পর্ব-২
গাড়ি ছুটে চলছে সুনামগঞ্জের দিকে| আমি রাস্তার দুইধারে প্রকৃতি দেখতে দেখতে গান শুনছি|আমাদের দেশটা যেকত সুন্দর তাকংক্রিটের জঞ্জাল ঢাকায় থেকে বোঝা যায় না! দুইদিকে সবুজ মাঠ এবং পাটক্ষেত এবং দূরে নীল পাহাড়, এক কথায় অসাধারণ|সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এই ধরণের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে কার ভালো লাগবে না?নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে এবং মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমার বস সজীব ভাইকে, কারণ সুনামগঞ্জ আমাকে দেয়ার আগে উনি আমার সাথে আলোচনা করেছিলেন:
সজীব ভাই: "দেখ নীরব, সুনামগঞ্জে কাজ করাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং, নদী এবং হাওর পথে ট্রলারে করে সাইটে যেতে হবে!"
আমি:" কোনো সমস্যা নাই ভাই!"
সজীব ভাই:"তুমি সাঁতার পারো?"
আমি:"না"
সজীব ভাই: "তাহলে? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে?"
আমি:"মরতে একদিন সবাইকে হবে, কেউ আগে, কেউবা পরে"
সজীব ভাই:"তাই নাকি? আচ্ছা? ভেবে দেখ, তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমাকে মিস করবে!"
আমি: "আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই! আমি ঢাকা থেকে দূরে থাকতে চাই, আমার ঢাকায় থাকতে ভালো লাগেনা!"
সজীব ভাই:"ওকে, ডান!, তুমি পরশু থেকে সুনামগঞ্জের দায়িত্ব নিচ্ছো| ওইজেলায় যাবতীয় সিভিল ওয়ার্কস এর দায়িত্ব তোমার, আমি তোমাকে সব প্রজেক্ট গুলার ড্রয়িং দিচ্ছি, এগুলো দেখ আর কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ঠিক আছে?
আমি:"জি, আচ্ছা"
সজীব ভাই আর দশটা বসের মতন না যে সবসময় চোখে চোখে রাখবে - আমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছি কিনা! উনি কাজের দায়িত্ব দিতে পছন্দ করেন এবং দূর থেকে তদারকি করেন যে কাজ কেমন হচ্ছে! আমি সব সময় এরকম বসমনে মনে খুজতাম| যাই হোক, এতো দ্রুত একজন মানুষের সম্পর্কে কোনো উপসংহারে যাওয়া ঠিক না, তবুও যে সমস্ত বসদের সাথে এর আগে কাজ করেছি তাদের কিছু সংলাপ দিচ্ছি:
একজন: "আপনাকে না কাজটা কাল শেষ করতে বলেছিলাম, এখনো করতে পারেন নাই! মনে রাখবেন, ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না!"
আরেকজন: "আপনি তো এই মাসে কোনো সেল করতে পারেন নাই, এই মাসে আপনার স্যালারি হবে না!"
মাঝে মাঝে ভাবি, দেশের একনম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরেও এই সমস্ত কথা শুনতে হয়! কিছু কিছু বন্ধুকে দেখেছিলাম পাশ করার পরপরই দেশ ছাড়তে, এবং দেশ ছাড়ার আগে আমার সবচে অপছন্দের কথা বলে বিদায় নিতো: "তুই বুঝবি আসলে দেরিতে!"
যাই হোক, দেখা যাক আমার এই সমস্ত বন্ধুদের ভুল প্রমান করতে পারি কিনা! সেইচিন্তাথেকেইমোবাইলকোম্পানিতেচাকরিনেওয়া!
সুনামগঞ্জ ঘাটে এসে পৌঁছাতে ২ঘন্টা লেগে গেলো সিলেট শহর থেকে| গাড়ি আর ফজলু ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম ট্রলার ভাড়া করার জন্য| ইতিমধ্যে কিছু কিছু সিলেটি বলা শিখে গেছি| ভাবলাম দেখি প্রয়োগ করা যায় নাকি...গেলাম একট্রলার এর চালক এর কাছে:
আমি: "কিতারেবা, ভালাআসোনি?" (কিভাই, ভালোআছেন?)
চালক:"জিওয়, ভালাভালা, খইযাইতা? (জি, ভালো, কইযাবেন?)
আমি: "মান্নানঘাটও, খতলইবা?( মান্নানঘাটে, কতনিবেন?)
চালক:"২৫০টেখা" (২৫০টাকা)
আমি: "লোউক্কা" (চলেনযাই)
এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম মনেহয়, আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের মোবাইল কোম্পনির প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোম্পানির সাইট একুইজিশন টিমের একভদ্রলোক (গলায়আইডিকার্ডঝুলানো), বেশ কেতাদুরস্ত, অনেক্ষন আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো| সে হয় তো মনে করছিলো যে ঢাকার টেকনিক এখানে ও কাজ করবে| সে আমার ট্রলার এর পাশের চালকের কাছে গিয়ে শুরু করলো:
সে: "এই যাবি নাকি?"
চালক: "খই যাইতা?" (কইযাবেন?)
সে: "মান্নানঘাট, কতনিবি?"
চালক:"৬০০টেখা" (৬০০টাকা)
সে: "পাশের লোকটা একই জায়গায় যাচ্ছে ২৫০টাকায়!, তুই আমার সাথে ফাইজলামি করিস?"
চালক: "হে সিলোটিফুয়া" (সেএকজন সিলেটি ছেলে)
আমার ট্রলার এর চালক ট্রলার স্টার্ট করছিলো আর আমি ট্রলার এ বসে মজা দেখছিলাম! মনে মনে হাসলাম, আমি এখন "সিলোটিফুয়া"- যাক ভালোই হলো ব্রিটিশ-আমেরিকানদের টেকনিক প্রয়োগ করলাম-যস্মিন দেশে যদাচার!
ট্রলার চলতে শুরু করলো..আর আমি বসে বসে নদীর দুই পারের দৃশ্য দেখতে লাগলাম| মনে পরে গেলো ছোটকালে পড়া রচনা 'এজার্নিবাইবোট'| নদীর দুই তীরে মানুষজন কাপড় কাঁচছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গোসল করছে আর সাঁতার কাটছে, মেয়েরা ঘর-গৃহস্থালির কাজ করছে, যেমনটা পড়েছিলাম ওই রচনায়..দেশের নদীতে আমার এই প্রথম নৌকাভ্রমণ| খুবভালোলাগছিলো| দূরথেকে দেখলাম স্টীমার আসছে ভেপু বাজাতে বাজাতে, কেউ কেউ অতীব আনন্দের সাথে নদী দূষণ করছে (বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নিন)|
নদীর ঢেউগুলোর মধ্যে কেমন জানি একটা অদ্ভুত তাল আছে, যেটি শুধুমাত্র অনুভব করা যায়, কেউ কেউ হয়তো অনুভব করতে পেরেছে, আমার মনে হয় আমি কিছুটা পেরেছি! ট্রলার এর ঢেউ এর তালে ওই দুলুনি আমার বেশ লাগছিলো, আর নদীর হাওয়া? তারতো কথাই নেই, খুবই আরামদায়ক আর বায়ুদূষণমুক্ত,| ঢাকায়তো আমরাএকধরনের গ্যাস চেম্বারে বসবাস করি, কারো কোনো হুশ হয়না, সবাই শুধু ছুটছে আর ছুটছে আর পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে প্রাণপনে |পৃথিবীর বুকে আমরা সম্ভবত একমাত্র জাতি যারা পঙ্গপালের মতন রাজধানীর বাইরে থেকে রাজধানীতে আসার স্বপ্ন দেখি! আমাদের খালি স্বপ্ন আর স্বপ্ন! কিন্তু বাস্তবায়নের না আছে কোনো পরিকল্পনা না সদিচ্ছা, শুধু ফাঁকাবুলি, যাইহোক, মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো এসব ভেবে, কি হবে এইগুলা ভেবে? এইসব সমস্যার কোনো সমাধান হবে বলে আমার মনে হয়না, তাই আমি আবার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীতে মনোনিবেশ করলাম এবং গুন্গুন্করে গাইতে শুরু করলাম:
“ও রে নীল দরিয়া...
আমায় দে রে, দে ছাড়িয়া
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায় রে
কান্দে রইয়া রইয়া
কাছের মানুষ দূরে থুইয়া...
মরি আমি ধড়পড়াইয়া, রে”
মনে মনে ভাবছিলাম বেড়ে উঠেছি এই দেশে, কিন্তু কখনো এরকম নদীতে ভ্রমণ করি নাই! জন্মের পর এ পর্যন্ত বিদেশ গিয়েছি তিনবার, দেশের বাইরে ছিলাম তিন বছর!
সাধে কি আর কবি গুরু রবি ঠাকুর বলেছেন:
"বহুদিনধরে বহু পথ ঘুরে বহু ব্যয় করে বহুদেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু!"
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ: এই লেখার প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক এবং এই লেখা কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীকে অপমানিত করার জন্য নয়!
নিজের অজান্তে যদি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ||)