Posts

প্রবন্ধ

কবি আল মাহমুদের পূর্ব পুরুষের জন্মভিটা (নবীনগর) কাইতলা গ্রামের 'মীরবাড়ি'।

June 12, 2024

POSITIVE BANGLADESH

Original Author ড. এস এম শাহনূর

755
View

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি আল মাহমুদ। বাংলা কবিতার রাজধানীকে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের একক কৃতিত্ব আল মাহমুদের বলে অনেকেই তা স্বীকার করেন। কবি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই এক বর্ষণমুখর রাতে ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার দক্ষিণ মৌড়াইলে 'মোল্লাবাড়িতে' জন্মগ্রহণ করেন। কবির আসল নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। পিতার নাম মীর আব্দুর রব।প্রথমদিকে ওনার  কাপড়ের ব্যবসা ছিল৷ পরবর্তীতে বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসের অফিসার হন৷ মা রৌশন আরা বেগম ছিলেন আটপৌরে গৃহিনী। আসলে মৌড়াইল ছিল কবির নানার বাড়ি। কবির প্রপিতামহের (দাদার) পৈতৃকনিবাস ছিল একই জেলার নবীনগর উপজেলার কাইতলার 'মীরবাড়ি'। (কাইতলা গ্রামের প্রাচীন মীরবাড়ির সাথে আমার মা ও নানার বংশের রক্ত সম্পর্ক রয়েছে,তা অন্য একসময় আলোচনা করব) কবির দাদার নাম ছিল মীর মুনশী নোয়াব আলী। প্রপিতামহের (দাদার) বাবার নাম ছিল মীর আব্দুল গনি। ১৫০০ খৃষ্টাব্দের দিকে কবির পূর্বপুরুষগণ (সম্ভবত ইয়েমেন/পারস্য থেকে)একটি ইসলাম প্রচারক দলের সাথে ভাটির দেশে (বাংলাদেশ) আসেন।পরিবারটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাইতলা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেই ব্রিটিশ আমলেই কাইতলার মীর পরিবারটি ছিল ইসলামি রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অতিরক্ষণশীল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার।ধর্মীয় চেতনার কারণে ইংরেজি ভাষার প্রতি তাদের চরম বিদ্বেষ ছিল।অন্যদিকে পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। সেই রক্ষণশীল পরিবারের মূলে কুঠারাঘাত করেন কবির প্রপিতামহ মীর মুনশী নোয়াব আলী।  ব্রিটিশামলে একদিন পরিবারের অসম্মতিতে পিতৃপুরুষের প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি ও খানকার বাইরে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষ করে স্থানীয় আদালতে একটি চাকুরী গ্রহণ করেন৷পড়াশো ও চাকুরির প্রয়োজনে মীর মুনশী নোয়াব আলীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেই বসবাস করতে হত। এক সময় স্থানীয় ধনী ব্যবসায়ী মাক্কু মোল্লার এক কন্যাকে বিয়ে করেন৷ কুলীন প্রথানুযায়ী দুই বংশের মধ্যে মিল না থাকায় (উভয় বংশ মীর বংশ না হওয়ায়) কবির প্রপিতামহের বাবা মীর আব্দুল গনি ছেলের এ বিয়েকে কোনোদিনও মেনে নিতে পারেননি। এই বিয়ে তাঁর পিতৃপরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতাকে চিরস্থায়ী করে দেয়৷ মীর আব্দুল গনি অর্থাৎ কাইতলার মীর পরিবার ছেলের সাথে সকল সম্পর্কের ইতি টানলেন। অবশ্য  পিতার মৃত্যুশয্যায় পিতাকে শেষবারের মত দেখতে কাইতলার মীর বাড়িতে গিয়েছিলেন মীর মুনশী নোয়াব আলী।
কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অবাধ্য পুত্র সন্তানের উপর তখনও নারাজ ছিলেন মীর আব্দুল গনি। মৃত্যুর পূর্বে পুত্রের হাতে এক চামচ পানি গ্রহণেও অসম্মতি ছিল তাঁর।
পিতার মৃত্যুর পর অভিমান ও মনোকষ্টে মুনশী নোয়াব আলী আর কখনো কাইতলায় আসেননি৷

(আমার মত অখ্যাত কবি মনে করি) উপরোক্ত বর্ণনার সারসংক্ষেপ কিংবা পুরো ঘটনাটি যেন কবির লেখা কবিতায় ফুটে উঠেছে -
‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ/ 
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস/ 
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন/ 
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।’[৪]

পরিস্থিতি বিবেচনায় দয়ালু শ্বশুর মাক্কু মোল্লা জামাতাকে তাঁর অন্যান্য পুত্রদের সমান মর্যাদা ও বিপুল সম্পত্তির অংশ দিয়ে মোল্লাবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেন৷ সেই থেকে কবির প্রপিতামহ মুনশী নোয়াব আলী মৌড়াইল মোল্লাবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন।পরবর্তীতে তাঁর ঔরসে কবির পিতা মীর আব্দুর রবের জন্ম হয়। এবং মীর আব্দুর রবের ঔরসে কবি মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ জন্ম লাভ করেন।

১৯৯৮ সাল। উন্মুক্ত সাহিত্য সংগঠন থেকে “নব সাহিত্যের পাতা” নামক সাময়িকী প্রকাশের জন্য কবির নিকট শুভেচ্ছা বাণী সংগ্রহের জন্য গেলে আলাপচারীতার এক ফাকে বলেছিলেন,”শুনেছি আমার পূর্ব পুরুষদের কেউ কেউ কাইতলা গ্রামে গিয়ে বসতি গড়েছিল।তাই তোমাদের সকল কাজে আমার সহযোগিতা অবারিত”।কবির এ কথার সূত্র ধরেই আমার পক্ষে কাইতলা গ্রামের নামকরণের তথ্য উদঘাটন ও ইতিকথা লেখা সম্ভব হয়েছিল।

কবি আল মাহমুদ; যিনি তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় লিখেছেন:
‘আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পট্টিকেরা পুরীর গৌরব’।

কিন্তু, ‘লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশটি’ কোথায়? কোথায়-বা অবস্থিত ছিল পট্টিকেরা পুরী? এই সব প্রশ্নের নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি বোধ করি। কেননা, এই সব প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত রয়েছে বাঙালি নামক এক কাজল জাতির আত্মপরিচয়ের এক বিস্মৃত সময়ের ইঙ্গিত। কবির সেই অতীতযাত্রাকালে কবির অর্ন্তলোকে ইতিহাস চৈতন্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে এক অনাবিস্কৃত কাল। 
বলছিলাম যে লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশটি কোথায়? কোথায়-বা অবস্থিত ছিল পট্টিকেরা পুরী?
লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশটি ছিল বর্তমান কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড়ে। নবম-দশম শতকে ওখানেই ছিল পট্টিকেরা নগর। আর সে নগরে যে অনুপম সব অট্টালিকা ছিল সে তো অনুমান করাই যায়। ছিল রাজপথ, রাজপথে মন্থর গতিতে চলমান হাতি, শালের বন, দিঘী, দিঘীপাড়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু … আরো কত কী!আমরা পট্টিকেরা শব্দটির আরও দুটি শব্দ পাই।
(১) পট্টিকের; এবং
(২) পট্টিকেরক।(ইংরেজিতে Pattikera)
প্রাচীন বাংলার দুটি প্রধান ভৌগলিক বিভাগ হল সমতট এবং হরিকেল। ওই সমতট ও হরিকেলজুড়েই ছিল মধ্যযুগের বাংলার পট্টিকেরা রাজ্যের অবস্থান।বর্তমান মায়ানমারের আরাকান রাজ্যও ছিল এ পট্টিকেরারই অন্তর্ভূক্ত।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। লিখেছেন লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। অর্জন করেছেন পাঠকের ভালবাসা, পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৬) ওবাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮)।

'স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় আল মাহমুদ বলেছিলেন, 
‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ’। [৫]

কবির প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেছেন।২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দিন ৮৩ বছর বয়সে কবির জাগতিক ব্যক্তিসত্তার অবসান ঘটে।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইলে পারিবারিক কবরস্থানে মা বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাংলা সাহিত্যের  প্রাণপুরুষ আল মাহমুদ।

তথ্যঋণ:
[১] ছোট বেলায় আমার যেভাবে বেড়ে উঠা।।আল মাহমুদ

[২] কাইতলা দক্ষিণ ইউনিয়ন তথ্য বাতায়ন  http://kaitalasup.brahmanbaria.gov.bd/site/page/acbec34b-2144-11e7-8f57-286ed488c766/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%BE%20%E0%A6%A6%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A8%20%E0%A6%87%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A8%20%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8

[৩] কাইতলা গ্রামের নামকরণের ইতিকথা  http://www.deshdorshon.com/2019/09/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B0/

[৪] সোনালি কাবিন।। আল মাহমুদ 
[৫] লোক লোকান্তর।। আল মাহমুদ

Comments

    Please login to post comment. Login