Posts

সত্তাশ্রয়ী

রসিক গালিবের রসিকতা : মদ ও দুঃখ যার প্রিয় খাবার

June 12, 2024

মৃনাল চন্দ্র

রসকষে ভরপুর গালিবের প্রিয় বন্তু ছিল মদ এবং দুঃখ। মদ নিয়ে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় শেরটির গল্প এরকম,
একদিন গালিব মসজিদে বসে মদ খাচ্ছিলেন। তখন মসজিদের লোকজন গালিবকে বলেন, 'মসজিদের বাহিরে গিয়ে মদ খাও'
গালিব তখন বলেন, 
"শরাব পিনে দে মসজিদ ম্যঁ ব্যয়ঠ কর 
ইয়া ও জগাহ্ বাতা জঁহা খোদা নেহি হ্যেঁ"
অর্থাৎ, মসজিদে বসেই আমাকে মদ খেতে দাও, অথবা সেই জায়গার কথা বলো, যেখানে খোদা নেই।

গালিবের মদ ও দুঃখ নিয়ে এমন আরও বহুতর মজার ঘটনা আছে। গালিবের আর্থিক অবস্থা ছিল খুব টলমলে। একবার মীর মেহেদী মজরুহকে চিঠিতে লেখেন, 
"মিঞা, বিনা আয়ে বেঁচে থাকার কায়দা আমি শিখে গেছি। এদিক থেকে সন্তুষ্ট থেকো। রোজার পুরো মাস রোজা খেয়ে-খেয়ে কাটলো। আজ্ঞে, খোদা দাতা। আর যদি কিছু খেতে না-পাই, দুঃখ তো আছেই।"

ইংরেজ সভ্যতার মধ্যে যে আদৎ লক্ষণ আছে,  গালিব তা জেনে গিয়েছিলেন। মীর মজরুর ভাইয়ের ধর্মশিক্ষা নিতে যাবার প্রসঙ্গে  তাই তিনি লিখছেন, 
"সরফরাজ হুসেনকে বলো, মিঞা, কার পাল্লায় পড়েছ? ধর্মগ্রন্থ পড়ে কী হবে? মানুষ যদি হতে চাও তো, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা এবং তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র পড়ো।"
সৈয়দ আহমদ খার অনেক আগেই গালিব এই পশ্চিমা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।

অক্টোবর মাসে একবার গালিবের বাড়িতে জনাকয়েক গোরা বা ব্রিটিশ সেনা ঢুকে পড়ে। তারা গালিবকে নিয়ে যায় কর্নেল ব্রাউনের কাছে। ব্রাউন জিজ্ঞেস করেন, 'গালিব, আপনি কি মুসলমান?'
তাত্ক্ষণিক গালিবের জবাব, 'জি, হা। আধা। মদ খাই, শুয়োর খাই না।'

মদ খাওয়া ছাড়া গালিব থাকতে পারতেন না। তাও আবার দেশি মদ ছুঁতেন না। বিদেশি মদ ছিল তার প্রিয়।  মদ না-খেলে রাতে ঘুমাতে পারতেন না। বিলেত থেকে আসত 'পুরনো টম' নামের বিশেষ মদ। দেশে তখন বিদ্রোহ চলে। চব্বিশের মদ উঠল ষাটে। দারিদ্র্য গালিব মদ কিনতে না-পেরে রাতে ঘুমোতে পারেন না। শেষমেষ বাধ্য হয়ে স্বদেশী মদেই একটু-আধটু চুমুক দেন। এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, 
"অনেকদিন ধরে অবশ্য রাত্তিরে ফরাসি ছাড়া কিছুই চলে না। ওটা ছাড়া আবার রাত্তিরে ঘুমও আসে না। যদি সাহসী ভগবৎতুল্য দিলদরিয়া মহেশ দাস ফরাসিরঙা দিশি মদ, গন্ধে অতুল্য, না-পাঠাতো, তাহলে বাঁচাই কঠিন হতো।"

মদমত্ত গালিবকে নিয়ে অনেকেই হাস্যপরিহাস করতো। কে যেন একবার গালিবের মদ খাওয়ার সময় বলল, 
'যারা মদ খায়, আল্লাহ্ তাদের প্রার্থনা শোনেন না।'
মদমত্ত গালিব কম যান কীসে। তিনি জবাব দিলেন,
'ভাই, যার কাছে মদ আছে, সে আর কীসের জন্য প্রার্থনা করবে?'

গালিব চৌরস বা শতরঞ্চ খেলতে খুব ভালোবাসতেন। একবার রোজার সময় তিনি শতরঞ্চ খেলছিলেন। তখন এক লোক তাকে খেলতে দেখে বললেন, 
'শুনেছিলাম, রমজান মাসে শয়তান বন্দি থাকে।'
গালিব মুখ না-তুলেই জবাব দিলেন,
'তুমি ঠিকই শুনেছ ভাই, এটা শয়তানেরই ঘর।'

গালিব কলকাতাতে বছর দুয়েক ছিলেন। এটাই সম্ভবত তার জীবনের দীর্ঘতম যাত্রা ছিল। শুধু কলকাতার স্থাপত্য ও ঘোরাফেরা করা বিদেশিনীতে  মুগ্ধ হননি গালিব, জড়িয়ে পড়েছিলেন আম্রফলের স্বাদেও। শুধু মিঠা আম নয়, তার বাসনা ছিল 'অনেক মিঠা' আম। 
তার এই অনেক আম খাওয়ার বাসনা দেখে একজন বিদ্রূপ করলেন যেন, 'আম খান কেন? আম তো গাধারাও খায় না।' 
তিলমাত্র না-ভেবে গালিব পাল্টা জবাব দিলেন, 'আম খায়  না জন্যই তো ওরা গাধা।'

লোহারুর নবাব খবর নিতে পাঠিয়েছিলেন, গালিব কেমন আছেন? তার উত্তরে রসিক গালিব শেষবারের মতো রসদ করে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন, 
"দুয়েকদিনের মধ্যেই আমার পাড়াপড়শিদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে, গালিব কেমন আছে।"

১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯ রসিক গালিব রসসাগরে ডুব দেন।
১৩/০৬/২৪খ্রি. 'চট্টগ্রাম

Comments

    Please login to post comment. Login