'আনিস, একটু কষ্ট করে স্কুলে গিয়ে আমার দরখাস্তটা দিয়ে আসতে পারবি?'
আব্বার এমন অনুরোধসূচক কথা আমি কখনোই শুনি নাই।
এটা কি আমার আব্বা নাকি অন্য কেউ!
আজকে ভোর রাত থেকে আব্বার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ। শরীরে এত বেশি জ্বর যা বলার মত না। গতকাল স্কুল থেকে ফেরার সময় বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন। এমনিতে গ্রীষ্ম আর বর্ষায় আব্বার সাথে সবসময় ছাতা থাকে। কিন্তু শীতকালে কোন প্রয়োজনেই বা আর ছাতা নিয়ে স্কুলে যাবেন?
আব্বার মাথায় আবার একটু বৃষ্টির পানি পড়লেই শরীর খারাপ হয়ে যায়।আমার দাদাজান নাকি বলতেন, "জমিদারের পোলা তো তাই এই অবস্থা।" মাঘ মাসে এমনভাবে বৃষ্টি নামবে তা কে-ই বা আর ভাবতে পারে! তাই আব্বাও ছাতা নেন নি। বৃষ্টির পানি একটু পড়াতেই শরীর খারাপ হয়ে গেছে।
শেষরাতে আম্মা যখন ঘর থেকে বের হয়ে পানি আনতে যান সেই শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন অবশ্য এত কিছু ভাবি নি। ভাবলাম হয়তো এমনিতে টয়লেটে যাচ্ছেন।
সকালে আম্মার ডাকাডাকিতেই ঘুম ভাংলো।
'আনিস, তোর আব্বা ডাকছে তোকে।'
আব্বা-আম্মার রুমে আমরা ভাই-বোনেরা কেউ সাধারণত যাই না।আব্বা নিজের রুমে কখনো আমাদের ডাকেন না। আব্বা এই জিনিসটা একদমই পছন্দ করেন না। আমাদের কিছু বলতে হলে আম্মাকে বলে দেন এরপর আম্মা আমাদের বলে দেন। আর খাবারের টেবিলে আব্বা থাকলে আমরা তিন ভাই - বোনের কেউ যাই না।আব্বা একাই খান। আব্বার খাওয়া শেষ হলে আমরা খেতে যাই।
আম্মা অবশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করেন। আম্মা সহ আমরা তিন ভাই-বোন পরে একসাথে খেতে বসি। যদিও খাবারের টেবিলে আমাদের কথাবার্তা শুনে আব্বা প্রায়শই জোরের উপর একটা কাশি দেন ।আমরা বুঝেই যাই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আম্মা আমাদের এরপর কথা বলতে নিষেধ করেন।
আব্বা স্কুলে গেলে আবার আমরা উনাদের রুমে আড্ডা বসিয়ে দেই। আম্মার অবশ্য এতে কোন আপত্তি থাকে না।আম্মা আমাদের বলেন, মাস্টার সাহেবকে ঘরেও মাস্টারি করতে হয় তো তাই একদম কথা বলা যাবে না!
আম্মা যখন বললেন আব্বা রুমে ডাকছে তখন ভেবেছিলাম আমার কপালে আজকে শনি আছে। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি বাসায়। কয়দিন পর ঢাকায় যাব কোচিং করতে।
আব্বা আম্মাকে বলে দিয়েছেন , "তোমার ছেলেকে মেডিকেল কোচিংই করতে হবে।"
সে ছোটবেলা থেকেই আব্বার ইচ্ছা আমাকে ডাক্তার বানাবেন। এর পেছনে অবশ্য একটা গল্প আছে। আমার দাদাজান মারা যান প্রায় বিনা চিকিৎসায়।আব্বা সামান্য স্কুল মাস্টার। কত টাকা আর বেতন পান। তারপরও সেই টাকা দিয়ে চেয়েছিলেন দাদাজানের চিকিৎসা করাতে। বাড়ির উত্তর দিকের ধানি জমিটা বিক্রি করার জন্য ঘুরেছিলেন অনেকদিন। কিন্তু কেন জানি এই জমি কেউ কিনতে চায় না। অবশ্য দাদাজান কখনো চান নি জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে। খুব সম্ভবত দাদাজান চান নি বলে সে জমিটা আর বিক্রি হয় নি। দাদাজানও চিকিৎসার অভাবে মারা যান।
আমাদের দু'বেলা যে ভাত জোটে তা আসে ঐ উত্তর দিকের জমি থেকেই। সারাদিন স্কুলে ক্লাস করিয়ে বিকাল বেলা আব্বা জমিতে সময় দেন। একা একা যা পারেন তা করেন। আমাদের পাঁচ জনের সংসার বাবাকেই টানতে হয়। কথায় আছে, মিস্ত্রি নাকি ফুঁটা টিনের ঘরে থাকেন। আর আমাদের দেশ ও জাতি গড়ার কারিগররা ১২ মাসই নানান টানাপোড়নে থাকেন। আব্বার অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই।নিজে যা ইনকাম করেন তা দিয়ে আমাদের চলে যায়। নিজের ঘর আছে আর তিনবেলা খাবার আছে।বেঁচে থাকার জন্য আর কি লাগে!
আব্বার একটাই চাওয়া আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো। যাতে চিকিৎসার অভাবে কেউ মারা না যান।
ওইদিকে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে বসে আছি। আমাকে কোনভাবেই মেডিকেল টানে না। ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয় বিষয় গণিত। আমার ধারণা আব্বা কোনভাবে এটি জেনে গেছেন।তাই আজ আমার কপালে শনি আছে।
রুমে ঢুকতেই দরখাস্তের কথা বলে আব্বা বললেন, "হেড স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। স্যার যেতে নিষেধ করলেন আর দরখাস্তটা তোকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন।"
আমি আব্বাকে বললাম, আমি এখনি যাচ্ছি, আব্বা।
আব্বার শরীরটা বেশ খারাপ বুঝা যাচ্ছে।রুম থেকে বের হয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম , কি হয়েছে আম্মা?
আম্মা তেমন কিছু না বলে বললেন তাড়াতাড়ি স্কুলে গিয়ে দরখাস্তটা দিয়ে আয়।আব্বার দরখাস্তটা নিয়ে স্কুলে চলে গেলাম আমি। এই স্কুলটা শুধু আব্বার স্কুল এমন না। আমার স্কুল জীবনও ই স্কুলেই কেটেছে। এখানকার নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা। এই স্কুলের দারোয়ান রহিম ভাই সহ হেডস্যার সবাই আমাকে চিনেন।
হেডস্যারের রুমে ঢুকতেই স্যারের প্রশ্ন,
'কেমন আছিস, আনিস?'
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি , স্যার। আপনি কেমন আছেন?’
'আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি রে। তুই তো সেই যে স্কুল থেকে গেলি আর তো আসলি না।'
'স্যার, এমনি আসা হয় না।'
'তা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন চলছে?'
'স্যার, আপাতত বাসায় পড়ছি। কয়দিন পর ঢাকায় যাচ্ছি।'
'কি কোচিং করছিস?তোর আব্বা নাকি তোকে মেডিকেলে পড়াতে চান।'
' জ্বী, স্যার।'
'তুই তো ম্যাথে ভালো। আমার মনে হয় তুই ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভালো করবি।'
‘কিন্তু, আব্বা চান আমি মেডিকেলে পড়বো । সেইভাবেই প্রিপারেশন নিতে বলেছেন।’
'তাহলে বাপের কথা শোন। এক কাজ কর তো, তোর বাবার ক্লাসটা ফাঁকা যাচ্ছে। তুই ক্লাস নাইনের ম্যাথ ক্লাস টা নিতে পারবি? কোন কাজ নাই তো বাসায়?
' না, স্যার। কোন কাজ নাই। কিন্তু আমি তো কখনো ক্লাস নেই নি ।'
'আরে পারবি, ব্যাটা। চক, ডাস্টার আর হাজিরা খাতা নিয়ে যা। আচ্ছা চল, আমি তোকে দিয়ে আসি। আমাদের নতুন শিক্ষক, মিঃ আনিস !'
আমি বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, আরে চল। তুই আমাদের সেরা ছাত্র।তুই পারবি।'
সেদিন ক্লাস নাইন, এইট আর সিক্সের মোট তিনটা ক্লাস নিই আমি। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বেশ।আবার সাথে দেখা হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এত দেরি করলি কেন?
আমি বললাম, আব্বা, হেডস্যার একটা কাজ দিয়েছিলেন।
আব্বা "ও আচ্ছা" বলে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
শরীর একটু ভালোর দিকে গেলে আব্বা পরদিন স্কুলে যান। স্কুল থেকে ফিরে এসে আমার রুমে আসলেন। আমি আব্বাকে আমার রুমে দেখে থতমত হয়ে রইলাম। আব্বা তো কখনোই আমার রুমে আসেন না! তাহলে কি আব্বা জেনে গেছেন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং এ ভর্তি হয়েছি?
আব্বা রুমে ঢুকেই আমার কাঁধে একটা হাত রাখলেন। এই পৃথিবীতে সন্তানের কাঁধে বাবার হাত রাখার মত সুন্দর ও শক্তিশালী দৃশ্য খুবই কম পাওয়া যাবে।
আব্বা বললেন, তুই ম্যাথে ভালো এটা আমি জানি। কিন্তু আমার থেকেও ভালো সেটা জানতাম না। কাল তুই যে তিনটা ক্লাসে আমার ক্লাস নিয়েছিলি সবাই আজকে তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। 'স্যার, আনিস ভাইয়া কোথায়?' ।আমি তো প্রথমে বুঝিনি কি হয়েছে। পরে হেডস্যার আমাকে বললেন, কালকে তুই ওদের ক্লাস নিয়েছিলি।আমার তো পরে মনে হয়েছে আমাকে দেখে ওরা বেশ বিরক্ত হয়েছে। তুই গেলেই ভালো হতো। সবাই তোর কথা এতবার জিজ্ঞেস করেছে! আমার বেশ গর্ব হচ্ছিলো রে, আনিস। হেডস্যার আরো বললেন , তোর নাকি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা? তোর যা ভালো মনে হয় তুই তাই পড়বি। আর আমি জানি তুই অনেক ভালো কিছু করতে পারবি।
আমি চেয়ার থেকে উঠেই আব্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। আব্বার চোখে পানি। সন্তানকে নিয়ে গর্ব করার সময় বাবা-মা দের চোখে এই পানিটা অটোমেটিক চলে আসে। আব্বাকে জড়িয়ে ধরার সময় আমিও হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম।
বাবাদের জড়িয়ে ধরে সন্তানদের এমন হাউমাউ করার সুযোগ সবার জীবনে আসে না।