মৃত্যুর স্বাদ আর পানির রুপ, এক এবং অভিন্ন । মানব এবং জীব জগতের জন্য পানি যেমন মঙ্গলময়, তেমনি অমঙ্গলময়ও বটে । ঠিক মৃত্যুও এমনি । গ্রামবাসী সর্বদা আমার বাবার মৃত্যুর কামনা করতো । তাদের কামনা একদিন সত্যই পূর্ণ হলো ।
নিয়মিত গ্রামে তখন ডাকাতি হত । একদা আমার দাদার বাড়িতে একবার ডাকাত পড়ে । বাবা খুব সাহসের সাথে ডাকাতদের প্রতিহত করে । ফলসরূপ বাবার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে যায় । গ্রামবাসী আর বাবাকে শহরে ফিরে যেতে দেয় না । বাবার সাথে চুক্তি হয়, বাবা যতদিন বাঁচবে গ্রামবাসী ততদিন বাবাকে খাজনা দিবে, বিনিময়ে বাবার দায়িত্ব ডাকাতদের হাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করা । বহুদিন হয়ে গেছে গ্রামে আর ডাকাত আসে না । এখন তাই বাবাকে কেউ খাজনা দিতে চাই না । বাবা গ্রামবাসীদের কথা শুনতে নারাজ । সে জোর করে খাজনা তুলতে শুরু করে দিলো । এভাবে চলছিল বহুবছর ।
গত নয় মাস হলো বাবা খুব অসুস্থ্য ছিল । বাবার চিকিৎসা করানোর মত যথেষ্ট টাকা ছিল না । বাবার অপরাদের জন্য আমি অনেকের কাছে ক্ষমা চেয়ে ছিলাম । কিন্তু কেউ ক্ষমা করেনি । প্রকাশ্যে আমাকে অপমান করেছিল । বাবা এখন আর নেই । মাটি তার দেহ খেয়ে নিজেকে তৈরী করছে বৃক্ষ বা গুল্মের পুষ্টি উপাদানের কাজে । প্রাণীকুল আবার সেই বৃক্ষের বা গুল্মের পুষ্টি খেয়ে নিজেকে তৈরী করছে মৃত্যুর স্বাদ নিতে । মৃত্যু যেন এক অপরূপ পুষ্টিগুণে ভরপূর স্বাদ ।
বাবার মৃত্যুর আনন্দে গ্রামে জলসা বসেছিল । কত উল্লাস হয়ে ছিল তার হিসাব আমি করতে চাই না । যার হিসাব তিনি করবেন । সৃষ্টিকর্তা কখনো কল্যাণ পাঠিয়ে অকল্যাণ করেন আবার কখনো অকল্যাণ পাঠিয়ে কল্যাণ করেন । আমার বাবাই তার উদাহরণ ।
বাবার মৃত্যুর পর আবার গ্রামে ডাকাত পড়া শুরু করেছে । ডাকাতের কবলে সবাই এখন নিঃস্ব । কেউ কেউ আমার কাছে এসেছিল । গ্রাম তো শেষ হয়ে গেল, কিছু একটা করো । হালিম বেপারি সকাল থেকে আমার পা ধরে বসে আছে । ডাকাত দল সকল সম্পদের সাথে তার সুন্দর রুপসী স্ত্রীকেও নিয়ে গেছে । কী আশ্চর্য ঘটনা । যে আমার বাবার মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি মিষ্টি বিতরণ করেছিল । সে আজ আমার পায়ে ধরে বসে আছে, আমি যেন আমার বাবার দায়িত্ব নেই । গ্রামকে যেন রক্ষা করি । মৃত্যুর স্বাদ এক ভয়ানক জিনিস, যা ভুলতে পারি না কোন মতে ।
শাবলু শাহাবউদ্দিন
কবি ও গল্পকার
সিকশন, হাজারীবাগ
ঢাকা, বাংলাদেশ ।