পোস্টস

গল্প

হাহাকারের পেছনে লুকানো ভালোবাসা

১৪ জুন ২০২৪

শাহ আমান উল্লাহ

**হাহাকারের পেছনে লুকানো ভালোবাসা**

 

একটি ছোট্ট গ্রাম, পাহাড়ের কোলে বসে থাকা, যেখানে প্রতিদিনের জীবন ছিল সরল ও মিষ্টি। সেখানে বাস করত মীরা, এক শান্তশিষ্ট মেয়ে, যার চোখে ছিল সমুদ্রের গভীরতা এবং হাসিতে ছিল নির্মলতার আভা। আর ছিল আর্য, এক সাধারণ কৃষক যার হৃদয় ছিল সোনার মতো খাঁটি এবং সাহস ছিল পর্বতের মতো দৃঢ়।

 

মীরার দিনগুলো কাটত গ্রামের ছোট স্কুলে বাচ্চাদের পড়িয়ে, আর সন্ধ্যায় সে গ্রামের নদীর তীরে বসে প্রিয় বই পড়ত। আর্য প্রতিদিন মাঠে কাজ করত, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, গ্রামের সবাইকে তাজা ফসল সরবরাহ করত। তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল এক মেলার দিনে, যেখানে মীরা তার বান্ধবীদের সাথে আর্যর স্টল থেকে কিছু ফল কিনছিল।

 

“এই ফলগুলো কি একেবারে তাজা?” মীরা জিজ্ঞাসা করল, তার চোখে এক চমৎকার মিষ্টি হাসি।

 

“আপনি নিজেই দেখুন,” আর্য বলল, তার গলায় সামান্য কাঁপন। মীরার চোখের মায়াবী দৃষ্টিতে সে কিছুক্ষণ আটকে রইল।

 

তাদের এই ছোট্ট কথোপকথন থেকে শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত সম্পর্ক, যা সময়ের সাথে সাথে গভীর হতে লাগল। মীরা আর্যর জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে যেত, আর আর্য প্রতিদিন মীরার জন্য তার প্রিয় ফুলগুলো এনে দিত। গ্রামের মানুষ তাদের এই বন্ধুত্বকে প্রশংসা করত, কারণ তারা জানত, মীরা এবং আর্য একে অপরের জন্য সৃষ্টি।

একদিন, এক ঝড়ো রাতে, মীরার বাড়িতে হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটে। এক আগুন লেগে মীরার বাড়ি পুড়ে যায়। আর্য খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে যায়, কিন্তু যখন সে পৌঁছায়, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। মীরা তার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির সামনে বসে, চোখে জল, আর্যকে দেখে কাঁদতে লাগল।

“মীরা, চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আর কিছুতেই কষ্ট পেতে দেব না,” আর্য তাকে আশ্বস্ত করল।

আর্য মীরাকে তার বাড়িতে নিয়ে এল, তার পরিবারের সাথে থাকার জন্য। তাদের এই কষ্টের সময়, তারা একে অপরের সাথে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ল। আর্য মীরাকে কখনও একা থাকতে দিত না, সবসময় তার পাশে থাকত, তাকে সাহস যোগাত।

কিন্তু বিধাতা যেন তাদের এই সুখ সহ্য করতে পারছিল না। একদিন, আর্য যখন মাঠে কাজ করছিল, হঠাৎ এক সাপের কামড়ে তার শরীর অবশ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু আর্যর অবস্থা ছিল গুরুতর।

মীরা হাসপাতালে পৌঁছে আর্যর হাত ধরে বসে ছিল। তার চোখে অশ্রু, আর হৃদয়ে ছিল এক অসম্ভব যন্ত্রণা। “আর্য, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না,” মীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল।

আর্য মৃদু হাসল, তার কণ্ঠস্বর দুর্বল কিন্তু দৃঢ়। “মীরা, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, চিরকাল। তুমি আমার ভালোবাসার প্রতীক, আর আমি তোমার হৃদয়ে বাস করব। কখনও মনে করবে না আমি দূরে আছি। তুমি আমার প্রাণের আত্মা।”

মীরা আর্যর হাত শক্ত করে ধরে থাকল, যতক্ষণ না সে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। আর্য চলে গেল, কিন্তু মীরার হৃদয়ে তার ভালোবাসা চিরকাল রয়ে গেল।

মীরার জীবন এরপরেও চলতে থাকল, কিন্তু আর্যর স্মৃতি তার সঙ্গী হয়ে রইল। গ্রামের মানুষ তাদের এই অনন্ত ভালোবাসার গল্পকে শ্রদ্ধা জানাত, আর মীরা প্রতিদিন নদীর তীরে বসে আর্যর স্মৃতিচারণ করত, তার প্রিয় বই হাতে।

মীরার জীবনের প্রতিটি ধাপ ছিল আর্যর ভালোবাসায় ভরপুর, আর সেই ভালোবাসা তাকে বেঁচে থাকার শক্তি যোগাত। হাহাকারের পেছনে লুকানো এই ভালোবাসা তাকে প্রতিদিন নতুন করে জীবন উপহার দিত। আর্য হয়তো শারীরিকভাবে মীরার পাশে ছিল না, কিন্তু তার ভালোবাসা মীরার হৃদয়ে অমর হয়ে রইল, এক চিরন্তন কাব্যের মতো।