পোস্টস

গল্প

মুরগীর ঝোল

১২ জুন ২০২৪

আনন্দ লাল চৌধুরী

নব্বই এর দশক। তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি। কুমিল্লা শহরে সোনারু পট্টিতে আমাদের বাসা। বাসার সামনে আমার বাবার ক্ষয়িষ্ণু অ্যালুমিনিয়ামের দোকান। দিনের অধিকাংশ সময় যেটা বন্ধই থাকে। আমার বাবা প্রায়ই দোকানের দরজা লাগিয়ে ভেতরে তার বন্ধুদের সাথে দাবা খেলতেন। দারুন খেলতেন বাবা। আমি কখনো হারতে দেখিনি তাকে। সেই দোকানের পেছনেই আমাদের বাসা। বাসা মানে একটা স্যাঁতস্যাঁতে একচালা টিনের ঘর। যার কোন জানালা নেই। গরমকালে সেই টিনের চালে দেবদারু গাছের পাতা বিছিয়ে গরম কমাতে হতো। আবার বৃষ্টি এলে ঘর ভর্তি এক হাঁটু পানি। পাশের ড্রেনের কীটগুলোও পানির সাথে উঠে আসতো আমাদের ঘরে। কত রাতে ঘুম থেকে উঠে যে সবাই মিলে ঘরের জল সেচেছি। আমার কাছে অবশ্য দারুন লাগতো ব্যাপারটা। ভীষণ রোমাঞ্চকর। এর মধ্যে যে মন খারাপ করা কোন ব্যাপার আছে ছোটবেলায় তা বুঝতেই পারিনি।

প্রতি শুক্রবার বাবার সাথে বাজারে যেতাম। বাজারে যেতে আমার আগ্রহ একটু বেশিই থাকতো। কারন বাসা থেকে বের হয়েই সামনের হোটেলে নাস্তা করতাম আমি আর বাবা। হোটেলের নাম 'সাভার'; পরোটা আর ভাজি। আমি খেতাম ডাল। ওহ সে কি অনবদ্য স্বাদ ছিলো সেই নাস্তার। অমৃত!

এরপর ঢুকে যেতাম বাজারে। যেসব আলু নষ্ট হয়ে যায় সেই সব আলু কেটে বাজারের শেষ কোনায় বিক্রি হতো। বাবা প্রায় সময়ই এই কাটা আলু কিনতেন। এরপর যেতাম মাছের বাজার। টেংরা মাছের ভাগ তখন দারুন সস্তা। বেগুন আলু দিয়ে টেংরা মাছ এত খেয়েছি যে মনে হতো সারা জীবনে এই মাছ আর না খেলেও চলবে। তবে মার রান্না ছিলো দারুন। আলু পটলের ডালনা, উচ্ছে দিয়ে মুগডাল, সর্ষে দিয়ে ঢ্যাঁড়শের চচ্চড়ি, অতি সাধারণ সব খাবারও মায়ের হাতের স্পর্শে হয়ে উঠতো অসাধারণ। মাঝে মধ্যে কিন্তু মাটনও আসতো বাসায়। পাশের গলিতে এক কাকার মাটনের দোকান ছিলো। প্রতিদিন ভোরে বসতেন। যেদিন তার মাংস বেঁচে যেতো আমাদের বাসায় হাফ কেজি মতন মাংস নিয়ে আসতেন। মা রাখতে চাইতেন না। তিনি বলতেন,

- দাদা পরে টাকা দিবোনে, রাখেন দিদি রাখেন।

আমি এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞাসা করতাম -কলিজা দিছেন? উনি হেসে বলতেন,

- দিছি বাবা দিছি।

মাংস খেতে আমার দারুন লাগতো। মাটন রান্না হলেই ভাবতাম পরের দিন সকালে পরোটা দিয়ে একটু মাংস খেতে হবে, কিন্তু সেই সকাল আর কখনোই আসতো না, কারন মাংস ফুরোতো রাতেই। তখন তো আর আমাদের ফ্রিজ ছিলো না। মার একটা মিটসেফ ছিলো। আমার ভয়ে মা সব সময় সেখানে তালা দিয়ে রাখতেন। সেই মিটসেফের জলসরায় মা তার রান্না করা তরকারী তুলে রাখতেন। সেই মেটসেফের ভেতরে কেমন জানি একটা গন্ধ ছিলো। মিটসেফের দরজা খুললেই তা এসে নাকে লাগতো, কেমন জানি নেশা লাগতো সেই গন্ধ নাকে এলে। মিটসেফের পাশের টেবিলে একটা হিটারে মা রান্না করতেন। তার পাশে মার মুষ্ঠি চাল জমানোর ড্রাম।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখনো ব্রয়লার মুরগী বাংলাদেশে আসেনি। এখনকার মত, দেশি মুরগী তখনো অনেকটাই দূর্লভ ছিলো । তাই কোন অতিথি বাড়ি না এলে মুরগী রান্না সাধারনত হতোই না। মুরগী যেদিন রান্না হত, রাতে মা খাবার দিলে মুরগীর কলিজাটা জমিয়ে রাখতাম পরে খাবো বলে। কত রাতে যে মুরগীর কলিজা মুখে নিয়ে ঘুমিয়ে গেছি তার ইয়ত্তা নেই।

মা রান্না করে সবসময় বাটিতে প্লেটে করে সবার জন্যে খাবার বেড়ে রাখতেন। একবার আমাদের বাসায় রাতে মুরগী রান্না হলো। মা বাটিতে করে মুরগী বেড়ে দিয়েছেন। এতই সুন্দর লাগছিলো বেড়ে দেওয়া বাটিটা মনে হচ্ছিলো ঐশ্বরিক। মাকে বললাম,

-মা এটা কালকে সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে খাবো, তুমি এটা রেখে দাও মিটসেফে।

শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে উঠে গেলাম। রাতে এই রান্না মুরগীর বেড়ে দেয়া বাটি মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

স্কুলে আমি পড়তাম ডে শিফট এ। ১২টায় স্কুল শুরু হতো ৫ টায় শেষ। স্কুলে যাওয়ার আগে গরম ভাত খেয়ে বের হতাম। বিকেলে এসে আবার ভাত খেতাম। সকালে ভাত খাওয়ার সময় আইডিয়াটা এলো, মুরগীটা এখন না খেয়ে না হয় স্কুল থেকে এসেই খাই। যেই ভাবা সেই কাজ। মাকে আমার বাটি বুঝিয়ে দিয়ে ডাল দিয়ে ভাত দিয়ে খেয়ে উঠে পড়ি। তারপর সোজা স্কুলে।

সেই সময় বিকেল তিনটা বাজার পর পরই পেটে ছুঁচো ডন মারতে শুরু করতো। ক্ষুধায় আর স্যারদের কথার কিছুই মাথায় ঢুকত না। তার ওপর আমি আবার রান্না মুরগী রেখে এসেছি বাসায়। বাটিতে উঁচু হয়ে থাকা মুরগীর রান তখন মাথায় ঘুরছে। স্কুল শেষ হওয়ার পর বাসায় আসি অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি। মাথায় তখন মুরগির বাটি ছাড়া আর কিছুই নেই।

এসেই নিয়ম ছিলো আগে স্নান করতে হবে তারপর ভাত। আমি কলতলায় যাওয়ার আগেই মাকে ভাত বাড়ার কথা বলে যাই। এসে দেখি মা আমাকে একটা ডিম পোচ করে দিয়েছে ঠান্ডা ভাতের ওপর। দেখে তো আমার খুশীতে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। এতো বোনাস।খাওয়া শুরু করেই মাকে বললাম,

- মা মুরগীর বাটিটা দাও।

আমার মা একটু শক্ত ধাঁচের মহিলা। ছোটবেলায় বেধড়ক পিটিয়েছেন আমাকে। আমার সাথে কখনোই আদর করে কথা বলতেন না মা। হয়তো বেশি আদর দিলে ছেলে বিগড়ে যাবে সেই ভয়ে। আমার সেই মা আমাকে তখন ‘মনা’ বলে সম্বোধন করলেন এরপর যেটা বললেন তার মোদ্দাকথাটা হল, দুপুরে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এক দাদু এসেছিলো। আমার সেই মুরগীর বাটিটা ছাড়া তাঁকে আপ্যায়িত করার মতো মার কাছে আর কিছু ছিলো না।

আমার মাকে এতটা অপরাধী মুখে আমি আর কোনদিন দেখিনি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন, -ডিম ভাজি দিয়ে খাইয়া ফ্যাল। পরে আরেকদিন রান্না কইরা দিবোনে।

মায়ের একটু খানি স্নেহ দিয়ে সেই ছোটবেলার দুঃখ আমি ভুলেছিলাম ঠিকই, তবে গল্পটা ভুলতে পারিনি। গল্পদের কেন জানি ভোলা যায় না!