মনে করুন আপনার কাছে একটি পৃথিবীর সমান পাজল রয়েছে আর পৃথিবীর এক একটা অংশ হলো পাজলের কার্ডগুলো, যেগুলো জোড়া দিয়ে আপনি পুরো পৃথিবীটা তৈরি করতে পারেন।
কি ভাবছেন?
এমনটা আবার হয় নাকি!
পৃথিবীতো একটাই এর আবার জোড়া লাগানোর অংশ কোথা থেকে এলো?
অবিশ্বাস্য মনে হলেও ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও মিথ্যা নয়। ভূতাত্ত্বিক সময়ের (Geological Time) হাত ধরে এগিয়ে গেলে দেখতে পরবেন আমাদের পৃথিবীটা একটা বিশাল পাজল!
২০ শতকের শুরুর দিকের কথা, নিউটনীয় বা ক্লাসিকাল বিজ্ঞান থেকে মানব সভ্যতা আধুনিক বিজ্ঞানের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
এসময় জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়াগনারের এক তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি লক্ষ্য করেন আটলান্টিক পাড়ের দুই প্রান্তের মহাদেশগুলো (দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ের দঃ আমেরিকা ও দক্ষিণ পূর্ব পাড়ের আফ্রিকা ও ইউরোপ এমনভাবে আটলান্টিক মহাসাগরের মাধ্যমে আলাদা হয়ে আছে যে কোনোভাবে মাঝখান থেকে আটলান্টিককে সরিয়ে দিলে তারা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে যাবে। অনেকটা পাজল কার্ডের পাজলগুলোর মতো।
এটা থেকে ওয়াগনার মহাদেশগুলোর একত্রে থাকার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরলেন, তিনি বললেন, “ভূতাত্ত্বিক কোনো এক সময়ে এই পৃথিবীর সকল ভূভাগই একত্রে ছিলো,তাদের মাঝে আলাদা আলাদা কোনো মহাসাগর ছিলোনা।” তিনি মহাদেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত অতি মহাদেশ প্যানজিয়ার অস্তিত্বের কথা বললেন। এছাড়া তিনি বললেন, “প্যানজিয়া প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়ে প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন বছর আগে পর্যন্ত টিকে ছিলো।”
আচ্ছা প্যানজিয়া ছিলো তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু বিজ্ঞানতো আর শুধু মৌখিক তত্ত্বে বিশ্বাস করেনা। প্যানজিয়ার স্বপক্ষে প্রমান তো চাই!
প্রমান নিয়ে হাজির হলো ভূতত্ত্ব।
আচ্ছা একটি ব্যাপার বলুনতো? পাজল কার্ডের একটি অন্যটির পাশে আপনি কি দেখে মিলান? সহজ উত্তর, পাশাপাশি পাজল কার্ডগুলোর নকশা/ চিত্রের মিল দেখে। অর্থাৎ পাশাপাশি থাকা পাজল কার্ডগুলোর নকশা / ডিজাইনের মিল থাকেই। নকশার সাথে নকশা মিলিয়ে দিলেই সম্পূর্ণ নকশা বা পাজল পাওয়া যায়।
প্যানজিয়ার ক্ষেত্রেও ফসিলবিদ্যা এমনই প্রমান দেয়। ফসিল হলো ভূঅভ্যন্তরে শিলাস্তরে সংরক্ষিত পুরাতন প্রানি বা উদ্ভিদদেহ। আজকের দিনের মহাদেশগুলোকে ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় দক্ষিণ আমেরিকা,ভারত, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে একই রকমের ফসিল পাওয়া যায়।
ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় দক্ষিণ আমেরিকা,ভারতে এবং এন্টার্কটিকায় লিস্ট্রোসোরাস (Lystrosaurus) নামক স্তন্যপায়ী সদৃশ্য সরীসৃপের ফসিল পাওয়া যায়। এর দৈহিক গঠন অনেকটা গিরগিটির মতো। কিন্তু মানচিত্রে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই এই মহাদেশগুলো পরস্পর থেকে শুধু কয়েক হাজার মাইল দুরেই অবস্থিত নয়, মহাদেশগুলো বিশালাকার মহসাগর দ্বারা আলাদা হয়ে আছে। লিস্ট্রোসোরাসের দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য এই প্রমান দেয় যে এত বিশাল দূরত্ব ও মহাসাগরীয় পথ পাড়ি দিয়ে এত বিশাল এলাকাজুড়ে এটি বিস্তৃত হতে সক্ষম নয়। আর যেহেতু লিস্ট্রোসোরাস এত বিশাল ছড়ানো এলাকায় যেতে সক্ষম নয় তাই বলাই যায় যে এই অঞ্চলগুলোই হয়তো কোনো একসময় এত দুরে দুরে ছিলোনা, তারা হয়তো পরস্পরের কাছাকাছি অথাবা অবিচ্ছেদ্য আকারে ছিলো।
সব কিছু একটি বিষয়কেই সুপ্রতিষ্ঠিত করে তা হলো এই অঞ্চলগুলো কোনো একসময় পাশাপাশি ছিলো বা অবিচ্ছিন্ন আকারেই ছিলো।
একই ভাবে উত্তর আমেরিকা, গ্রিনল্যান্ড এবং পশ্চিম ইউরোপের ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষনে একই ফসিল ও ভূতাত্ত্বিক গঠন পাওয়া যায় যা একসময় এই অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি থাকা বা অবিচ্ছেদ্যতার প্রমান দেয়।
আটলান্টিকের পশ্চিম পাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালেচিয়ান পর্বতমালা ও পূর্বপাড়ে মরক্কোর আটলাস পর্বতমালার শিলা ও ভূতাত্ত্বিক গঠন প্রায় একই রকম, যা প্রমান দেয় পর্বতমালা দুটি কোনো এক সময় অভিন্ন বা পাশাপাশি ছিলো।
সকল ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ফসিল কেবল একটি তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করে আর তা হলো সুপার কন্টিনেন্ট বা অতিমহাদেশ প্যানজিয়ার অস্তিত্ব।
প্যানজিয়ার ভাঙন:
প্যানজিয়া ছিলো সে না হয় বুঝলাম কিন্তু ভাঙলো কিভাবে বা আজকের মহাদেশীয় বিন্যাসই বা কিভাবে হলো?
এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আগে পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা টেকটোনিক প্লেট সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। পৃথিবীর অন্তভাগ কতকগুলো পাশাপাশি অবস্থিত প্লেট (পাত) দিয়ে গঠিত যার উপর মহাদেশ বা মহাসাগর দাঁড়িয়ে আছে। পৃথির অভ্যন্তরের উচ্চ চাপ, তাপ ও ভূতাত্ত্বিক নানা কারণে প্লেটগুলো আন্দোলিত হয়, অর্থাৎ এর একে অন্যের থেকে দুরে সরে যায় বা নিকটে আসে।
জুরাসিক যুগের শুরুতে (প্রায় ২০ কোটি বছর আগে) প্যানজিয়াও এই টেকটোনিক প্লেটের মুভমেন্টের মাধ্যমে ভাঙতে শুরু করে। প্রথমে এটি দুটি সুপারকন্টিনেন্ট- গন্ডোয়ানা ও লরেশিয়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ এবং এশিয়ার একাংশ ছিলো লরেশিয়ার অংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া একত্রে গঠন করে গন্ডোয়ানা।
এখানে বলা বাহুল্য ভারতীয় প্লেট ও অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের অবস্থান ছিলো দক্ষিণ আমেরিকার কাছাকাছি।টেকটোনিক মুভমেন্টের ফলে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট ধীরে ধীরে দুরে সরে যায় এবং কয়েক হাজার মাইল পড়ি দিয়ে ইন্দচীন প্লেটের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।ধারণা করা হয় তখনই হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে আপনি একটি কাগজের পৃষ্ঠাকে দুদিক থেকে চাপ দিলে দেখবেন এটি মাঝ বরাবর উঁচু হয়ে ওঠে।
ভারতীয় প্লেটের সাথে ইন্দোচীন প্লেটের সংঘর্ষে ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটে উচ্চ চাপে এর বাউন্ডারিতে ভূপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে ওঠে এবং জন্ম দেয় হিমালয় পর্বতমালার।মজার ব্যাপার হলো যেহেতু ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইন্দচীন প্লেটের মুভমেন্ট এখনো চলমান রয়েছে,তার প্রভাব পড়ছে হিমালয় পর্বতমালার উপরও,প্রতিবছরই এর উচ্চতা বাড়ছে ৪ মিলিমিটার করে।
এরপর সময়ের বিবর্তনে টেকটোনিক প্লেটগুলো যতই দুরে সরেছে মহাদেশগুলো ততটাই বিন্যস্ত ও বিস্তৃত হয়েছে। প্লেটগুলোর মুভমেন্ট এখনো চলমান রয়েছে ফলে ক্রমাগত একটি অঞ্চলের পরিধি বাড়ছে তো অন্যটার কমছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমান আটলান্টিক মহাসাগরের আয়তন বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরের আয়তন সংকোচন। এটা এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায় প্লেট মুভমেন্ট আগামিতে পৃথিবীর বিন্যাসকে আরও পরিবর্তিত করে দিবেই।
কি জানি সেই বিন্যাস আবার কোনো নতুন প্যানজিয়ার জন্ম দেয় কিনা!