পোস্টস

চিন্তা

চাহিদা বনাম দায়িত্ব

১৫ এপ্রিল ২০২৪

সামান্থা সাবেরিন

মূল লেখক সামান্থা সাবেরিন

  মানুষ তার জীবন পরিচালনার জন্য কিছু  চাহিদার মুখাপেক্ষী। মৌলিক  চাহিদার মধ্যে আছে খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান, শিক্ষা  ও চিকিৎসা ইত্যাদি।সেই সাথে অন্যান্য  অনেক মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাও আছে।  আছে ব্যক্তিগত , পারিবারিক,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়  দায়িত্ব। সভ্যতার আবর্তনে চাহিদাগুলোর আকার, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ঠ্য বদলাতে থাকে। কিন্তু দায়িত্বগুলো অনেকাংশেই  অপরিবর্তনশীল। মানুষের সুবিধার জন্য নির্মিত এই সমাজেরও কিছু চাহিদা আছে। সেটাও যুগের আবর্তনে পরিবর্তনশীল। আবার সামাজিক কিছু দায়িত্বও আছে। কালের আবর্তনে সমাজ পরিবর্তন হলেও সমাজ কে কার্যক্ষম ও আদর্শিক রাখার দায়িত্বে তেমন কোনো তারতম্য দেখা যায় না।  বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ ও সভ্যতা বলতে যে অঞ্চলটির কথা সবার আগে মাথায় আসে তাহলো যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। সেখানকার সামাজিক চাহিদার পরিবর্তনও বেশ উল্লেখযোগ্য।  ১৯৫0 সালের আমেরিকার দিকে তাকালে অবাক হতে হয় তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের দায়িত্ব ও সামাজিক চাহিদার অবস্থা প্রত্যক্ষ করলে। কারণ, বর্তমানে আমরা যে আমেরিকার সামাজিক চিত্র দেখছি , তার অনেকটা বিপরীত চিত্র দেখতে পাওয়া যায় তখন।  ১৯৫0 সালে একজন সুপটু গৃহিণীকে আমেরিকার ঘরের জন্য একটা সম্পদ স্বরূপ দেখা হত।  কোন গৃহিনী , তার পরিবারের সীমিত সম্পদকে কী করে পরিবার পরিচালনায় সফলভাবে কাজে লাগাতে পারেন,  থাঙ্কস গিভিং এর রোস্টেড টার্কির বেঁচে যাওয়া মাংস দিয়ে কী করে অন্য রেসিপি তৈরী করে অপচয় রোধ করা যায় সে বিষয়েও বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হতো।  পরিবারে সন্তানদের সংখ্যাও ছিল ৩ এর বেশি। বড় সন্তানদের ছোট হয়ে যাওয়া পোশাক ছোট সন্তানদের দিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অপচয় রোধ, এমনকি গৃহিণীদের সেলাই শেখার কাজে উদ্বুদ্ধ করা হত যাতে পরিবারের খরচ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।  মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারেও গার্হস্থ্য অর্থনীতি , ফ্যাশন ডিজাইন, টেক্সটাইল ডিজাইন , খাদ্য ও পুষ্টি, নার্সিং  ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যুগোপযুগী ধরা হত। মোট কথা, consumerism এর আগে আমেরিকান সমাজ, আমাদের মা দের সময়কার বাংলাদেশী সমাজ ও ইসলামিক সমাজে খুব বেশি একটা পার্থক্য ছিল না।  তাহলে এমন  কী  হল ! যার ফলে আমেরিকা ২০০০ সাল পার হতে না হতেই , মেয়েদের ঘরে থাকা বা পরিবার প্রতিপালনকে মূল্যহীন ভাবা শুরু করলো? মা তার দায়িত্ব পালন করবে, এমন ধারণাকে সেকেলে ভাবা শুরু করলো? সকল সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব চলে গেলো সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে? পারিবারিক কাঠামো ভেঙে গেল? মোটা মানুষের সংখ্যা মহামারীর মত চারিদিকে ছড়িয়ে গেলো?  এর মূল কারণ হলো , সমাজ অধিপতি তথা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কোন একসময় মনে হয়েছিল , জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারীরা ঘরে বসে অনুৎপাদনশীল কাজে নিজেদের মেধা ও মননকে অপচয় করছে। তৎকালীন সময়ে তারা, মহিলা ডাক্তার বা নার্স কিংবা কুটিরশিল্প জাতীয় কাজে মেয়েদের উদ্বুদ্ধ না করে , কারখানা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশন ও স্বল্পবসনা হয়ে পুরুষদের টাই এর  বিজ্ঞাপনে মেয়েদের নিযুক্ত করে "সভ্যতার" দ্রুত বিকাশ নিশ্চিত করেন।  ছোট , বড় বিভিন্ন পেশায় মেয়েদের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।  যেসকল পরিবারে বাড়তি উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা ছিল , তাদের প্রয়োজন মিটে , সত্য , তবে যেসকল পরিবার অল্পে তুষ্ট ছিল , তারা তাদের অনাড়ম্বর ও সাদামাটা জীবনকে বদলে নিলেন so called " আমেরিকান ড্রিম " এর সাথে! এতবছর পর তাই আমেরিকা কে তার আগের রূপে দেখা যায় না।  গবেষণায় দেখা গিয়েছে , ঘরের মেয়েরা ও পুরুষরা যেহেতু বাইরেই থাকেন তাই ঘরে রান্না করা হয় না।  ফলশ্রুতিতে ফাস্ট ফুড কালচারে অভ্যস্ত হয়ে ওবেসিটি এখন ন্যাশনাল এপিডেমিক।  ফাস্ট ফুডের চাহিদা যেমন তার যোগান ও তেমন বেশি। আর তাই দাম সস্তা। শিশুরা এই ব্যবস্থায় বেশি ক্ষতিগ্রস্থ।  ছোট থাকতে বড় হচ্ছে ডে কেয়ার সেন্টার এ।  ঘরের রান্না বা একই টেবিলে বসে পরিবারের সাথে খাওয়া , বাবা-মার সাথে সম্পর্ক কিছুই গড়ে উঠছে না।  তার উপরে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দৌরাত্ম।  মালয়েশিয়াতে একটা রেস্টুরেন্টে একটা পরিবারকে দেখেছিলাম; বাবা, মা ও দুই সন্তান সকলের হাতে মোবাইল। খাবার অর্ডার করে , যার যার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে! এতো কিছু চোখের সামনে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে আর দোষ দেয়ার সময়,  blue whale  গেম!  বিজাতীয় তথা অমুসলিম সমাজের সামান্য এই চিত্র আমাদের কাছেও আর অচেনা নয়।  কারণ আমরাও ঠিক তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগুচ্ছি। সফলভাবে আমরাও আমাদের সামাজিক চাহিদাকে পাল্টে ফেলতে পেরেছি। একজন শিক্ষিত গৃহিণী ঘরকন্না করতে চাইলে , তাকে গালি দেয়া আমাদের কর্তব্য! ঘরে বসে ঘরকন্না করা মায়েদেরও যে সন্তান প্রতিপালনে ১০০% সন্তুষ্টি , তাও নয়! কারণ , সারাক্ষণ কী খেলাম, পরিবারের সাথে কোথায় গেলাম , বাচ্চাকে কেমন cute লাগছে ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করার মাধ্যমে ঘরে থাকা মায়েরাও দেখানোর চেষ্টায় ব্যস্ত  , তারাও কিছু একটা করছেন! তারা ঘরে থাকার ব্যাপারটাতে মন থেকে খুশি হতে পারছেন না।  কারণ তাদের হাসব্যান্ড ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, সেই সাথে সমাজের চাহিদা তাকে অনুৎপাদক্ষম, মূল্যহীন ও অনেকাংশে বুদ্ধিহীন বিবেচনা করছে ও ক্ষণে ক্ষণে তাকে সেটা জানিয়েও দেয়া হচ্ছে।  অগত্যা লোক না দেখিয়ে উপায় কী? সারভাইভ তো করতে হবে!  প্রায়ই শপিং , বাইরে খাওয়া , বিদেশে বেড়াতে যাওয়া ও ছবি আপলোড এটা অনেক উৎপাদনশীল কাজ বৈকী! at least সমাজের সকলেই জানবে সে সুখেই আছে!!  যারা উপার্জন করছেন বা পড়াশোনা করছেন তারাও তাদের অর্জন শো অফ করতে পেছপা হন না।  ঘরে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর শিকার হলেও হাসিমুখের  ছবি আপলোড চলছে। কী ছেলে, কী মেয়ে , কী বয়ষ্ক , কী কম বয়ষ্ক সবারই একটা লোক দেখানোর প্রবণতা! পারিবারিক কাঠামো ভাঙাও শুরু করেছে। কারো জন্য কারো সময় নেই।  সকলে যেন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। তার উপর আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! কার সম্পদ বেশি, কে বেশি ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী; কার সন্তান সফল ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতা চলছেই। জিপিএ ৫ পাওয়া নিয়ে সন্তানদের উপর অত্যাচার করে হলেও, বন্ধু বান্ধবী বা আত্মীয়দের সন্তানদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে! আমি দেখেছি ক্লাস টেস্টে ২০ এ ১৮ পাওয়া বাচ্চাটার সাথে ২০ এ ২০ পাওয়া বাচ্চারা কথা বলে না! এধনের প্রেজুডিস ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের শেখাচ্ছি আমরা!  আমাদের সমাজেও ফাস্ট ফুডের প্রসারতা বাড়ছে। ঢাকার মধ্যেই খুঁজলে ১০ জনের মধ্যে ৫+ জনকে পাওয়া যাবে ওবেস। অবৈধ সন্তান, বয়ফ্রেন্ড , গার্লফ্রেন্ড কোন ঘটনাই না! পরবর্তী লেভেল হয়তো হাই স্কুল স্টুডেন্টদের মধ্যে প্রেগন্যান্সি ও সিঙ্গেল মাদার দের আবির্ভাব হতে দেখা! ছেলে মেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে বাবা মা খুশী, তবে , বিয়ে করতে চাইলে অগ্নিশর্মা! আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি অবস্থার ভয়াবহতা বুঝেই ১৬ বছর বয়সে বিশেষ বিবেচনায় বিয়ের অনুমতির কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরও বিয়ে হল কর্পোরাল পানিশমেন্ট ! পড়াশোনা ভালো করে না করলে "বিয়ে" দিয়ে দেয়ার "হুমকি" দেওয়া হয়।  আমাদের বাবা -মা ই সেটা করছেন। কোন কন্যা সন্তান বিয়ের পর চাকরি না করে পারিবারিক দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হলে , বাবা- মায়ের তীব্র নিন্দার শিকার হচ্ছে! এর কারণ সামাজিক চাহিদাকে  দায়িত্বের থেকে বেশি মূল্যায়ন। এই কারণেই কী আমেরিকা তার পারিবারিক কাঠামো হারায় নি? এ কারণেই কী তারা হোর্ডিং ও ডিপ্রেশন এর মত মানসিক ও ওবেসিটির মত শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে না? সামাজিক নানা সমস্যা : ব্রোকেন ফ্যামিলি, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, চাইল্ড এবিউস ইত্যাদি কী তাদের সমাজের  চিত্র নয়?  আমেরিকা সেটা উপলব্ধি করা শুরু করেছে। বর্তমানে আমেরিকান মেয়েরা ইউটুবে ভিডিও পোস্ট দিচ্ছে যে কী করে একজনের ( স্বামীর) উপার্জনে ঘর চালানো সম্ভব। SAHM বা Stay At Home Mom এটা একটা বিশেষ প্রিভিলেজ হিসেবে গণ্য। আমেরিকা আবারো ফেরত পেতে চাচ্ছে তাদের হারানো পরিবার। সেখানকার মেয়েরা তাদের মাতৃত্বকে ভালোবাসে। তারা তাদের সন্তানের সাথে সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী , উপার্জন অপেক্ষা। কিন্তু তাদের সমাজ এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে consumerism এর ফাঁদে পড়ে একজনের উপার্জনে জীবন নির্বাহ করা দুর্বিসহ। তাই এখন তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ফ্রুগাল লিভিং স্টাইল ও ২০০০+ স্কোয়ার ফিট এর বাসা ছেড়ে ৩০০ স্কোয়ার ফিট এর tiny house নির্মাণ করতে। ওবেসিটির অভিশাপ থেকে বাঁচতে vegan ফুড  আন্দোলনে নেমেছে।  আমেরিকা আজ যা হতে চাচ্ছে, আমরা তা ছিলাম ; আর আমরা যা হতে চাচ্ছি , তার থেকে আমেরিকা পরিত্রান পেতে চাচ্ছে। তবুও আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।  আর দুঃখজনক যে এব্যাপারে আমাদের কোন ভ্রূক্ষেপও নেই।  সমাজ কে সৃষ্টি করা হল মানুষের প্রয়োজনে , কিন্তু আজ , সমাজের চাহিদার কাছে মানুষই বন্দী। চাহিদাকে মূল্যায়ন করতে করতে আমরা দায়িত্বগুলোকে অবহেলা করে চলেছি।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা অর্থ এখন , মূল্যবোধ বিবর্জিত , উদাসহীন ও দায়হীন কর্তব্য পালন।  তাই তো আমাদের সন্তানরা এখন ইয়াবা সহ ধরা পড়ে , বাবা-মা কে হত্যা করে আর বৃদ্ধ বাবা-মা কে দেখা যায় বৃদ্ধাশ্রমে! আল্লাহ সঠিক পথ দেন, সঠিক বুঝ দেন আমাদের। সবকিছু হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়া দুষ্কর। আমেরিকা যা হারিয়ে আফসোস করছে , আমরা যেন তা পুরোপুরি হারাবার আগেই সতর্ক হই ইনশা আল্লাহ।