পোস্টস

চিন্তা

ফিরে দেখা জীবন

১২ জুন ২০২৪

আহাদ কনক প্রত্যয়

মাঝে মাঝেই এই ক্ষুদ্র(!) জীবনটাকে রিক্যাপ করে দেখতে ইচ্ছে করে। জীবনটাকে মাঝে মাঝে খুব দীর্ঘ লাগে, আবার এক সময় মনে হয়- এইত সেদিন শুরু হল,

ছোটবেলার কথা খুব বেশি মনে নেই৷ তখন ত আর হাতে হাতে স্মার্ট ফোন ছিল না, তাই ছবিও নেই খুব বেশি। তবে, ছোট বেলায় এত এত ভাবনা ছিল না৷ খুব ঝিমঝাম করে বাচতাম, সবার থেকে লুকিয়ে থাকতাম৷ জগৎ বলতে- বাসা টু স্কুল, আর মাঝে মাঝে ছাদে৷ তখন, ঘুড়ি উড়ানোর খুব ঝোক ছিল। বন্ধু ছিল না কোন। তাই মানুষের সাথে মানিয়ে চলার স্কিলটা, আজও ভালভাবে রপ্ত করা শিখে উঠতে পারি নি৷

মা বলত, আমি নাকি ছোটবেলায় অনেক মেধাবী ছিলাম। গ্রামের স্কুলে ছেলে মেয়েদের হাইট দেখে বয়স নির্ধারণ করা হত। সেই হিসেবে- আমাকে ছোট ওয়ানে ভর্তি নিল, আর বড় ভাইকে বড় ওয়ানে। একদিন ক্লাস করার পর, ভাইকে পাঠায় দিল ছোট ওয়ানে, আর আমাকে বড় ওয়ানে৷ ক্লাস ওয়ান থেকে টুতে উঠলাম, ফার্স্ট হয়ে৷ যদিও সেই স্কুলে আর পড়া হয়নি, যান্ত্রিক শহর ঢাকায় চলে এলাম৷ যদিও, কখনোই এই শহরটাকে আমার আপন লাগে নি।

নতুন করে আবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানো হল৷ তখন একটা বন্ধু ছিল আমার, আব্দুল্লাহ নাম৷ আমার সবচে পুরোনো বন্ধু, যাকে আমি মনে করতে পারি৷ বার্ষিক পরীক্ষায় পাশাপাশি সিট পড়ল, ওরচে ভাল রেজাল্ট করলাম৷ আব্দুল্লাহ'র আম্মু, আমাকে ডেকে বলল- আমি নাকি ওর খাতা দেখে ভাল রেজাল্ট করেছি৷ এই কথাটা আমাকে এতটুকুও ভাবায় নি, যতটা ভাবিয়েছে আব্দুল্লাহ'র কান্না৷ রোল আমার চেয়ে পিছনে চলে যাওয়ায়, সে কি কান্না৷ এরপর, আর কখনো পড়ার আগ্রহ পাইনি। কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়া কখনোই আমার লক্ষ্য ছিল না৷

ক্লাস ফাইভে আবার নতুন স্কুলে গেলাম। কোন নতুন নোটিফেশন দেখতে যে এরকম আগ্রহ আসে, সেরকম ক্লাসের সবার দৃষ্টি ঠিক আমার দিকে। তারচে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল, যখন দেখল ছেলেটা কোন কথাই বলে না; শুধু চেয়ে থাকে। আমি সবাইকে অবজার্ভ করে যেতাম৷ মনের ভিতরে কাল্পনিক কথোপকথন চলতেই থাকত, কিন্তু সেসবের কিছুই বলা হত না৷ টিচার রোল কল না করলে, কেউ জানতেও পারত না, আমি কথাও বলতে জানি।

ক্লাস সিক্সে আবার নতুন স্কুলে আসলাম। এই স্কুল আমার দুঃসম্পর্কের এক মামার, তাছাড়া মা এই স্কুলেরই শিক্ষিকা ছিলেন। একটু ডানা মেলতে চেয়েছিলাম, হয়ত বয়সটাই উড়ার উপযোগী ছিল। কিন্তু ডানা ছাপটাতে পারলাম আর কই! পরিচয়টা জানার পর, সবাই কেমন চুপসে গেল। নিজের একটা নাম ছিল সেটাও ভুলে গেলাম, সবাই ডাকত ম্যাডামের ছেলে বলে।

ক্লাস এইট আমার জীবনে প্রথম ট্রানজিশনাল ফেস৷ এর আগে কখনো পড়াশোনা নিয়েও ভাবি নি, রেজাল্ট ত দূরে থাক৷ স্কুলে কিছু লোক এল একটা কলম কোম্পানীর প্রমোশনের জন্য। উনারা জিজ্ঞেস করল, কে কে এ+ পেতে চাও? আমি গড়পড়তা স্টুডেন্ট, তবুও হাত তুললাম। সেই দেখে, ক্লাসের সবাই সে কি হাসাহাসি। জীবনে কিছু থাক আর না থাক, ইগো ছিল ভীষণ। বাসায় গিয়ে পড়া শুরু করলাম। আর কখনো স্কুলে যায়নি, JSC পরীক্ষার আগ অব্দি৷ রেজাল্ট এল, আমার লক্ষ্য আমি পূরণ করতে পেরেছিলাম।

ক্লাস নাইনে বড় স্কুলে ভর্তি করানো হল৷ স্কুলে প্রচুর কড়া নিয়ম কানুন, সাথে নতুন বন্ধু বান্ধব- দিনগুলো মন্দ যাচ্ছিলো না৷ নিজের খোলস ছাড়িয়ে বের হবার চেষ্টা করতেছি একটু একটু করে৷ পুরো বছরে কোনদিন পড়তে বসেছিলাম কিনা মনে নেই৷ ফলাফল, হিসাবে অর্ধ বার্ষিক আর বার্ষিক পরীক্ষা দুটোতেই ম্যাথ আর হায়ার ম্যাথে ফেইল। টিসি খেয়ে সোজা এলাকায়।

ক্লাস টেনে আবার নতুন স্কুল, তার উপর নতুন এলাকা। এখানে না কেউ আমাকে চিনে, না আমি কাউকে৷ এটাই মেইবি আমার লাইফের টার্নিং পয়েন্ট৷ এখানেও সবাই অমুকের ছেলে হিসাবে চিনত, যেটা আমি কখনোই চাইতাম না৷ নিজের একটা পরিচয় তৈরির আকাঙখা জেগে উঠেছিল৷ কতটা পেরেছিলাম জানি না, তবে আমি নতুন করে বেচে উঠেছিলাম৷ এখানেই আমি মানুষের সাথে কথা বলতে শিখেছি, একা একা নিজেকে হ্যান্ডেল করা শিখেছি, বন্ধু এবং বন্ধুত্বের প্রতি মনোভাব কেমন হওয়া উচিত সেটা জেনেছি। যে ম্যাথে ফেলের জন্য টিসি খেয়েছিলাম, সেই ম্যাথ বইয়ের এমন কোন অংক ছিল না, যার সমাধান আমি পারতাম না।

তারপর, দেবেন্দ্র কলেজে। যে রেজাল্ট করেছিলাম, তা দিয়ে ঢাকায় কোন কলেজে পড়াটাও সম্ভব ছিল না৷ তাছাড়া, শহর আমার ভাল লাগে না৷ মানিকগঞ্জ জায়গাটা আমার বেশ পছন্দের, ৫/১০ মিনিট হাটলেই গ্রামীন পরিবেশ৷ ফার্স্ট ইয়ার স্বপ্নের মত কেটেছিল, ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম। অনেক বন্ধু ছিল আমার। এখন কয়জন আছে, সেটা ভিন্ন ইস্যু৷ তবুও, কলেজ লাইফটা আমার জীবনের সেরা অংশ। ইমপ্রুভমেন্ট দেয়াটা কাউন্ট করলে, আমি মানিকগঞ্জ শহরে তিন বছরের মত ছিলাম। এখনো ছুটিতে ঢাকা এলে, আমি সবার আগে মানিকগঞ্জ যাই- না গেলে আমি বাড়ি এসেছি; এটা মনেই হয় না৷

তারপর, খুলনা জীবন। এখানে শুরুটা ভালই ছিল, ক্লাস শুরুর একমাস আগে চলে এসেছিলাম৷ কিন্তু ক্লাস শুরুর পর নিজেকে শুধু হারিয়েই গেছি। চলে গেছি সময়ের পিছনের দিকে, ঠিক সেই সময়টায়- যেই সময়টায় আমি কথা বলতে চেয়েও বলতে পারতাম না৷ জীবনে প্রথম বারের মত, নিজের সিদ্ধান্ত উপর রাগ হল- নাহ, জাবিতে পড়লেই হইত৷ যেই নগর থেকে সব সময় বহুপথ দূরে থাকতে চাইছি, আজ সেই নগরেরই ডাক্তার হতে চলেছি আমি৷ মানে, নগর-পরিকল্পনাবিদ!

এই নগরে শেষ কবে বেচে ছিলাম, মনে পড়ে না। বেচে থাকাটা মানে ত কেবল শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া না, বেচে থাকা মানে- নিজেকে বলতে পারা,

"কিছুক্ষণ থেকে যাও, যেও না এখনই,

তোমাকে দু' চোখ ভরে দেখার আরও যে বাকি!"