষ্ঠী।

 

বাংলাদেশ বেতারের স্লোগান হলো "বেতার সবার জন্য, সব সময়, সবখানে"। বাংলাদেশ বেতার শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কথা বিবেচনা করে অনুষ্ঠান প্রচার করে। এতে যেমন রয়েছে শিশুদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান; কিশোর কিশোরীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নাটক; প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রয়েছে অনুষ্ঠান; আছে বৃদ্ধদের জন্য অনুষ্ঠান। প্রায় সকল বয়সীদের জন্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নাটক, গান, কথিকাসহ বিভিন্ন আঙ্গিকে বাংলাদেশ বেতার বিভিন্ন বয়সের শ্রোতাদের কাছে অনুষ্ঠান পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। দেশের শিশু কিশোর জনগোষ্ঠী মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে দিনকে দিন নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে এক ধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে তাদের সহিংস আচরণ, মানসিক বিকৃতি। এই সময়টিতে বাংলাদেশ বেতার হতে পারে তাদের অন্যতম বন্ধু। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বেতার শোনার জন্য এখন শুধুমাত্র রেডিও সেটের উপর ভরসা করতে হয় না। শিশু কিশোরেরা তাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোনটিতে বাংলাদেশ বেতারের ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে অনুষ্ঠান শুনতে পারবে। সেইসাথে ফেসবুক আর ইউটিউবে অনুষ্ঠান দেখতেও পারবে।

 

শ্রোতা হিসেবে বাংলাদেশ বেতারের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার নানা রকম সুযোগ রয়েছে। যেমন -

* বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রয়েছে কুইজ প্রতিযোগিতা, পত্রলিখন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি; যেখানে অংশগ্রহণ করে যে কেউ জিতে নিতে পারে আকর্ষণীয় পুরস্কার। 

* বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপন বাংলাদেশ বেতারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রতিবছর ১৩ই ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ বেতারও বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপন করে থাকে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত শ্রোতাদেরকে সঙ্গে নিয়ে দিনব্যাপী জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান পালিত হয়। এখানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে শ্রোতা হিসেবে সকলেরই। 

* রয়েছে বেতারের শ্রোতা ক্লাব কার্যক্রম। কিশোর কিশোরী শ্রোতা ক্লাব আর সাধারণ শ্রোতা ক্লাব। এর মাধ্যমে নিজ এলাকায় বেতার শ্রোতা বৃদ্ধি, বেতার অনুষ্ঠানে লেখা, বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি কাজগুলো করা হয়ে থাকে। কিশোর কিশোরীরা বেতার অনুষ্ঠান শোনা এবং বেতার শ্রোতা ক্লাবের সদস্য হওয়া কিংবা নিজেরাই বেতার শ্রোতা ক্লাব তৈরি করার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সচেতনতামূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। যা তাদেরকে মানসিক বিকৃতি, সহিংসতা, অশ্লীলতা ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।

* বাংলাদেশ বেতার এখন সমস্ত কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করলেও হাতে লেখা চিঠির গুরুত্ব দিতে ভুল করে না। বাংলাদেশ বেতারের শ্রোতারা এখনো ডাক বিভাগের মাধ্যমে হলুদ পোস্ট কার্ড কিংবা হলুদ খামে লিখছে হাজারো চিঠি। আগারগাঁওস্থ জাতীয় বেতার ভবনে এখনো চিঠির পাহাড়ের দেখা মেলে, যা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই রূপকথার মতো। বেতার অনুষ্ঠান শোনার মাধ্যমে চিঠি লেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

মূলত চিঠি লেখার মধ্যে একটি আবেগ কাজ করে, যে আবেগ হয়তো অন্য কোনো মাধ্যম থেকে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ বেতারে লেখালেখির মাধ্যমে চিঠি লেখার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে চালু থাকছে, সেই সাথে শিশু-কিশোরদের সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী করতেও এই চিঠি লেখা কার্যক্রম ভূমিকা পালন করছে।

* এছাড়াও খুব সহজেই বাংলাদেশ বেতারে নিজেকে শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা যায়।

 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে বেতার শোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। এর ফলে শিশু কিশোররা সুস্থ বিনোদন পাবে, পাশাপাশি পাবে শিক্ষা ও তথ্য। কেননা বাংলাদেশ বেতার তাদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিকভাবে জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বেতার অনুষ্ঠান শোনার মাধ্যমে নিজেকে যেমন শিক্ষা ও তথ্যে ভরপুর করা যায়, নিজেকে আপডেটেড রাখা যায়; তেমনি সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে নিজের মন ও মননকেও সুন্দর রাখা যায়। 

বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেটের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। ২০২৪ এ এসে এটি বাস্তবে করে দেখানো সম্ভব কনা জানিনা, তবে মোবাইলে আসক্ত না হয়ে এর পাশাপাশি যদি বাংলাদেশ বেতার শোনার অভ্যাস গড়ে তোলা যায় তাহলে শিশু কিশোররা তাদের জীবন আরো সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে করা যেতেই পারে।

 

বাংলাদেশ বেতার সম্পর্কে আরো জানতে ফেসবুক গ্রুপ Central Listeners Club of Bangladesh Betar এ যুক্ত হওয়া যেতে পারে।