প্রতিদিনের মতো আজও গায়ে কলেজের ফরমাল ড্রেস শাদা শার্ট গায়ে জড়িয়ে, প্যান্ট পরে আর একজোড়া চামড়ার স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ৯টার বাংলা ক্লাস ধরবো বলে। বাসা থেকে নেমে ব্রিক ফিল্ড রোডের হতে কোতোয়ালি মোড়ে চলে যাওয়া পথটা নাক বরাবর রেখে হাটতে থাকলাম। কলেজে যাবার এই সময়টা আমার খুব উপভোগ্য মুহূর্ত গুলোর একটা। রাস্তার ঝগড়াপ্রিয় কুকুরছানা গুলোর স্বাধীন ঘুরাফেরা, ফুটপাথ ধরে এগোনো স্কুল ছাত্রদের খুনসুটি, মুদির দোকানে খদ্দেরের ভিড়, আর চায়ের দোকানে টুংটাং শব্দ সব মিলিয়ে পুরোপুরি আলাদা একটা স্বাদের মিশ্রণ। তাছাড়া শহুরে গলির বাতাসে ভাসতে থাকা আঁশটে গন্ধটাও সয়ে যেতে যেতে একসময় মেলানকলিক পারফিউমের মতো মনে হয়। যাক এতটুকে হয়তো বুঝতে পারছেন কলেজে হেটে যাওয়া-আসা করাতে কী আনন্দ পাওয়া যায় তা ভাগাভাগি করে নেবার লোভ সংবরণ করা এই অপরিপক্ক কথকের পক্ষে ঠিক কতটা সম্ভব??
এবার সামনে এগোনো যাক। তাড়াতাড়ি পা না চালালে হয়তো ক্লাস ধরা যাবেনা। আপনারাও তাড়াতাড়ি পা চালান।
হাটতে হাটতে রাস্তার মাঝবরাবর পরে থাকা একটা ফিতা ছিড়ে যাওয়া স্যান্ডেল দেখে হটাৎ মনে পড়লো গত পরশু দিন স্যান্ডেল নিয়ে আমার দুর্ভোগ পোহানোর বিভৎস ঘটনা। একবার রোমন্থন করা যাক। দিনটি ছিলো এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় রবিবার, সেদিন বিকেল পাচটায় ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে যাবার জন্যে বড়দাদার গিফ্ট দেয়া একজোড়া চামড়ার স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বেরিয়ে পরি। বছড়খানেক পুরোনো তারা। নবীন হলে কী হবে। তাদের প্রভু ঝড়,বৃষ্টি রোদে ইচ্ছেমতো খাটুনি করিয়ে নিলেও যত্ন নেবার বিষয়ে ছিলেন নিতান্তই উদাসীন। ফলাফল নবীন বয়সে এসেই হাড়গোড় ছিড়ে যাবার উপক্রম। এর মধ্যে বলে রাখা ভালো যে মধ্যবিত্ত পরিবার এক বছর পার হয়ে যাওয়া জুতো বা স্যান্ডেল নবীনের ট্যাগ পায়। যদিও উচ্চবিত্তদের মধ্যে এসব নেমট্যাগের বালাই নেই। যাইহোক স্যান্ডেল জোড়া দাদার উপহার হিসাবে সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি পছন্দের ছিলো এবং পায়ে দিলে একটা আভিজাত্যের আস্বাদ পেতাম। তবে যত্নআত্তির ডিপার্টমেন্টে এসে পছন্দ শব্দটা পরিবর্তিত হয়ে অবহেলার রুপ নিয়েছে। বিপরীতে স্যান্ডেল জোড়া কিন্তু কেয়ারফান্ডিং নিয়ে একটুও ভাবেনি। সর্বাত্মক চেষ্টা করে একাগ্রচিত্তে সেবা দিয়ে গিয়েছে। এবার আসি কোচিংয়ে যাবার পর্বে। কোচিংয়ের পড়তে যাবার জন্য স্যন্ডেল জোড়া পায়ে দিয়ে এগুতে এগুতে লক্ষ্য করলাম ডান পায়ের স্যান্ডেলটার আকড়ে ধরার ফিতে ছিড়ে যাই যাই করেও যাচ্ছেনা অর্থাৎ তার মানে দাড়াল এই নিজে ছিড়ে যাবে তবুও প্রভুর পা ছাড়া যাবেনা। আমিও মনে মনে খুশি। বাহবা দিতে লাগলাম তাকে। সাহসও কিছু জোগাড় হলো এই ভেবে যে বাসায় ডাস্টবিনে ফেলার আগে জুতা কেনার রিসিপ্টে ৮৭০ টাকা দাম দেখেছিলাম, ব্রান্ডের জুতা তার উপর আবার দামী। যাইহোক কোতোয়ালি মোড়টাতে এসে বাসে উঠলাম, ঠিকঠাক ভাবে পথ অতিক্রম করে নামলাম দিদার মার্কেট। যদিও সাধারনত নামি একটু আগে করে। তবে আমার পা আকড়ে থাকা বীরপুরুষের কথা ভেবে ওই ময়লা ওয়ালা মুদির দোকান পিছনে ফেলে একদম বাসস্টপেই নামলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিলো। যেইনা রাস্তা পার হতে যাবো অমনি সাহস একাগ্রতা শক্তি সব মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে কোন কালের আগন্তুক রাজা হয়ে মিথ্যে সাহসের দিনমজুর বনে গিয়ে ছিড়ে গেল উপুর হয়ে। আর ভাড়াটে বাসায় স্যারের কোচিংয়ে যুদ্ধে বিধস্ত পরাজিত সেনার ভূমিকায় স্যান্ডেল টেনে হিচড়ে সিড়ির ধাপ গুলো পার করতে গিয়ে ভয়টাকে মনে হলো এক জাগ্রত ভিসুভিয়াস আমার সামনে পড়ে আছে অতুলনীয় ক্ষমতার প্রদর্শন করবে বলে। যাইহোক অকল্পনীয় চাতুরী দেখিয়ে ভিসুভিয়াস ঠেকানো গেল। রুমে ঢোকার আগে স্যান্ডেলে অস্থায়ী জোড়াতালি দেয়া হলো সন্তর্পণে। আজে বাজে কথা ছাড়া যতটুক পড়াশোনা হয় ততটুকু নিয়েই বেড়িয়ে এলাম। সিড়ি বেয়ে নামার পথে রাতুল আমার পাশেই ছিলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম জুতো সেলাইয়ের মুচির কথা। সে বললো তার চেনা একটা মুচি আছে আন্দরকিল্লার মোড়ে। সিন্ধান্ত নিলাম সেখানে গিয়েই বীরপুরুষী চিকিৎসা হবে। তিনতলা থেকে এবার নামার পালা। নামলাম স্যান্ডেল হাতে করে। অনেক কষ্টেসৃষ্টে স্যান্ডেল নিয়ে পৌছালুম রিফিউজি ক্যাম্পে। সেখানে স্যান্ডেল জোড়া দেখলেন মুহিত চাচা। চাচার নাম জেনেছিলাম রাতুলের সূত্রেই। ক্যাম্পে ফিল্ড ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট সন্তোষজনক। চাচার পেশাদারী হাতের দক্ষতায় ডান পায়ের স্যান্ডেলটা আবার সুস্থ হয়ে উঠল। দেশে শান্তি ফিরে এলো। রিফিউজি এখন কর্মক্ষম নাগরিক হয়ে ফেরত এলো আপন মাটিতে। খুব খুশি হলাম এইরুপ আন্তর্জাতিক চুক্তির সুব্যবস্থা দেখে। ঋন পরিশোধ বাবদ রাজস্ব ব্যয় , দশটাকা।
জুতো নিয়ে এবার স্বসম্মানে বাসায় ফিরে এলাম।
ছোটখাট এডজাস্টমেন্ট গুলো ব্রান্ড নিউ বার্থডে প্রেজেন্ট হিসেবেই নেওয়া শেখাটা জরুরি ।