পোস্টস

উপন্যাস

জীবন যেখানে অন্যরকম

১২ জুন ২০২৪

মাসুম শরীফ

পর্ব-১

আমি গড়তে পছন্দ করি | আমি একজন টাওয়ার প্রকৌশলী| সিভিল ইঞ্জিনিয়ার না বলে কেন টাওয়ার প্রকৌশলী বললাম? কারণ আমি এখন আর বিল্ডিং বানাই না, মজাও পাই না| তাই আমার নতুন পরিচয় টাওয়ার প্রকৌশলী! বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে ঘুরে বেড়াই সারা বাংলাদেশ! দিনগুলো যে কিভাবে কেটে যাচ্ছে টের পাই না! কখনো নদীতে, কখনো হাওরে, কখনো পাহাড়ি অঞ্চলে, কখনোবা মহাসড়কে|

 

 ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর টানা দুই বছর এদিক ওদিক চাকরি করে বেতনের বেহাল অবস্থা এবং কাজের অস্বস্তিকর পরিবেশ দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাকে মাল্টিন্যাশনাল  মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে | ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল তাই ভাইভা দিয়ে টিকে গেলাম দেশের একটি প্রথম সারির মোবাইল কোম্পানিতে এবং আমার অফিস গুলশান-২ নম্বরে| আমাকে আর পায় কে? সুযোগ সুবিধা? আমার স্বর্গের মতন মনে হতো-একটি মোবাইল এবং সিম, মাসে ৩৫০০ টাকা মোবাইল বিল ফ্রি, ডেল এর একটি ল্যাপটপ এবং সাইট এ যাওয়ার একটি অত্যাধুনিক এসি গাড়ি এবং মাস গেলে মোটা অংকের বেতন! ২৮ বছরের  তরুণ প্রকৌশলীর জন্য এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে, বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করলে? মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি সুখী? কেন জানি কোনো উত্তর পাই না! সুখ আসলে কি? সুখী হওয়ার জন্য একজন তরুনের কি দরকার? 

ভালো চাকরি, একজন সুন্দরী বান্ধবী, পরিবারের মানুষের স্নেহ, কিছু সুন্দর মুহূর্ত? জানি না কেন জানি এই প্রশ্নের উত্তরে আমি খুব বিভ্রান্ত থাকি, তবে মনে হচ্ছিলো দিনগুলো সুখেই কাটছে|

কাজে এতো মজা পাচ্ছিলাম যে, আমি কোনো শুক্র, শনিবার ছুটি নেই না! বিভিন্ন জেলার সেরা হোটেল গুলোতে থাকতে আর মজার মজার খাবার খেতে ভালোই লাগছিলো|আজ সুনামগঞ্জ এর একটি সাইট পাইল ক্যাপ ঢালাই ছিল | পুরো ছয় ঘন্টা সাইট এ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে ঢালাই পর্যবেক্ষণ করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম|পুরো সময় থাকতে হয় নাহলে ঠিকাদাররl কংক্রিটের এর মধ্যে সিমেন্ট, বালি এবং পানি যে অনুপাতে দেওয়ার কথা তা না দিয়ে সিমেন্ট বাঁচানোর জন্য, বালি এবং পানির অনুপাত বাড়িয়ে দেয় এবং 

যারফলে কংক্রিট হয়ে যায় তরল সদৃশ্য পদার্থ এবং যে কম্প্রেসিভ স্ট্রেংথ আসার কথা তা আর আসেনা ফলে কাঠামো দুর্বল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে-এই জিনিস আমার মতো সব সাইট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়াররাই জানে যাই হোক আজকে ভয়াবহ গরম ছিল, তাই হোটেলে  ফিরে এসি অন করে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লাম আর ভাবছিলাম আটাশ বসন্ত পার করে দিলাম কিন্তু আমার দুঃখ কেউ বুঝলো না!

স্মরণ করছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেশ কিছু মেয়েকে ভালো লাগতো, কিন্তু তারা আমাকে পাত্তা দিতো না! একদিন আমার সহপাঠিনী এবং বান্ধবী অদিতি এর  সাথে ক্যাম্পাস এ বসে গল্প করছিলাম:
আমি: " অদিতি, তোমার এতো সৌন্দর্যের রহস্য কি?"
অদিতি: "পৃথিবীর সব মেয়েরাই সুন্দর হয়, তোমার বৌও হবে!"
আমি: "আমার মনে হয় বিয়ে দুটি নারী-পুরুষের মধ্যে পুরোনো গোছের সম্পর্ক”
অদিতি: " তাহলে একটা ছেলে আর মেয়ের কোন ধরনের সম্পর্ক তুমি পছন্দ করো?"
আমি: হেসে বললাম, "কেন, লিভ টুগেদার?"
অদিতি: " কথাটা তুমি যত সহজে বলতে পারলে, অত সহজে করতে পারবে না, সমাজ আছে না!?"
আমি: "হয়তো!", আমার মনে হয় বিয়ে হচ্ছে একটা দায়িত্ব মাত্র, প্রেম ততদিনই মধুর যতদিন বিয়ে ছাড়া থাকা যায়!"
অদিতি: " তোমার এই ধাৰণা একদিন বদলে যাবে"
আমি: "কিভাবে বুঝলে?"
অদিতি: "মেয়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারে যা তোমরা ছেলেরা বোঝো না!"
আমি:" অদিতি, আমি যদি মূর্তি পূজারী হতাম, আমি তোমাকে ভালোবাসার দেবী হিসাবে পুজো দিতাম!" (অদিতি হাইস্কুল থেকে একটি ছেলের সাথে প্রেম করতে করতে তাকে সাথে করে নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল এবং তাদের সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয়!)
অদিতি: "ধুর, এইসব ফাইজলামি রাখো, আর কতদিন এভাবে কাটাবে?"
আমি: "যতদিন কাটে!"

এই ছিল আমার ক্যাম্পাসে মেয়েদের সাথে কথোপকথন! ক্লাসে আমি ছিলাম ব্যাকবেঞ্চার, অসহনীয় লাগতো পানিসম্পদ কৌশল এবং পরিবহন কৌশল এর ক্লাসগুলো| কি যে পড়াতো স্যার আর ম্যাডামরা আমি কিছুই বুঝতাম না! একফাঁকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতাম আর ক্যাফেটেরিয়ার সামনে বসে চা-সিগারেট খেতে খেতে আর্কিটেকচার এর পরীদের দেখতাম! মনে মনে ভাবতাম আহা এদের কেউ যদি আমার গার্ল ফ্রেন্ড হতো! লাজুক ছিলাম বলে কথা বলতে পারতাম না এইসব পরীদের সাথে!

কতই না আনন্দের ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো | আমি অনেক ছোটকাল থেকে স্বপ্ন দেখতাম পলাশীর ওই লাল ক্যাম্পাসের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার|এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতি আসলে শুরু করতে হয় ক্লাস ওয়ান থেকে এবং গণিতে অনেক ভালো হতে হয় কারণ ভর্তি পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন করা হয় তা কোনো বইতে থাকেনা আর তাই গণিতেরভিত্তি 

দুর্বল হলে এই ভর্তিপরীক্ষায় পাশ করা যাবে না! পুরো স্কুল আর কলেজ জীবন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমে হাবডুবু খেতে খেতে পড়াশোনা শেষ করলাম, 

এরপর শুরু হলো ভালো চাকরি পাওয়ার  দৌড় এবং গন্তব্য মোবাইল কোম্পানি|

 

তন্দ্রাচ্ছন অবস্থায় ভাবছিলাম যে মানুষের জীবনটা আসলে কোনো না কোনো লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়! একটি লক্ষ্য অর্জিত হবার পর আপনা আপনি আরেকটি লক্ষ্য চলে আসে, 

জীবন এভাবেই বিরামহীন ভাবে চলতে থাকে এবং একসময় দৌড়াতে দৌড়াতে না ফেরার দেশে যাবার সময় চলে আসে, 

মাঝে মাঝে ভাবি মানুষ মৃত্যুর সময় কি চিন্তা করে? আরো কয়দিন যদি বাঁচতে পারতাম!? জানি না...এই এলোমেলো চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম|

ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো | প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে, রাতে খাওয়া হয়নাই! বিছানা থেকে উঠে পড়লাম|সিলেটের মিরাবাজারের এই হোটেলটিতে ভোরবেলা আমার সূর্যোদয় দেখতে খুব ভালো লাগে, আচ্ছা সকাল যে এতো সুন্দর হয়, এই শহরের অধিকাংশ মানুষ কি তা জানে? কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে  গেলোএবং মনে হলো ফজরের নামাজটা পড়া দরকার! নামাজ পরে ঠিক করলাম আজকে কোন কোন প্রজেক্ট এ যেতে হবে, ল্যাপটপ অন করে সিডিউলে দেখলাম, ওহ নো! সুনামগঞ্জের মান্নানঘাটে আজ  বেসস্টেশন এর ফ্লোর ঢালাই এবং সেই সাথে পাইল ক্যাপও, মানে হচ্ছে রাত ৮ তার আগে হোটেলে ফিরতে পারবো না! হোটেল এর নিচতলায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে সকালের নাস্তা খেতে খেতে ড্রাইভারকে  ফোন দিলাম:

আমি:" ফজলু ভাই, ঘুম ভাঙসে?
ফজলু: "জি স্যার"
আমি: "আজকে মান্নান ঘাট যেতে হবে, আপনি তো সুনামগঞ্জ ঘাটে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আরাম করে ঘুমাবেন আর আমারে দেড় ঘন্টার ট্রলার জার্নি করতে হবে!"
ফজলু: "আপনি বললে আমি আপনার সাথে যেতে পারি!"
আমি: "না থাক, আপনি রেডি হয়ে গাড়ি বের করেন, আমরা ৯ টায় যাত্রা শুরু করবো"
ফজলু: "ঠিক আছে স্যার"

আমি লাইন কেটে দিয়ে পরোটা আর গরুর মাংস খেতে থাকলাম, আর ভাবলাম সাঁতার তো জানি না, যদি সলিল সমাধি হয় তো আমি শেষ! আজ অবশ্য রৌদ্রজ্জ্বল দিন, 

নদী অশান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম! ধুরও মরতে তো একদিন হবেই, মরার কথা ভেবে সুন্দর সময় নষ্ট করার কোনো কারণ আমি দেখি না!

গাড়িতে উঠে হাসন রাজার সিডিটা চালু করলাম, গান বেজে উঠলো:
"লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার।।

ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর।
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।।

এ ভাবিয়া হাসন রাজায়
ঘর-দুয়ার না বান্ধে।
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।

জানত যদি হাসন রাজা
বাঁচব কতদিন।
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।"
অসাধারণ গান! গানের মাধ্যমে হাসন রাজা বলতে চেয়েছেন যে এই পৃথিবীর চাকচিক্য, গাড়িবাড়ি সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী এবং এইগুলো ফেলে চলে যেতে হবে! 

কেন জানি এই সিলেট অঞ্চলে আসার পরে আমি হাসন রাজার গানের ভক্ত হয়ে উঠি এবং আনন্দের বিষয় আমাদের দেশের কিছু তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী গানগুলোকে 

আমাদের প্রজন্মের জন্য উপস্থাপন করেছে যে শুনতে দারুন লাগে যদিও নিন্দুকেরা নানা কথা বলে, নিন্দুকের কাজই তো নিন্দা করা!
(চলবে)