সাল দুই হাজার উনিশ। কলেজ পার করেছি পাঁচ বছর হয়ে গেল, কিন্তু কলেজের বন্ধুদের সাথে ট্যুর দেয়া হয়নি একটাও, এইটা কোন কথা? আর তাই কিছুদিন ধরেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম জুলাই এর শেষের দিকে যাব ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখতে। কিন্তু এর আগেই এমন জোস একটা ট্যুর হয়ে যাবে তা কে জানত?!
পূর্বরাতের প্লানিং কথন
জুনের মাঝামাঝি সময়ের কথা। কোন এক বুধবার রাতে এগারটার দিকে হুট করে রিয়ার এর ফোন- “দোস্ত, কালকে ফ্রি আছিস?” জিজ্ঞাসা করলাম- “কেন?” “ঢাকার আশেপাশে ৫০০-৬০০ টাকার মাঝে ট্যুর দেয়া যাবে কই?” পালটা প্রশ্ন রিয়ারের।
বাকিটা বুঝে গেলাম।যদিও কাজ ছিল কিছু তাও মনে মনে ফ্রি হয়ে গেলাম। মাথায় আসলো ময়মনসিংহের কথা। বললাম, কিন্তু রাকিবের ময়মনসিংহ ঘুরা শেষ। তাই ময়মনসিংহ বাদ। তখনি মনে পড়ল জলদূর্গগুলো ঘুরার প্লান।
ষোড়শ শতাব্দীতে ঢাকাকে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তিনটি জলদুর্গ গড়ে তোলা হয়। জলদুর্গ তিনটি নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত। একই দিনে তিনটি জলদুর্গ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে আসা যায়। ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ ঘাটাঘাটি করে একটা প্লান পেয়েছিলাম। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে হচ্ছিল যাওয়ার কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। রিয়ার আর রাকিবকে বলতেই এককথায় রাজি। রাত বারোটায় ফোন দিলাম হৃদয়কে। বুঝায়ে বলতেই হৃদয়ও রাজি। আরিফ, আরিফ আর সাইফকেও জানানো হল কিন্তু হুটহাট নোটিশে ওদের আসা সম্ভব হল না।
রাতে কোন এক অজানা কারণে ঘুম আসলো না। অবশ্য এমনটা কয়েকরাত ধরেই হচ্ছিল। ঘুম আসতো সেই ভোরের দিকে। তাই ঘন্টা তিনেক বিছানায় এপাশ এপাশ করে উঠে পড়লাম সীতাকুন্ড ট্যুরের কাহিনী লিখতে।
যাত্রা শুরু
পরিকল্পনামত সাড়ে সাতটায় সবাই হাজির উত্তরা আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে। অনাবিল বাসে করে এসে নামলাম সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড থেকে বাস পাওয়া যায় চাষাড়া যাওয়ার, নামটা ভুলে গেছি। চাষাড়া নেমে একটা রোডসাইড রেস্টুরেন্টে ঢুকে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম।
আমাদের প্রথম গন্তব্য হাজীগঞ্জ দূর্গ। একটু হেঁটে অটো নিলাম। অটো সরাসরি নিয়ে নামিয়ে দিল নবীগঞ্জ গুদারাঘাটে। ঘাটের একটু আগেই ফায়ার স্টেশন। ফায়ার স্টেশনের পাশের গলি দিয়ে ঢুকলেই দুর্গের দেখা পাওয়া যাবে। যেহেতু ঘাটেই নামিয়ে দিয়েছে তাই ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে নদীর সৌন্দর্য্য দেখলাম।
হাজীগঞ্জ জলদুর্গ
খানিকপর উঠে রওনা হলাম দুর্গের দিকে। খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে দুর্গের প্রবেশদ্বারে পৌঁছাতে হয়। ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেলাম একদল ছেলে ক্রিকেট খেলছে। এমন বড় মাঠ পেলে কে না খেলে থাকবে? ভেতরে একটা বিশাল গাছ আর ছোটখাটো ভাঙাচোরা বিল্ডিং এর মত কিছু একটা আছে। এছাড়া আর পুরোটা বড় বড় ঘাসে ভর্তি, শুধু যে অংশটুকুতে খেলা হয় সেটুকু বাদে।
হাজীগঞ্জ দুর্গ দেখতে ষড়ভুজ আকৃতির। প্রতিটি কোণায় গোলাকৃতির মঞ্চ আছে, খুব সম্ভবত কামান বসানোর জন্য ছিল। এর মাঝে তিনটি মঞ্চ ছোট আর তিনটি বেশ বড়, ছোটগুলোর তুলনায় প্রায় তিন থেকে চারগুণ বড় একেকটা। কেল্লার দেয়ালগুলো বেশ প্রশস্ত, এক থেকে দেড় হাতের মত। দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্যা ছিদ্র আছে, খুব সম্ভবত বন্দুক আর তীর ছোঁড়ার জন্য ছিদ্রগুলো ব্যবহার করা হত। এছাড়াও হাঁটার জন্য দেয়ালের গা ঘেঁষে ভেতরের দিকে একহাতের মত জায়গা আছে।
বিবি মরিয়মের সমাধি
এবারে গন্তব্য বিবি মরিয়মের সমাধি। হাজীগঞ্জ দূর্গ থেকে বের হয়ে একটু পেছনের দিকে গেলেই কেল্লারপুল বাস স্টপ। বাস স্টপের পাশেই একটা রাস্তা ঢুকে গেছে ভেতরের দিকে। রাস্তা ধরে এগুলেই পাওয়া যাবে বিবি মরিয়ম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গেট। গেটের পাশ দিয়েই ভেতরে ঢুকার জন্য একটুখানি খোলা জায়গা আছে। ওদিক দিয়ে মসজিদটা চোখে পড়বে। ভেতরে ঢুকে একটু এগিয়ে গেলেই হাতের ডানে চোখে পড়বে বিবি মরিয়মের সমাধি।
ধারণা করা হয় বিবি মরিয়ম হচ্ছেন মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত রহমত বানু তথা পরীবিবির ছোট বোন তুরান দখত। বিবি মরিয়মের সমাধি শায়েস্তা খানের তৈরী বলেই তাদের ধারণা। লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে অবস্থিত পরীবিবির সমাধির সাথে আকৃতিতে বিবি মরিয়মের সমাধির কিছুটা মিল রয়েছে।
সমাধির ভেতরের চতুষ্কোণ কক্ষের ভেতরে শ্বেতপাথরে তৈরি তিন ধাপবিশিষ্ট কবরটি অবস্থিত। বাইরের বারান্দায় আরো বেশ কয়েকটি কবর দেখা যায়, যদিও সেগুলো কাদের কবর সেসম্পর্কে তেমন সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুরো দালানটি মাটি থেকে কিছুটা উঁচু ভিতের উপরে অবস্থিত। দালানের উপরে একটা গম্বুজও রয়েছে।
সমাধিক্ষেত্রের পাশেই একটা মসজিদ রয়েছে যেটি শায়েস্তা খান নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। যেহেতু বিবি মরিয়মের সমাধিক্ষেত্রের পাশেই অবস্থিত তাই মসজিদটিকে বিবি মরিয়ম মসজিদ বলেই অভিহিত করা হয়। মসজিদটি এখনো টিকে থাকলেও নামাজ পড়া হয় না এখানে এখন।
বিবি মরিয়মের সমাধি থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বরফকল ঘাটে। এবারে নদী পার হতে হবে। ঘাটে ঢুকার জন্য দিতে হয় ২ টাকা আর নৌকা ভাড়া ২ টাকা।
নদী পার হয়ে কাছেই আছে কদম রসুল দরগা। আমরা যাইনি দরগায়, তবে আপনি চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। গেলে ইসলামের নামে যা যা হচ্ছে তা দেখে হয়তো খারাপই লাগতে পারে। যাই হোক, নদী পার হয়ে আমরা রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেলাম সোনাকান্দা দুর্গে। যাওয়ার পথের বিবরণ দেয়ার মত কিছু নেই, তবে আপনার যদি স্পিডব্রেকারে এলার্জি থাকে তাহলে কিছুটা বিরক্তই হবেন।
সোনাকান্দা জলদুর্গ
সোনাকান্দা দুর্গটি হাজীগঞ্জের মত ষড়ভুজাকৃতির না, চতুর্ভুজাকৃতির। চতুর্ভুজের যেই বাহুটি নদীর দিকে মুখ করা সেই বাহুর মাঝ বরাবর বিশাল একটি গোলাকার মঞ্চ আছে কামান বসানোর জন্য। এছাড়াও চার কোণার চারটি গোলাকার মঞ্চ আছে। সোনাকান্দা দুর্গের দেয়ালও প্রায় এক থেকে দেড় হাত চওড়া আর অসংখ্যা ছিদ্রবিশিষ্ট।
হাজীগঞ্জ দুর্গের মত সোনাকান্দা দুর্গও এখন খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাঠের প্রস্থ বরাবর দুই জোড়া গোলপোস্ট বসানো আছে। চাইলে ফুটবল নিয়ে গিয়ে ফুটবল খেলতে পারেন।
হাজীগঞ্জ দুর্গের মতই এখানেও দেখার মত বিশেষ কিছু নেই। তবে প্রাচীন স্থাপত্যকলায় আগ্রহ থাকলে কিছুটা ভালো লাগতে পারে। বিশাল মঞ্চটার সামনের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিতে পারেন।
ছোট্ট একটু লঞ্চযাত্রা
সোনাকান্দা দূর্গ থেকে বের হয়ে আবার রিকশা নিলাম। এবারে গন্তব্য মদনপুর লঞ্চ ঘাট। আবারো কিছু স্পিডব্রেকারের খেলা পার হয়ে পৌঁছে গেলাম লঞ্চঘাটে। লঞ্চঘাটটা তেমন বড় নয়, অনেক ছোটই বলা চলে। মুন্সীগঞ্জের লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে করতে খানিকক্ষণ বিশ্রামও নিয়ে নিলাম।
প্রায় ত্রিশ মিনিট পর লঞ্চের দেখা মিলল। ঘাটের ফি ৫ টাকা দিয়ে উঠে পড়লাম লঞ্চে। প্রচন্ড গরমের জন্য পারতপক্ষে কেউ বের হয়নি, আর সেজন্য লঞ্চে ভীড় কমই মনে হচ্ছিল। আর প্রচুর রোদের কারণে সবাই ভেতরেই ছিল, তাই খালি জায়গা খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। গরম আর রোদের চিন্তা বাদ দিয়ে নদী আর দুই ধারের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো দেখতে লাগলাম। আর দেখার মত কিছু নেইও।
রাজধানী হোটেলের কাচ্চি!
মুন্সীগঞ্জ এসে যখন পৌঁছুলাম তখন বাজে দেড়টার একটু বেশি। দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেয়া প্রয়োজন। ঘাট থেকে বের হয়ে সোজা হেঁটে কিছুদূর আসতেই হাতের ডানে পেলাম রাজধানী হোটেল নামে একটা রেস্টুরেন্ট। ঢুকে পড়লাম।
জিজ্ঞাসা করে জানলাম ভর্তা আর ডালের বালাই নেই এখানে। ভাতের সাথে হয়তো মাছ, নয়তো মাংস। দামও মোটামুটি ভালোই। আর আছে তেহারী আর কাচ্চি। খাবারের চেহারা দেখতে গিয়ে দেখি মাছ-মাংস মোটামুটি তেলে চুবানো। পরে ভাবলাম তেলই যখন খেতে হবে এত টাকা দিয়ে, কাচ্চিই খাই। দিয়ে দিলাম অর্ডার- কাচ্চি আনেন।
কাচ্চি আসতেই চোখ কপালে। লম্বা চালের কাচ্চি, আবার একটু নাড়া দিতেই ভেতর থেকে উঁকি দিল একটা আস্ত সেদ্ধ ডিম- এখানে আমি এতটা আশা করিনি। ভেবেছিলাম নরমাল পোলাও চালের কাচ্চি হবে। কিন্তু বাসমতি বা এইরকম কোন একটা লম্বা চালের কাচ্চি, আবার সাথে ফুল সেদ্ধ ডিম- তাও ১৫০ টাকায়, এটা কল্পনাতেও আসেনি। মাংসের টুকরোটাও মোটামুটি ভালো সাইজের ছিল।
পরিমাণ দেখে ভেবেছিলাম কিছুটা কমই হবে, কিন্তু না, ভালো পরিমাণেই ছিল। খেতেও চমৎকার। পেট পুরলাম কাচ্চি দিয়ে, আর সাথে সফট ড্রিংক্স হিসেবে মাউন্টেইন ডিউ। আহা! আহা!! সাথে প্রচুর পরিমাণে পানিও খেয়েছিলাম।
ইদ্রাকপুর জলদুর্গ
খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রাম শেষে বেরিয়ে পড়লাম ইদ্রাকপুর দূর্গের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে বেশি দূরে নয় দূর্গটা। খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলাম। দূর্গ খোলে তিনটার দিকে। আমরা পৌঁছে গেছিলাম তিনটার আগেই। তাই দুর্গের বাইরের খোলা জায়গাটায় কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। ইদ্রাকপুর দূর্গের বাইরেও আলাদা নিরাপত্তা প্রাচীর ছিল। অনেক নিচু প্রাচীরটায় বসে খোশগল্প করতে ভালোই লাগছিল। এরই মাঝে দূর্গ খোলার সময় হয়ে গিয়েছিল।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল মোটামুটি বড় একটা পুকুর। ঢুকেই আগে চলে গেলাম পুকুরের ঘাটে। এই গরমে ঠান্ডা জল হয়তো খানিকটা স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু কিসের কী? এই গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে পুকুরের পানিও কিছুটা গরমই বলা চলে। উঠে পড়লাম ঘাট থেকে, দুর্গ দেখতে।
নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে কিছুটা হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা দূর্গের মত হলেও ইদ্রাকপুর দূর্গ অনেক দিক দিয়েই স্বতন্ত্র। চতুর্ভুজাকৃতির এই দূর্গের বাইরেও আলাদা প্রাচীর ছিল, যেটার কথা আগেই বলেছি। দূর্গের নিচে অস্ত্রাগার আর সুড়ঙ্গপথ আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও এই দূর্গের ভেতরে একটা পুরাতন জেলখানাও আছে। জেলখানাকে সংস্কার করে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার কাজ চলছে।
ইদ্রাকপুর দূর্গের মূল মঞ্চটা বেশ অনেকটা উঁচু আর বেশ বড়ও। গোলাকার এই মঞ্চ চতুর্ভুজের একটা বাহুর মাঝামাঝি অবস্থিত। পুরো দূর্গ ঘুরে দেখে জেলখানাটাও ঘুরে দেখলাম। জেলখানার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন, শুধু ওই উঁচু প্রাচীরটাই।
পথ হারানোর গল্প
সন্ধ্যে হতে আর ঘন্টা দুয়েক বাকি ছিল। তাই বের হলাম দূর্গ থেকে। এবারে গন্তব্য নগর কসবা। নগর কসবা মোটামুটি অনেকটা দূরে অবস্থিত। রিকশা নিয়ে যেতে হবে। ম্যাপে ‘Nagar Kosba’ আর ‘Nagar Kosba’ লিখে সার্চ দিয়ে আমি পাইনি। পরে অবশ্য খুঁজে পেয়েছিলাম, বানানটা ছিল ‘Nagar Kasba’.
যেহেতু খুঁজে পাইনি সেহেতু রিকশাওয়ালার উপর ভরসা করতে হয়েছিল। আর সে জায়গাটায়ই ধরা খেয়েছিলাম। তিন চারজন রিকশাওয়ালা চিনতে পারেনি। পরে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম যাবে কিনা, বোঝালাম চৌদ্দ-পনেরটা পুরান বাড়ি আছে ওই জায়গাটা চেনে কিনা। বলল চেনে। উঠে বসলাম রিকশায়।
অনেকদূর যাওয়ার পর কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল। আমি জানতাম নগর কসবার আশেপাশেই বাবা আদম মসজিদ আছে। ম্যাপে সার্চ দিলাম বাবা আদম মসজিদ লিখে। দেখে চক্ষু চড়কগাছ। পুরা উল্টোদিকে চলে এসেছি, তাও বহুদূর। পরে তাকে বললাম সিপাহীপাড়া নিয়ে যেতে। তখন সে পড়লো আকাশ থেকে। যাই হোক, কিছুটা তর্কাতর্কির পরে রওনা হলাম সিপাহীপাড়ার দিকে। তবে একথা না বললেই নয় যে রিকশাভ্রমণটা বেশ আনন্দদায়ক ছিল।
বাবা আদম মসজিদ
সিপাহীপাড়ার চৌরাস্তা থেকে একটু দূরেই বাবা আদম মসজিদ। রাস্তার পাশে নতুন একটা বেশ বড় মসজিদ। তার পাশ দিয়ে একটা গলি চলে গেছে। গলিটার মাথায়ই বাবা আদম মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আদম মসজিদটা বেশ সুন্দর।
উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বিক্রমপুরের তৎকালীন শাসক মালিক কাফুর। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় তৎকালীন সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের নির্দেশে। তবে ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে আমি একজনই মালিক কাফুরের খোঁজ পেয়েছি যিনি ছিলেন আলাউদ্দীন খিলজীর বিশ্বস্ত সেনাপতি ও পার্শ্বচর। মসজিদ নির্মানের সময় তার বেঁচে থাকার কথা নয়।
যাই হোক, নির্মাতা নেই হোক না কেন, মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে সুদূর বাগদাদ থেকে বাংলায় ইসলাম প্রচার করতে আসা বাবা আদম (রহ.) এর নামে। তৎকালীন হিন্দু শাসক বল্লাল সেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে মুসলমানদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন বাবা আদম। দশদিনব্যাপী এ যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে বল্লালসেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। যুদ্ধবিরতি চলাকালে মোরাকাবা করা অবস্থায় পেছন থেকে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করে বল্লাল সেন। পরবর্তীতে পঞ্চদশ শতাব্দীতে তার নামে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
বাবা আদম মসজিদ প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর এক চমৎকার নিদর্শন। এই মসজিদের উপরে ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। পূর্ব দিকের দেয়ালে তিনটি দরজা রয়েছে। এগুলোর মাঝে শুধু মাঝের দরজাটি বর্তমানে ব্যবহার করা হয়। মাঝের দরজা বরাবর উপরের দিকে আরবি হরফে লেখা একটি শিলালিপি আছে। মসজিদটির দেয়াল প্রায় চারফুট করে পুরু। ১০ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি, ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি- এই চার আকারের ইট ব্যবহার করা হয়েছে মসজিদটি নির্মাণে। এই মসজিদের আরো বেশকিছু বৈশিষ্ট্য একে সুলতানি শাসনামলের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও অলংকরণশৈলীর এক অসাধারন নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরেছে।
নগর কসবা
ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বেশি হলে আর চল্লিশ মিনিট পরেই মাগরিবের আজান দেবে। এদিকে নগর কসবার দেখা নেই। পরে আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম বেশ কিছুটা দূরে নগর কসবা অবস্থিত। অটোতে প্রতিজন দশ-পনের টাকা করে পড়তে পারে। একটা অটো নিয়ে চলে এলাম নগর কসবাতে।
নগর কসবাকে অনেকে পানাম এর সাথে তুলনা করে। কিন্তু আমি বলবোনা এটা পানামের মত। এটা ঠিক যে কিছু প্রাচীন দালান আছে কিন্তু সেখানে মানুষ বসবাস করে এখনো। তাই সেগুলোর বেশিরভাগই জোড়াতালি দেয়া অর্থাৎ প্রয়োজনমত নতুন ইট-চুন-সুরকি ব্যবহার করে কিছুটা অংশ বসবাসের যোগ্য করে তোলা হয়েছে। তাই পানামের মত ফিলটা পাওয়া যায় না। আর রাস্তাও বেশ সরু। প্রয়োজনীয় আলোও আসে না। তবে নগর কসবায় কিছু বিল্ডিং এর বাইরের দরজাটা আমার কাছে বেশ সুন্দর লেগেছে। বেশ কয়েকটা বিল্ডিং এ এখনো সেই প্রাচীন আমলের বিশাল প্রবেশপথের বেশ অনেকটাই অক্ষত আছে, সেইসাথে অক্ষত আছে মালিকদের নামও। চোখ মেলে তাকালে মাঝে মাঝে হয়তো চোখে পড়তে পারে পুরনো আমলের নকশার ভগ্নাংশও। তবে এইসবও যে আর বেশিদিন থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।
ধলেশ্বরীর পাড়
নগর কসবা থেকে বের হয়ে পাশের দোকানে বসেই পুড়ি, পেয়াজু, বেগুনী সহযোগে বিকেলের নাস্তাটা সেরে নিলাম। এবারে ফেরার পালা। দুপুরের লঞ্চজার্নিটা মাথা থেকে সরছিলই না। আর তাই লঞ্চে ফেরার প্লান করলাম। কিন্তু আশেপাশের মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম সন্ধ্যার পর কোন লঞ্চ নেই ঢাকার উদ্দেশ্যে। কি আর করার? রিকশা নিয়ে রওনা হলাম মুক্তারপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
রিকশা যাচ্ছিল ধলেশ্বরীর পাড় ঘেঁষে। নদীর অন্যপাড়ে দেখা যাচ্ছিল রঙবেরঙের আলো। মাঝে মাঝে লঞ্চ আর বড় নৌকা চলে যাচ্ছিল নদীর বুক চিড়ে। তীরে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ কানে এসে বাজছিল। এই জায়গা দিয়ে তো এমন অবহেলায় রিকশায় করে চলে যাওয়া যায় না। নেমে রিকশাওয়ালা মামাকে বিদায় করে দিলাম। নদীবিলাস করব পাড়ে বসে বসে, যত দেরিই হোক না কেন – তাই। রাতের শেষ বাস না পেলে দরকার হলে হেঁটে ঢাকা যাব- এমনই ভাবভঙ্গি ছিল আমাদের।
কিছুক্ষণ বসে থেকে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে মুক্তারপুর ব্রীজের নিচে এসে পড়লাম। এসে দেখি সোজা উপরে উঠার জন্য সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। আর কে পায়? সোজা উঠে গেলাম ব্রীজে। ব্রীজে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সোজা রাস্তা ধরে আবার হাঁটা দিলাম মুক্তারপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
ফেরার পালা
ভাগ্য ভালো ছিল তাই বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে হয়নি। একটা লেগুনা পেয়ে গেলাম যেটা চাষাড়া যাবে। ঝটপট উঠে পড়লাম।
চাষাড়া এসে বাসে করে এলাম সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড থেকে অনাবিলে চড়ে জ্যাম ঠেলে আজমপুর এসে নামলাম রাত সাড়ে এগারটায়। আর সেইসাথে সমাপ্তি ঘটল প্রাচীন বাংলার নিদর্শনে ভরপুর একটা ট্যুরের।