তরুণ বয়সে এ রোগটা বেশি হয়। কেউ নিজের চেহারার ব্যাপারে অতিশয় যত্নশীল হয়। সকাল-সন্ধ্যা নানা রকম প্রসাধনী লাগায়, নিজেকে ফিটফাট রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাড়ির লোকদের গালমন্দ শুনেও তার রূপচর্চা থামে না। ওই বয়সে পছন্দের ব্যক্তির চালচলন বা কোনো বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে অনুকরণের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। ফলে সবসময় আদর্শ নায়কের মতো নিজের ‘লুক’ পাওয়ার ব্যাপারে তারা তত্পর, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ‘ক্রেজি’ হয়ে ওঠে।
আবার কারো ক্ষেত্রে পোশাকের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতনতা দৃষ্টিগোচর হয়। সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ইস্ত্রি করা, পরিপাটি পোশাক পরে ঘর থেকে বেরোতে হবে। কোনো কারণে সেটা ব্যাহত হলে পরিবারের সবার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এমনকি মাঝেমধ্যে অভিমানে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দেয়। কেউ আবার চুলের ব্যাপারে অতিশয় তত্পর হয়। বিশেষ স্টাইলে চুল কাটা বা আঁচড়ানোর মধ্যেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়।
পাঠক, নিশ্চয়ই কিশোর বা তরুণ বয়সে আপনার বন্ধুদের মধ্যেও তেমন কেউ ছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলুন তো বহু বছর পর আজও কি তার সেই চর্চা অব্যাহত আছে? আমি বেশ কয়েকজনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানি। তারা সেগুলো চর্চা তো দূরের কথা, পরবর্তী সময়ে তাদের কেউ কেউ জীবনের বোঝা বইতে গিয়ে হয়েছে অতিশয় ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। জীবনযুদ্ধে পরাস্ত সৈনিকের মতো নিজেদের শরীরটাকে কোনো রকমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে!
আগে ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট না পেলে মায়ের সঙ্গে তুমুল রাগারাগি করত। এখন মাসের পর মাস তার পোশাক ধোয়ার সুযোগ মেলে না। চুলের বাহার করা বন্ধুটির পুরো মাথা টাক হয়ে গেছে। অথচ সেটা নিয়ে ‘মাথা ঘামানো’র সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। আবার নিত্যনতুন ফ্যাশনের চশমা পরা সহপাঠীর চোখে উঠেছে অনেক বেশি পাওয়ারের পুরু কাচের চশমা।
এবার বলুন, কেন এমন পার্থক্য হয়? তরুণ বয়সে যার জন্য সবকিছু ৎযাগ করা যেত, কালের পরিক্রমায় সেই বৈশিষ্ট্য বা কাজটি কেন তারা নিজ থেকেই ছেড়ে দেন? তাছাড়া মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরাই কেন-বা তাদের তেমন (রূপ, কেশ বা লাইফস্টাইল) চর্চার বিরোধিতা করতেন?
এ প্রশ্নের জবাব নিবন্ধের শিরোনামের মধ্যে আংশিক লুক্কায়িত আছে। অর্থাৎ জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় বাহ্যিক চেহারা, পোশাক-আশাক, চুলের বাহার আমাদের বাস্তব জীবনে খুব একটা সাহায্য করতে পারে না। কারণ ‘মাকাল ফল’ দেখতে যতই সুন্দর হোক, বাস্তবে তা কোনো কাজে লাগে না। ঠিক তেমনিভাবে তাদের ‘ফুলবাবু’ সেজে থাকার বৈশিষ্ট্য কর্মরত প্রতিষ্ঠানের বা নিয়োগকর্তার পারপাস সার্ভ করে না। তাদের দরকার আপনার গুণাবলি; যাকে মার্কেটিংয়ে বলা হয় ইউএসপি (Unique selling proposition)।
আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ বেকার। বছরের পর বছর তারা প্রত্যাশিত চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে আলাপে মেলে ঠিক তার উল্টো চিত্র। তারা নাকি প্রত্যাশিত মাত্রায় ‘কাজের লোক’ খুঁজে পাচ্ছেন না! অর্থাৎ একজন কর্মীর মধ্যে যেসব গুণাবলি বা দক্ষতা প্রত্যাশা করেন, অধিকাংশের মধ্যেই তারা সেটা দেখছেন না। ফলে চাহিদা ও জোগানের গরমিল ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
গোটা বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা ঘরে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে রয়েছে অতিমাত্রায় তত্পর। তেমন প্রেক্ষাপটে আমাদের কোটি কোটি তরুণ শুধুমাত্র গত্বাঁধা কিছু তত্ত্বকথা মুখস্থ করে নিজেদের যথেষ্ট যোগ্য ভাবতে শুরু করে! কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, তার মধ্যে এমন কী বিশেষ দক্ষতা রয়েছে, যার জন্য নিয়োগকর্তার তাকেই পছন্দ করা উচিত?
সন্তোষজনক জবাব নেই। অনেকের সেটা নিয়ে ভাবার বোধটুকুও অনুপস্থিত! অন্যদিকে নীতিনির্ধারকরা পাসের উচ্চহার ও সিজিপিএ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছেন। অথচ শিক্ষার কোনো একটা বিশেষ দিকে পরিবর্তন আনলে অন্তত এক যুগ সময় লাগে তা থেকে সত্যিকারের বেনিফিট পেতে। শিক্ষার পুরো পদ্ধতি ঢেলে সাজানোর সময় যে অনেক আগেই পার হয়েছে, খুব সম্ভবত আমরা এখনো সেটা ধরতে পারছি না।
যাহোক, বলছিলাম ইউএসপি প্রসঙ্গে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে প্রযুক্তিগত উত্কর্ষের কারণে প্রায় সবার পণ্যের বৈশিষ্ট্য (বা গুণগত মান) কাছাকাছি থাকছে। প্রতিযোগী তিনটি ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিংবা লবণের ব্র্যান্ডের কথা ভাবুন। সাধারণ একজন ক্রেতার পক্ষে (নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে) সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা সত্যিই কঠিন। বহুক্ষেত্রে সেটা অসম্ভব। তার পরও ক্রেতার কিন্তু স্পষ্ট অবস্থান থাকে বিশেষ কোনো ব্র্যান্ডের পক্ষে! এমনটা হওয়ার কারণ কী?
আসলে সেই ক্রেতার দৃষ্টিতে শীর্ষ পছন্দের ব্র্যান্ডের মধ্যে অন্তত এমন একটা বৈশিষ্ট্য আছে, যা প্রতিযোগী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত অথবা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। সেটা টেকসই, দৃষ্টিনন্দন, সাশ্রয়ী মূল্য, সহজে ব্যবহারযোগ্য এমনকি ফোনের পিক্সেলও হতে পারে। অথচ ফোনের মূল কাজ পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া, ছবি তোলা নয়! এখন প্রশ্ন হলো, মার্কেটিংয়ের এ শিক্ষাটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে কাজে লাগে?
ওই যে শুরুতে বললাম, রূপচর্চা, কেশবিন্যাস, পরিপাটি পরিচ্ছদ সেগুলোর আবেদন খুবই ক্ষণস্থায়ী। যে তরুণ যার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেলুনে বসে চুলের স্টাইল ঠিক করেন, সেই মেয়েটা হয়তো তাকে অতিক্রমকালে সরাসরি তার দিকে কখনো তাকায়ও না! কিংবা বহু কষ্টে সংগ্রহ করা দামি ব্র্যান্ডের সুগন্ধি তার নাসারন্ধ্র পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ পায় না। তাছাড়া সেগুলো ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে—ছেলে কী করে?
অর্থাৎ সে শিক্ষার্থী হলে লেখাপড়ায় কেমন? ছাত্রজীবন শেষ হলে কাজকর্ম কী করে? আয়-রোজগার কিংবা সামাজিক মর্যাদার আলোকে তার ভবিষ্যৎ কেমন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব নেতিবাচক হলে চুলের বাহার দেখে কেউ ভুলে না। আর সাময়িক ভুললেও তা স্থায়ী হয় না। তাই তরুণ বয়সে কিছু বিষয়ে ঝোঁক থাকলেও ক্রমেই যে প্রশ্ন সামনে আসা দরকার সেটা হলো, আমার টার্গেট গ্রুপ (সম্ভাব্য চাকরিদাতা, প্রেমিকা, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী) কেন আমাকে গ্রহণ করবে?
বিশেষায়ণের যুগে অনেক বিষয়ে গড় দক্ষতার চেয়ে বিশেষ কোনো বিষয়ে ফোকাস করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়। যেমন রুনা লায়লা শুরুতে নাচের চর্চা করতেন। কিন্তু একসময় তার বড় বোনের ওস্তাদ তাকে গানের প্রতি মনোযোগী হতে উৎসাহ দেন। একসময় দুটোই পাশাপাশি চলত। পরবর্তী সময়ে গানকে বেছে নিয়ে এরই মধ্যে পরিণত হয়েছেন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। দুটোর চর্চা অব্যাহত রাখলে হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনোটাই ঠিকমতো করা হতো না। তাই আপনার স্ট্রেন্থ ও উইকনেস বুঝে বিশেষ কোনো খাতে দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট থাকতে হবে।
তবে সে পথে হাঁটার আগে কয়েকটা বিষয়ে মনোযোগী হওয়া জরুরি। যে বিষয়ে আপনি দক্ষতা অর্জন করতে চাইছেন, তা কি টার্গেট গ্রুপের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে? সিঙ্গাপুরের ওয়েস্টিন স্ট্যামফোর্ড হোটেল শুরুতে তাদের প্রমোশনে একটা বৈশিষ্ট্য খুব হাইলাইট করেছিল। সেটা হলো, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত হোটেল! কিন্তু পর্যটকদের কাছে সেই ব্যাপারটা বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল না। ফলে তা তেমন সফলতা পায়নি। দ্বিতীয়ত, আপনার দক্ষতাটি দৃশ্যমানভাবে স্বতন্ত্র হতে হবে। আর পাঁচজন যা জানে, আপনিও তা জানলে সেটা বিশেষ কোনো ভ্যালু পায় না।
তার পরে সেই গুণাবলি যেন প্রদর্শনযোগ্য হয়। অর্থাৎ কাজের মাধ্যমে আপনি তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন। নইলে শুধু মুখের কথায় মানুষ আস্থা রাখবে কেন? অন্যরা চাইলেও যেন আপনার গুণাবলি কপি করতে না পারে, সেটাও খেয়াল রাখা দরকার। তাছাড়া সেটা যথাসময়ে করা উচিত। কারণ পড়ালেখা শেষ করে, কয়েক বছর এদিক-সেদিক চেষ্টা করে যখন কিছু হলো না, তখন যদি দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেন, তা বেশি দেরি হয়ে যেতে পারে। কারণ আর্থসামাজিক নানা প্রত্যাশা ও চাপ প্রতিনিয়ত আপনাকে পেছন দিকে টেনে ধরতে পারে।
ছাত্রজীবনে যথেষ্ট সময় হাতে রেখে সেগুলো শিখতে বা জানতে চেষ্টা করা উচিত। সর্বোপরি কথা হলো, আপনার যে বিষয়ে সত্যিকারের আগ্রহ রয়েছে বা করতে ভালো লাগে তেমন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট থাকা উচিত। তাহলে সেটাকে পরিশ্রম মনে হবে না, সহসা ক্লান্ত বোধ করবেন না। আনন্দের সঙ্গে সেই বিষয়ে লেগে থাকতে পারবেন।
তাই হেকমতের সঙ্গে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়াতে মনোযোগী হওয়া জরুরি। শুধু কিছু সনদ কর্ম জীবনে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না কিংবা কোনোমতে একটা চাকরি পেয়ে গেলেই শেখার কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। যখন অধিকাংশ মানুষ চাকরি হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকে তখনো কিন্তু কিছু মানুষকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে টানার জন্য টপ বসেরা তত্পর থাকেন। বারবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যেন সেই ব্যক্তি তাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন!
এমনটা হওয়ার কারণ কী? আসলে সেই মানুষগুলো নিজেদের কর্মদক্ষতা ও গুণাবলি দিয়ে এরই মধ্যে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে তাদের নিলে সেই প্রতিষ্ঠান নানাভাবে উপকৃত হবে। এটাই তাদের ‘বিক্রয়যোগ্য’ হয়ে ওঠার মূল রহস্য।
নোট: বিক্রয় বিষয়ে অধিকতর জানতে লেখকের ফেইলিওর ইন সেলস বইটি পড়তে পারেন।