শরীর ও স্বাস্থ্যের সামাজিক গড়ন
আমরা সাধারণত মনে করি স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা মানুষের ভালো খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যগত অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। আমরা স্বাস্থ্যকে একটি শরীরবৃত্তীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি। মোটাদাগে সুস্থতা ও অসুস্থতা একটি প্রাকৃতিক বিষয়। আসলে কি তাই? প্রকৃত পক্ষে মানব স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়। মানুষের জম্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বস্তুগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রণালীর সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান মানুষের স্বাস্থ্য, অসুস্থতা ও চিকিৎসা প্রণালীর উপর প্রভাব রাখে। সমাজ ভেদে চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন হয়। সেবা গ্রহণের ধরণ যেমন ভিন্ন হয় তেমনি সেবার সার্বজনীনতা কিংবা গ্রহণযোগ্যতায়ও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। একেক সমাজে চিকিৎসা পদ্ধতি একেক ধরনের। এমনকি মাতৃ গর্ভের শিশুর শারীরিক কাঠামোও সামাজিক অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়। শিশুর সুস্থতা, দীর্ঘ জীবন, অসুস্থতা, মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে তার বেড়ে উঠার প্রক্রিয়া যা সামাজিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। যেমন জম্মের সময় শিশুর ওজন তার মায়ের খাদ্যাভ্যাসের উপর নির্ভর করে যা তার সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, সামাজিক শ্রেণি প্রভৃতির উপর নির্ভর করে। নবজাতকের স্বাস্থ্য মায়ের সামাজিক অবস্থা যেমন ধূমপান অভ্যাস, ঘরের অবস্থা, টয়লেটের অবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে যা পরবর্তীতে নবজাতক ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডসহ নানা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। বাচ্চার গৃহের অবস্থা এবং পরিবেশ তার মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করে পরবর্তীতে যার প্রতিফলন হয়ে থাকে। তার লিঙ্গ, নৃগোষ্ঠী, জাতীয়তা ও সামাজিক শ্রেণি তার জীবনধারা পরিবর্তনে কাজ করে।
একজন কর্মক্ষম সুস্থ-সবল কর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে তার চারপাশের পরিবেশ ও সামজিক সম্পর্ক তার স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। সংস্কৃতি নির্ধারিত করে সে কী খেতে পছন্দ করবে, কিভাবে চাপ সইবে, সে মদ পান পছন্দ করবে কিনা কিংবা কিভাবে সে তার শরীর সম্পর্কে অনুভব করবে। একটি শিশু যে সামাজিক কাঠামো এবং সংস্কৃতির মধ্যে জম্মগ্রহণ করে তা তীক্ষ্ণভাবে তার অসুস্থতা এবং চিকিৎসা পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখন সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে তার সামাজিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন একজন মানুষ যখন ঠাণ্ডা জ্বরে আক্রান্ত হয় তখন তার প্রতি অন্যদের মনোভাব কেমন আর যখন জানে সে এইডসে আক্রান্ত তখন মনোভাব কেমন? করোনাকালীন সময় পাশের ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিলে অন্যদের আচরণ কেমন ছিল আর এখন কেমন? করোনার সময় কারো সর্দি-কাশি হলে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কেমন আর এখন কেমন? অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি অন্যদের আচরণ সমাজ ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত।
একই সাথে ব্যক্তির সামাজিক শ্রেণি, বয়স, নৃগোষ্ঠী প্রভৃতি তার উন্নত স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ ও প্রাপ্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে। এমন কি তার মহান মৃত্যুও তার সামাজিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। আরও একটু অগ্রসর হয়ে বললে মৃত্যুর পর তার সমাহিত হওয়াও তার সামাজিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। স্বাস্থ্য সেবার সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন বীমা, ওষুধ পস্তুতকারক কোম্পানি, ডাক্তার ও অন্য পেশাজীবী, হাসপাতাল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত থাকে যারা তাদের স্বার্থে স্বাস্থ্য সেবা সেট করে যা সমাজ ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্যক্তির শরীর একটি সামজিক শরীরের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করে। মোদ্দা কথা ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত বিষয় তার সামাজিক অবস্থার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ‘In large part, illness, death, health, and well-being are socially produced’ (Peter E. S. Preund and others, 2003).
সমাজ নির্ধারন করে সমাজে কে সুন্দর, কে কুৎসিত, কে অসুস্থ, কে সুস্থ। সমাজ স্বাস্থ্যগত নানা বিষয় চাপিয়ে দেয়। বয়স, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ প্রভৃতির ভিত্তিতে সমাজ শারীরিক অনেক বিষয় নির্ধারন করে। কোন সমাজ শরীরকে একটি কর্মরত মেশিনের মত দেখে কেউবা আবার একটি আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে দেখে। সমাজ শরীর সম্পর্কে, সুস্থতা-অসুস্থতার ধারণা তৈরি করে। “Our ideas of the body and its health and illness are influenced by both our culture and our social class position, such as class or gender. Both cultural and social structural factors are important in understanding people’s behavior and health.” (Peter, 2003). যেমন বাংলাদেশে কোন দম্পতির সন্তান না হলে স্ত্রীকে ‘বন্ধ্যা’ বলা হয়ে থাকে। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ শারীরিক ভাবে সে আদৌ বন্ধ্যা কিনা তা দেখা সুযোগ দেয় না। প্রকৃত পক্ষে তার পরিবর্তে স্বামীর সন্তান জম্ম দেয়ার ক্ষমতাও না থাকতে পারে। স্বামীর সমস্যার জন্য সন্তান উৎপাদন না হলেও সন্তান উৎপাদনের অসুস্থতার দায়ভাব স্ত্রীর উপরই বর্তায়। সন্তান জম্ম দিতে না পারার অসুস্থতার জন্য সমাজ নারীকেই দায়ী করে পুরুষকে নয়। সমাজই তৈরি করে কে সুস্থ আর কে অসুস্থ। সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণা, আদর্শ, বিশ্বাস, ভাষা, ভালো খারাপ সম্পর্কিত ধারণা, স্বাধীনতা প্রভৃতি সমাজে মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছেদ, আচার ব্যবহার নির্ধারন করে। নাচ, গান, সিনেমা দেখা, নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ, বিভিন্ন খেলাধুলা ইত্যাদি সমাজের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নির্ধারন করে। যেমন বাংলাদেশে সমাজে মনে করা হয় নারীরা ভারী জিনিসপত্র বহন করতে অক্ষম। শারীরিক ভাবে তার সামর্থ্য থাকলেও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কারণে সে তা পারবে না। তার শারীরিক সামর্থ্য নির্ধারিত হয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রত্যাশা করে নারীরা দুর্বল হবে তাদের সামাজিক পদমর্যাদার কারণে। যেহেতু সমাজে পুরুষরা বেশি মর্যাদার অধিকারী তাই তাদের শারীরিক সামর্থও বেশি থাকবে। নারীরা শক্তিশালী হতে পারবে না। তাকে দুর্বলভাবে থাকতে হবে। সংস্কৃতি তার শরীর ও স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে সে চাইলেও শক্তিশালী হতে পারে না। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ তার খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও একটি আবদ্ধতা তৈরি করে রাখে।
লম্বা মানুষের সামাজিক গুরুত্ব বেশি তাই লম্বা হওয়ার জন্য বিশেষ ব্যায়াম করা হয়। কোথাও মোটা হওয়ার জন্য আবার কোথাও স্লিম হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলে। সমাজ মোটা-চিকনের অবস্থা নির্ধারন করে দেয়। যে সমাজে যার গুরুত্ব বেশি সে সমাজে মানুষ তাতে আগ্রহী। ফর্সা হওয়ার জন্য নানা প্রসাধনী ব্যবহার করা হয় ক্ষতির ঝুঁকি জেনেও। শারীরিক গঠন এবং বিকৃত গঠনে সমাজের প্রভাব রয়েছে। সামাজিক দল এবং তাদের সংস্কৃতি সদস্যদের শারীরিক গঠনে ভূমিকা রাখে। চীনের প্রথাগত সমাজে সাংস্কৃতিক কাঠামো শিশুদের পায়ের পাতার কাঠামো ঠিক করতে পা বন্ধক ব্যবহার করে। Kwakiutl Indian শিশুদের মাথার গঠনে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে এক ধরনের আবরণী (cradle boards) ব্যবহার করে। বাংলাদেশেও নবজাতকের মাথার গঠন ঠিক রাখতে জম্মের পর পর কাপড় পেঁচিয়ে গোলাকার ফ্রেমের মধ্যে মাথা রাখার প্রচলন রয়েছে। সামাজিক গঠনের সাথে মানুষের শরীর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। অসুস্থতা শুধু শারীরিক অভিজ্ঞতা নয়, এটি সামাজিক অভিজ্ঞতা। অসুস্থ শরীর শুধু জীবাণু আক্রমণ নয় বরং চার পাশের পরিবেশের সাথেও যুক্ত যেখানে সে বাস করে। সামাজিক অবস্থা বা কাঠামোর দ্বারা শারীরিক বডি উম্মুক্ত হয়। আমাদের বস্তুগত পরিবেশ, কাজের স্থান, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি আমাদের সংস্কৃতি, সমাজ কাঠামো এবং সামাজিক সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং এটি আমাদের শরীরকে প্রভাবিত করে।
সমাজ কাঠামো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করে। যেমন অভিভাবক-সন্তান, সুপারভাইজার-কর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, বন্ধু-বন্ধু এসব সম্পর্ক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও পদমর্যাদা ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্যক্তি তার শরীরের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সামাজিক স্তরবিন্যাসে তার শ্রেণিগত অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। যেমন সমাজে ভারী জিনিসপত্র বহনের ক্ষমতা নিম্নবিত্তের মানুষের উচ্চবিত্তের নয়। উচ্চবিত্তের মানুষ ভারী জিনিসপত্র বহন কিংবা কায়িক শ্রম দেয়ার শারীরিক সামর্থ থাকলেও সমাজ তাকে সে কাজে বাধা প্রদান করে। অন্যরা মনে করে সে এটা পারবে না। ব্যক্তি নিজেও সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও পারবে না বলে এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে। উক্ত কাজ তার অবস্থার সাথে যায় না বিধায় সে পারবে না বলে এড়িয়ে যায়। আবার একজন নিম্নবিত্তের মানুষের হয়তো ভার বহন কিংবা কায়িক শ্রম দেওয়ার সামর্থ না থাকলেও সমাজ তাকে সেই কাজে চাপ সৃষ্টি করে করতে বাধ্য করে। সে নিজেও সামর্থ্য না থাকা স্বত্বেও পারবে বলে চেষ্টা যালিয়ে যায় কিংবা নিজের শারীরিক সক্ষমতা জাহির করতে চায়। একই সাথে উচ্চবিত্তের একজন মানুষ নিম্নবিত্তের একজন মানুষের শরীর নিয়ন্ত্রণ করারও ক্ষমতা রাখে। শ্রেণির সাথে জাতিতত্ত্ব, বয়স, লিঙ্গ, আয়, পেশা প্রভৃতি সম্পৃক্ত থাকে যা দ্বারা সমাজে তার ক্ষমতা নিধারিত হয়। সমাজে ব্যক্তির ক্ষমতার উপর নির্ভর করে সে তার বা অন্যের শরীরকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সামাজিক যোগাযোগ, অবস্থা ও ক্ষমতার সাথে ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের শরীর স্বাস্থ্য সম্পৃক্ত থাকে। ক্ষমতা স্বাস্থ্যকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। পরিবারের মধ্যে ক্ষমতা প্রভাব রাখে যা স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। আধুনিক তাত্ত্বিকেরাও মানুষের খাদ্য, অপরিচ্ছন্নতা, শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ধারণা, চিকিৎসা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক ধারণার সামাজিক ভিত্তি শক্তিশালী। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংজ্ঞায়ও দেখা যাচ্ছে সামাজিক ভিত্তি (social construction) প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যেমন International Dictionary of Medicine and Biology স্বাস্থ্যকে সজ্ঞায়িত করেছেন “a state of well-being of an organism or part of one, characterized by normal function and unattended by disease”. এই সংজ্ঞায় ‘well-being’ বা ভালো থাকা শুধু রোগমুক্ত থাকাই ভালো থাকা নয়। শরীরের সব অঙ্গ ভালো ভাবে কাজ করলেও একজন মানুষ ভালো নাও থাকে পারে। ভালো লাগা খারাপ লাগা একজন মানুষের সংস্কৃতির সাথে যুক্ত থাকতে পারে। ব্যক্তির বিশ্বাসে আঘাত লাগলেও সে খারাপ থাকতে পারে। স্বাস্থ্য বিষয়টি যতনা বস্তুগত তার থেকে বেশি অবস্তুগত। একই ভাবে চিকিৎসা নেয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। ব্যক্তি কী ধরণের চিকিৎসা নিয়ে স্বস্তি পায় সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায় হুজুরের পানি পড়ার কারণে শারীরিক কোন উন্নতি না হলেও মনে প্রশান্তি এসেছে যার ফলে সে নিজেকে সুস্থ দাবী করছে। আবার সঠিক রোগের সঠিক ওষুধ খেয়ে শারীরিক উন্নতি হলেও উক্ত চিকিৎসা সেবায় তার আগ্রহ না থাকার ফলে নিজেকে আরও অসুস্থ বোধ করছে।
ক্ষমতা এমন একটি বিষয় যা আমরা কি প্রত্যাশা করি, কি চাই তা করতে আমাদের সাহায্য করে। এটি দৈনন্দিন জীবন যাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফলে স্বাস্থ্যের সাথে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কর্মীর সাথে ও কাজের ক্ষেত্রের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষমতা ব্যক্তি তার বস্তুগত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ যেমন করে তেমনি সমাজ ভেদে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নীতি ও সেবা প্রদানের বিষয়ও নির্ধারিত হয়। একই সাথে ব্যক্তির ভালো থাকা, সেবা গ্রহণ, নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও যুক্ত। ক্ষমতা দ্বারা একজন ব্যক্তি বিরূপ পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে নিরাপদ করতে পারে যার সাথে তার স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা গভীরভাবে সাথে যুক্ত। একজন ব্যক্তির ক্ষমতা শুধু তার সাথেই যুক্ত নয় এর সামাজিক ভিত্তি রয়েছে। ব্যক্তির ক্ষমতা দ্বারা সে অন্যকে নিয়ন্ত্রণই শুধু করতে পারে না অন্যের স্বাস্থ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ক্ষমতার সাথে নিয়ন্ত্রণের সম্পর্কের ন্যায় ক্ষমতার সাথে শরীরেরও সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষমতায়নের মত বিশেষ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণই ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। নিয়ন্ত্রণ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের পরিবেশকে পরিচালনার সামর্থ্যকে বুঝায় যার দ্বারা সংকটমুক্ত ও নিরাপদ অবস্থা নিশ্চিত করে। তাই ক্ষমতা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য ও শরীর একই ধারায় সম্পৃক্ত। পরিবার প্রধানের হাতে ক্ষমতা থাকে বিধায় সে পরিবারের অন্যদের শরীর নিয়ন্ত্রণ করে। কে সুস্থ, কে অসুস্থ, কার কী ধরণের চিকিৎসা প্রয়োজন সেই নির্ধারন করে থাকে। অফিসের বসও একই ভাবে অন্যদের সুস্থতা, অসুস্থতা, চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করে থাকেন। তাই সার্বিকভাবে মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্য, সুস্থতা, অসুস্থতা শুধু একটি প্রাকৃতিক বিষয় নয় বরং একটি সামাজিক বিষয়। মন-শরীর-সমাজ অভিন্ন সূত্রে যুক্ত। মানুষের সুস্থতা-অসুস্থতা তৈরির ক্ষেত্রে সামাজিক অসমতা, ক্ষমতা, সামজিক নিয়ন্ত্রণসহ সামাজিক বিষয়গুলো আন্তঃসম্পর্কের জালে আবদ্ধ। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা মূলত শরীরের সামাজিক গঠন(social construction of body) বিষয়ে জোর দেয়া হয় এবং কিভাবে ক্ষমতা শরীরের এই সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলে। কিভাবে সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামো একটি বড় উপাদান এবং কিভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা আমাদের শরীর, স্বাস্থ্য ও সেবা গ্রহণের সাথে সম্পৃক্ত ও আমাদের শারীরিক ভাবে প্রভাবিত করে তা দেখার চেষ্টা করে।
মন শরীর ও সমাজ এক অবিচ্ছেদ্য বিষয়। পরস্পরের সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আমরা প্রায়ই আমাদের স্বাস্থ্যের উপর সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন। আমরা বলে থাকি পরীক্ষা আসলে টেনশন লাগে। কেউ মারা গেলে আমাদের ভয় লাগে। এসব দ্বারা বুঝা যায় আমাদের সাধারণ জ্ঞান আমাদের মন, শরীর ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন। মন এবং শরীরের আন্তসম্পর্ক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক উপাদান সমূহের প্রভাব সত্য বলে মনে করে না কারণ এগুলো গণনা বা পরিমাপ করা যায় না। ভাইরাস, রাডিয়েশন, রাসায়নিক, ধুমাপান এসব পরিমাপ করা যায়। ডাক্তাররা মনে করে শরীর ও মন আলাদা বিষয় এর চিকিৎসাও আলাদা হবে। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করা হয় শরীর ও মন একটি অপরটির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতি দেহ ও আত্মাকে আলাদা মনে করে। হাইতির Voduo গোষ্ঠী মনে করে মানুষের দেহ ও আত্মা আলাদা বিষয়। মানুষ মারা গেলেও আত্মা সাত থেকে নয় দিন দেহের মধ্যেই অবস্থান করে। নয় দিন পর তারা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেহ থেকে আত্মাকে আলাদা করে। ‘voodoo death’ একটি প্রচলিত ধারণা। বাংলাদেশের গারো নৃগোষ্ঠীর মধ্যে দেহ ও আত্মার ধারণা আলাদা। তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা গারো পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস।তাদের সুস্থতা-অসুস্থতার ক্ষেত্রে পূর্ব পুরুষদের আত্মার যোগসূত্র রয়েছে বলেও তাদের বিশ্বাস। এটি তাদের শরীর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গ্রহণের উপর প্রভাব বিস্তার করে। একই প্রক্রিয়ায় দেখা যায় একজনের সাথে অন্যজনের কথোপকথনের দ্বারা আপনা আপনি প্রেসার বেড়ে যায়। যেমন বসের সাথে কথা বলার সময় এমন হয়।(Lynch 1985, Lynch and Rosch 1990). অনেক সময় উপজাতীয় বিধি-নিষেধ (taboo) ভাঙার কারণে কাউকে মারা হয় এবং সে ভাবে এটা তার প্রাপ্য।
প্রকৃত পক্ষে মানুষের মনস্তত্ত্ব তার সামাজিক পরিবেশেই সাড়া দেয়। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সমাজে ‘placebo effect’ এর ব্যবহার রয়েছে। ডাক্তাররাও রোগীর মানসিক অবস্থা হালকা করার জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। রোগী তার রোগ নিয়ে কী ভাবছে, চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা তার উপর তার স্বাস্থ্য নির্ভর করে অনেক ক্ষেত্রে। রোগী মানসিকভাবে তার অবস্থা মেনে নেয়ার মাধ্যমে সন্তুষ্টি অর্জন করে। তার অসুস্থতা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাকে থেরাপি দেয়া হয়। ফলে তার সুস্থতার ক্ষেত্রে এটি কাজে দেয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপের সাথেও শরীর স্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। চাপ একটি সামাজিক বিষয়। সামজিক মিথস্ক্রিয়া ও সমাজ কাঠামো এটি তৈরি করে। চাপ একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় যার সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের রক্তের প্রবাহের(Blood pressure) এর সাথে চাপের সম্পর্ক রয়েছে। মিষ্টি জাতীয় খাবার ও স্থূলতার সাথে মানুষের শরীর রাগান্বিত হওয়ার সাথে সম্পর্ক রয়েছে(Sapolsky, 1990). চাপ মানুষের স্নায়ুবিক পরিবর্তন ঘটায় যা শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখে। চাপের কারণে হৃদরোগ হয়ে থাকে বলে বলা হয়। এটি জৈবিক ভাবে রোগ সৃষ্টি বুঝায়। বাস্তবে মানব শরীর অসুস্থ শরীরে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের উপসর্গ যেমন নিদ্রাহীনতা, উচ্চরক্তচাপ, দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাথা প্রভৃতি অন্যতম। এই উপসর্গগুলো পুরোপুরি জৈবিক ভিত্তিতে তৈরি নয় (Weiner, 1992). এগুলোর সামজিক ভিত্তিই জোরালো। সাধারণত মনে করা হয় শারীরিক বিষয় যেমন সঠিক খাদ্য স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। খাদ্যকে শারীরিক চাপের মধ্যে গণ্য করা যায়। যেমন বেশি খাওয়া, কম খাওয়া, না খাওয়া। খাদ্যের নানা উপাদান ও পরিমাণের সাথে স্বাস্থ্য সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকরা বললেও আসলে এটি মনোঃসামাজিক চাপের থেকে ভিন্ন। মনোঃসামাজিক চাপ সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে। A physical stressor may have an impact on psychological states like mood(Bullinger, 1990). যেমন উচ্চ আওয়াজ মানুষের শ্রুতি শক্তি নষ্ট করে দেয় এটি একই সাথে মানুষের মুড নষ্ট করে দেয় এবং মানুষের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে। শারীরিক চাপ এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ পরস্পরের সাথে যুক্ত। কম প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমুনিটি) শারীরিক চাপ তৈরি করে ব্যক্তির শরীরে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। একই সাথে ব্যক্তির ভঙ্গুর শারীরিক অবস্থা সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে।
আমরা স্বাস্থ্যগত বিষয়ের সাথে ডায়েটকে সম্পৃক্ত করে দেখি। স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা এর সাথে জড়িত। অনেকে মনে করে সঠিক ডায়েট মেনে চললে হৃদরোগ থেকে বাঁচা যাবে, আবার অন্যরা মনে করে ডায়েট অন্যান্য প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানকে বিবেচনা করতে পারে না। প্রকৃত পক্ষে উচ্চ কোলস্টরল উচ্চ মাত্রার সামাজিক চাপের সাথে সম্পৃক্ত(Eyar, 1984; Kaplan, 1983). ধুমপান এবং চাপ উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদকম্পন বৃদ্ধি করে(Karasek and Theorell, 1990). শারীরিক চাপের সাথে মানসিক চাপও আমাদের শরীরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। Not only physical stressors but also mental ones can influence levels of muscular tension leading to musculoskeletal disorders (Lundberg, 1994). আসলে মানসিক চাপ শারীরিক চাপ তৈরি করে ফলে ডায়েট করলেও কোন সুফল আসে না। তবে মনস্তাত্ত্বিক চাপ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কারো শক্তিশালী চাপ তৈরি করে আবার কারো কম চাপ তৈরি করে। কিন্তু কেন? ব্যাক্তির চাপের প্রতিক্রিয়া সামাজিক অবস্থা ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। সামাজিক অবস্থা ভেদে ব্যক্তির শরীর চাপের প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিভিন্নভাবে চাপের এ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়(Psychological reactivity). ব্যক্তি চাপ নেয়ার ও গ্রহণ করার ধরন ভিন্ন হয় এবং এর ফলে কী ঘটবে তার উপর চাপ নির্ভর করে।
সার্বিকভাবে মানব শরীর, স্বাস্থ্য, সুস্থতা ও অসুস্থতা যতনা প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশি সামাজিক। সামাজিক অবস্থার সাথে যুক্ত। পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহ ও মূল্যবোধের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।