ফিলিস্তিন সংকট এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মানবাধিকারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই সংকটের শিকড় বহুস্তরীয় এবং এর দায় নির্ধারণ করা কঠিন। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে কারা এই সংকটকে উসকে দিয়েছে বা জিইয়ে রেখেছে, তা বিশ্লেষণ করা জরুরি। নিচে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে এই সংকটের ঐতিহাসিক দায় বিশ্লেষণ করা হলো।
প্রথমত, ব্রিটেনের ঐতিহাসিক ভূমিকা ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফার এক ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি "জাতীয় আবাসভূমি" প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। অথচ সে সময় ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল আরব মুসলিম ও খ্রিস্টানরা। ব্রিটেন ১৯২০ সালে ফিলিস্তিনে নিজেদের ম্যান্ডেট শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং ইহুদি অভিবাসনকে উৎসাহিত করে। ফলে ইহুদিদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে, যা স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ নীতির কারণে ফিলিস্তিনে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে এটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন যখন অঞ্চলটি ছেড়ে চলে যায়, তখন তারা এমন একটি অস্থির পরিস্থিতি রেখে যায়, যা স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার মাধ্যমে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের জন্ম দেয়। ব্রিটেনের একতরফা ঘোষণা ও ইহুদি অভিবাসনের পৃষ্ঠপোষকতা ফিলিস্তিন সংকটের ভিত্তি তৈরি করেছে।
তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী ইহুদি জনগণের প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়, বিশেষত হলোকাস্টের পর। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ১৮১ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পরিকল্পনা নেয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্র। ইহুদিরা জাতিসংঘের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেও ফিলিস্তিনি আরবরা ও আশেপাশের আরব রাষ্ট্রগুলো এটিকে প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিন ছাড়ার পর ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে, আরব রাষ্ট্রগুলো তা মেনে না নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়, যা "নাকবা" বা বিপর্যয় হিসেবে পরিচিত। এখানে জাতিসংঘের পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় এবং ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংঘাতের বীজ রোপণ করে।
তৃতীয়ত, ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের অন্যতম প্রধান মিত্র। শুরুতে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা সীমিত থাকলেও ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা ইসরায়েলকে বিপুল সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে। আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বছরে গড়ে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। পাশাপাশি, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনপন্থী বহু প্রস্তাব ভেটো করার মাধ্যমে তারা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা করেছে। ফলে ফিলিস্তিন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, কারণ ইসরায়েল নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য কখনোই বড় ধরনের আন্তর্জাতিক শাস্তির মুখোমুখি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থন ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করার সুযোগ দিয়েছে, যা ফিলিস্তিন সংকটকে জটিল করেছে।
চতুর্থত, আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ও ব্যর্থতা, ফিলিস্তিন সংকটকে কেন্দ্র করে আরব বিশ্ব বহু যুদ্ধ করেছে, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বরাবরই সন্দেহজনক ছিল। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করেও আরব দেশগুলো কূটনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থান নেয়। অনেক আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন ইস্যুতে বড় বড় বক্তব্য দিলেও, বাস্তবে তাদের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ১৯৭৯ সালে মিশর, ১৯৯৪ সালে জর্ডান এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ফলাফল হিসেবে ফিলিস্তিনের পক্ষে আরব ঐক্য দুর্বল হয়েছে, এবং ইসরায়েল আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল বাড়িয়েছে। এখানে, আরব নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থপরতা ও পরস্পরবিরোধী নীতি ফিলিস্তিন সংকট সমাধানকে কঠিন করে তুলেছে।
সবশেষে, ফিলিস্তিন সংকট আজও সমাধানহীন রয়ে গেছে। গাজা ভূখণ্ড ইসরায়েলি অবরোধের শিকার, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বেড়েই চলেছে, এবং প্রতিদিন নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন প্রতিবাদ ও নিন্দা জানালেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বড় শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও দ্বিমুখী নীতির কারণেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালিয়ে যেতে পারছে। এখানে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা ও দ্বৈত নীতি ইসরায়েলকে পার পেয়ে যেতে সাহায্য করছে।
ফিলিস্তিন সংকটের ঐতিহাসিক দায় একক কোনো পক্ষের ওপর বর্তায় না। ব্রিটেনের উপনিবেশবাদী নীতি, জাতিসংঘের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয় সমর্থন, আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা—সব মিলিয়ে এই সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। এই সংকট সমাধানে দরকার নিরপেক্ষ কূটনীতি, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা। নতুবা, এটি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে থাকবে।