বাবার আদরের একমাত্র কণ্যা সারে তিন বছরের টুনটুনির খুশি আর ধরছে না; সকাল থেকে আনন্দের আতিশয্যে রীতিমত লাফাচ্ছে চাচ্চুর বাসায় যাবে বলে; আমিও লাফাচ্ছি তবে মনে মনে। শত হলেও আমি এখন বড় হয়েছি, ক্লাস টু তে পড়ি; বাচ্চাদের মত লাফানো আমাকে মানায় না।
প্রায় ৪০ দিন কষ্টের পরে আজ বেশ আনন্দ লাগছে। বাবা মারা যাওয়ার পর এই চল্লিশটা দিন আমাদের অনেক কষ্টে কেটেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে; এসেই বাবার কথা মনে করে কান্না করছে, সাথে মা ও কান্না শুরু করে দেয়। আর ভাল লাগছিল না। গতকাল চল্লিশা হয়ে যাওয়ার পর থেকে মানুষজন অনেকটাই কমে গেছে। মায়ের কান্না ভেজা মুখ কম দেখতে হচ্ছে এটাই সবচেয়ে বড় স্বান্তনা।
তবে আজ আমাদের ভাই বোনের আনন্দের উৎস আলাদা। আজ হাশেম চাচ্চু আসবে দুপুরের দিকে। এখন থেকে আমরা ওনার বাসাতেই থাকব। অনেক বড় বাড়ি ওনার আর খুব সুন্দর করে গুছানো। চাচী একটু কেমন যেনো; একটু দুষ্টুমি করলেই রাগি গলায় বকা দেন। একবার চাচার বাসা থেকে ঘুরে এসে মায়ের কাছে বিচার দিলে মা বলেছিল চাচী নাকি অনেক ভাল, আমাদের অনেক আদর করেন, শুধু রাগটা একটু বেশি এই আর কি। কিন্তু তারপর থেকে শত চাইলেও মা আর আমাদেরকে চাচ্চুর বাসায় খুব একটা যেতে দিতেন না। কিন্তু আজ কত্ত আনন্দের দিন আমাদের! আজ থেকে আমরা শুধু বেড়াতে নয় সবসময়ের জন্যই চাচ্চুর বাসায় চলে যাব। চাচ্চুর বাসাই হবে আমাদের বাসা। মা তো বাড়িওয়ালা আংকেলের সাথে কথা বলার সময় তেমনটাই বলছিলেন।
মা অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছেন, হয়ত আজই চলে যেতে হবে চাচ্চুর সাথে আমাদের। এই বাড়ির বাড়িওয়ালাকে তেমনভাবেই জানানো হয়েছে। আমি তো মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি চাচী যতই চোখ কুচকে তাকান না কেনো আমি প্রতিদিন ছাদে যাবই। চাচ্চুর বাসার ছাদটা যা সুন্দর!
অপেক্ষা করতে করতে টুনটুনিটা কখন যেনো ঘুমিয়ে পরেছে। আমি ঠায় বসে আছি। আজ যে চকলেটগুলো চাচ্চু নিয়ে আসবে, তারমধ্য থেকে আগেই বেছে বেছে মজার চকলেটগুলো নিয়ে নেবো, তারপর স্কুলে যাওয়ার পথে খাবো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি মার হাত ব্যাগে খুব সামান্য কিছু টাকা আছে, এই দুইশ পনের টাকার মত হবে হয়ত। মায়ের কাছে বেশ কিছুদিন চকলেটের জন্য টাকা চাওয়া যাবে না। তবে ওসব নিয়ে চিন্তা এখন না করলেও হবে, চাচ্চু তো আছেই।
দুপুর তিনটার দিকে চাচ্চু এলো। আমি চাচ্চুকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। চাচ্চু আমায় কোলে নিয়ে বললেন কিরে তোর মা কোথায়? আমার অফিস আছে আবার যেতে হবে।
মায়ের সাথে মিনিট পনের কথা বললেন; অনেকবার দুঃখ প্রকাশ করলেন একই শহরে থেকেও বাবার চল্লিশাতে না আসতে পারায়।
আমি খুব অস্থির হয়ে আছি; কখন আমরা চাচ্চুর বড় গাড়িটাতে করে রওনা দিব। মায়ের সাথে তো চাচ্চু কথাগুলো গাড়িতে বসেও সেরে নিতে পারে।
এইসময় চাচ্চু বলল ‘ভাবী, ভাইয়ার জামাকাপড়গুলা কই?’ মা আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই চাচ্চু একে একে বাবার শার্ট, প্যান্ট, বেল্ট, টাই, স্যুট সব নিয়ে মাকে বলল ভাবী এই কাপড় চোপড়গুলো নিয়ে গেলাম; খালি খালি পরে থেকে নষ্ট হবে। আমার আর ভাইয়ার মাপ তো প্রায় একই। তোমরা ভাল থেকো। আর কিছু লাগলে আমাকে কিন্তু ফোন দিও।
মা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, হয়ত ভাবছে তার হাতব্যাগের টাকাগুলো দিয়ে আর কতদিন যাবে!
আমি দৌড়ে গেলাম টুনটুনিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। গিয়ে দেখি ও দরজার পেছনে ঘুটসুটি মেরে বসে আছে; বুকে দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরা বাবার অফিসে পরে যাবার কালো জুতো জোড়া। প্রতিদিন সকালে বাবা যখন অফিসের জন্য রেডি হতো তখন আমার কাজ ছিল বিছানার উপর গুছিয়ে রাখা ইস্ত্রী করা শার্টের ভাজ খুলে দেয়া আর বাহারী টাইয়ের গায়ে আলতো করে হাত বুলানো। বাবাকে প্রায়ই বলতাম আমি বড় হলে কিন্তু তোমার টাইগুলো সব আমাকে দিয়ে দিতে হবে, আমি তোমার মত শার্ট ইন করে পরে সাথে টাই পরে ঘুরে বেড়াবো। বাবা হেসে বলতো তুই এই পুরানো টাই দিয়ে কি করবি! ততোদিনে এই ডিজাইনের টাইয়ের চল চলে যাবে; আমি তোকে লেটেস্ট ডিজাইনের সুন্দর সুন্দর টাই কিনে দেবো। সেগুলো পরে অফিসে যাবি, আর তোকে দেখে সবার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। আমি গো ধরে বলতাম আমার এগুলোই চাই। বাবা আমার আর টুনটুনির সাথে কথা বলতে বলতে রেডি হয়ে নাস্তা শেষ করে যখন অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হতো তখন টুনটুনির কাজ ছিল কালো জুতো জোড়া দরজার কাছে রেখে আসা; সে এই কাজকে তার মহান দায়িত্ব মনে করত।
সেদিনের পরেও অনেকদিন পর্যন্ত টুনটুনি প্রতিদিন সকালে বাবার জুতো জোড়া দরজার কাছে রেখে আসত। তারপর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জুতো জোড়া শেল্ফে এনে রেখে দিত।
ভাগ্যিস চাচ্চু সেদিন বাবার জুতো জোড়া পায়নি।
সমাপ্ত।
প্রায় ৪০ দিন কষ্টের পরে আজ বেশ আনন্দ লাগছে। বাবা মারা যাওয়ার পর এই চল্লিশটা দিন আমাদের অনেক কষ্টে কেটেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে; এসেই বাবার কথা মনে করে কান্না করছে, সাথে মা ও কান্না শুরু করে দেয়। আর ভাল লাগছিল না। গতকাল চল্লিশা হয়ে যাওয়ার পর থেকে মানুষজন অনেকটাই কমে গেছে। মায়ের কান্না ভেজা মুখ কম দেখতে হচ্ছে এটাই সবচেয়ে বড় স্বান্তনা।
তবে আজ আমাদের ভাই বোনের আনন্দের উৎস আলাদা। আজ হাশেম চাচ্চু আসবে দুপুরের দিকে। এখন থেকে আমরা ওনার বাসাতেই থাকব। অনেক বড় বাড়ি ওনার আর খুব সুন্দর করে গুছানো। চাচী একটু কেমন যেনো; একটু দুষ্টুমি করলেই রাগি গলায় বকা দেন। একবার চাচার বাসা থেকে ঘুরে এসে মায়ের কাছে বিচার দিলে মা বলেছিল চাচী নাকি অনেক ভাল, আমাদের অনেক আদর করেন, শুধু রাগটা একটু বেশি এই আর কি। কিন্তু তারপর থেকে শত চাইলেও মা আর আমাদেরকে চাচ্চুর বাসায় খুব একটা যেতে দিতেন না। কিন্তু আজ কত্ত আনন্দের দিন আমাদের! আজ থেকে আমরা শুধু বেড়াতে নয় সবসময়ের জন্যই চাচ্চুর বাসায় চলে যাব। চাচ্চুর বাসাই হবে আমাদের বাসা। মা তো বাড়িওয়ালা আংকেলের সাথে কথা বলার সময় তেমনটাই বলছিলেন।
মা অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছেন, হয়ত আজই চলে যেতে হবে চাচ্চুর সাথে আমাদের। এই বাড়ির বাড়িওয়ালাকে তেমনভাবেই জানানো হয়েছে। আমি তো মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি চাচী যতই চোখ কুচকে তাকান না কেনো আমি প্রতিদিন ছাদে যাবই। চাচ্চুর বাসার ছাদটা যা সুন্দর!
অপেক্ষা করতে করতে টুনটুনিটা কখন যেনো ঘুমিয়ে পরেছে। আমি ঠায় বসে আছি। আজ যে চকলেটগুলো চাচ্চু নিয়ে আসবে, তারমধ্য থেকে আগেই বেছে বেছে মজার চকলেটগুলো নিয়ে নেবো, তারপর স্কুলে যাওয়ার পথে খাবো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি মার হাত ব্যাগে খুব সামান্য কিছু টাকা আছে, এই দুইশ পনের টাকার মত হবে হয়ত। মায়ের কাছে বেশ কিছুদিন চকলেটের জন্য টাকা চাওয়া যাবে না। তবে ওসব নিয়ে চিন্তা এখন না করলেও হবে, চাচ্চু তো আছেই।
দুপুর তিনটার দিকে চাচ্চু এলো। আমি চাচ্চুকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। চাচ্চু আমায় কোলে নিয়ে বললেন কিরে তোর মা কোথায়? আমার অফিস আছে আবার যেতে হবে।
মায়ের সাথে মিনিট পনের কথা বললেন; অনেকবার দুঃখ প্রকাশ করলেন একই শহরে থেকেও বাবার চল্লিশাতে না আসতে পারায়।
আমি খুব অস্থির হয়ে আছি; কখন আমরা চাচ্চুর বড় গাড়িটাতে করে রওনা দিব। মায়ের সাথে তো চাচ্চু কথাগুলো গাড়িতে বসেও সেরে নিতে পারে।
এইসময় চাচ্চু বলল ‘ভাবী, ভাইয়ার জামাকাপড়গুলা কই?’ মা আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই চাচ্চু একে একে বাবার শার্ট, প্যান্ট, বেল্ট, টাই, স্যুট সব নিয়ে মাকে বলল ভাবী এই কাপড় চোপড়গুলো নিয়ে গেলাম; খালি খালি পরে থেকে নষ্ট হবে। আমার আর ভাইয়ার মাপ তো প্রায় একই। তোমরা ভাল থেকো। আর কিছু লাগলে আমাকে কিন্তু ফোন দিও।
মা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, হয়ত ভাবছে তার হাতব্যাগের টাকাগুলো দিয়ে আর কতদিন যাবে!
আমি দৌড়ে গেলাম টুনটুনিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। গিয়ে দেখি ও দরজার পেছনে ঘুটসুটি মেরে বসে আছে; বুকে দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরা বাবার অফিসে পরে যাবার কালো জুতো জোড়া। প্রতিদিন সকালে বাবা যখন অফিসের জন্য রেডি হতো তখন আমার কাজ ছিল বিছানার উপর গুছিয়ে রাখা ইস্ত্রী করা শার্টের ভাজ খুলে দেয়া আর বাহারী টাইয়ের গায়ে আলতো করে হাত বুলানো। বাবাকে প্রায়ই বলতাম আমি বড় হলে কিন্তু তোমার টাইগুলো সব আমাকে দিয়ে দিতে হবে, আমি তোমার মত শার্ট ইন করে পরে সাথে টাই পরে ঘুরে বেড়াবো। বাবা হেসে বলতো তুই এই পুরানো টাই দিয়ে কি করবি! ততোদিনে এই ডিজাইনের টাইয়ের চল চলে যাবে; আমি তোকে লেটেস্ট ডিজাইনের সুন্দর সুন্দর টাই কিনে দেবো। সেগুলো পরে অফিসে যাবি, আর তোকে দেখে সবার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। আমি গো ধরে বলতাম আমার এগুলোই চাই। বাবা আমার আর টুনটুনির সাথে কথা বলতে বলতে রেডি হয়ে নাস্তা শেষ করে যখন অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হতো তখন টুনটুনির কাজ ছিল কালো জুতো জোড়া দরজার কাছে রেখে আসা; সে এই কাজকে তার মহান দায়িত্ব মনে করত।
সেদিনের পরেও অনেকদিন পর্যন্ত টুনটুনি প্রতিদিন সকালে বাবার জুতো জোড়া দরজার কাছে রেখে আসত। তারপর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জুতো জোড়া শেল্ফে এনে রেখে দিত।
ভাগ্যিস চাচ্চু সেদিন বাবার জুতো জোড়া পায়নি।
সমাপ্ত।